কিছু কথা ! যাকে ভাষায় প্রকাশ করাটা একটু দুরুহ । তবুও লিখতে কিংবা বলতে ইচ্ছা হয় তবে এর ফলাফল সবসময় ভাল হয় না । আজ খুব ইচ্ছে করছে আমার কিছু অসংগায়িত ভাবনার ভূমিকা বা উপক্রমণিকার উল্টো পিটে কি আছে বলার জন্য । তাই এই প্রবন্ধের নাম দিলাম প্রান্তিক উপক্রমনিকা। অপরাধ হলে অপারাধ দ্রষ্টার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি ।
ক্ষমা করো ।
কথায় বলে বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না । ইতিহাস বলে তা সত্যি । কিন্তু বই – পুস্তক –কিতাব এগুলো আসলে কি? কি এমন গোপন শক্তি লুকিয়ে আছে এর মাঝে -যার সংস্পর্শে মানুষ শিহরিত হয়, আনন্দিত হয় , বিস্মিত হয়, মনের অজান্তে অশ্রু ঝরে , অন্তরে কাঁপন উঠে, নিউরনে অনুরনন ঘটে , জ্ঞানে- গর্বে ভরে উঠে মন ও মনন !! এই খোলা প্রশ্নটা রইল সবার কাছে ।
আমি যখন বই পড়ি তখন মনে হয় এই বইয়ের যে কর্ণধার অর্থাৎ লেখক আমি তার সাথে কথা বলছি , তর্ক করছি, তথ্য এবং তত্ত্বের আদান প্রদান করছি ।
অর্থাৎ তার সাথে (আসলে তার দেহহীন আত্মা কিংবা মনের সাথে , যার একটা চমৎকার ক্ষমতা রয়েছে তাকে আমার সামনে কিংবা আমাকে তার সামনে নিয়ে যাওয়ার ) একটা গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠে । তাই বইয়ের ফাঁক ফোকরে লিখে দেই আমার মনে জন্ম নেওয়া স্পষ্ট কিংবা অস্পষ্ট কথা গুলো ।
মাঝে মাঝে মনে হয় মানুষ কল্পপনায় যখন কোন গল্প কিংবা কাহিনী সাজায় তখন তার নিজেকে কল্পনার রাজ্যের অদৃষ্টদাতা বলে ভেবে নেই । নাহয় কোন ভাবেই তো গল্পকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব নয় । আবার কখনো নিজেই উপস্তিত হয় অতীত -বর্তমান কিংবা ভবিষ্যতের কোন ঘটনায় ।
কখনও আশ্রয় নেই অন্য কোন আঁধারে কিংবা কালে । আপাতদৃষ্টিতে এই বিষয়টা বুঝে উঠা কঠিন । তবে বুঝলে অবাক হতেই হবে মানুষের মন কিংবা মস্তিষ্কের ব্যাপকতার কথা ভেবে । মানুষের কল্পনার রাজ্যে সে নিজেই রাজা, নিজেই প্রজা , নিজেই সমস্ত ভুবনের অধিকারী । তাই যখন কোন কিছু লিখতে যাই তখন নিজেকে অনেক বেশি শক্তিশালী বলে মনে হয় ।
আমার কল্পনার জগতে আমি ইচ্ছা মতো বিচরণ করতে পাড়ি । জানি না বিশ্ববিধাতা এর উপর হস্তক্ষেপ করেন কিনা । তবে আপাত তা মনে হওয়ার কোন কারন নেই । তাই ভাল আছি, বেঁচে আছি, সুখে আছি ।
আমি ভাল বই পড়ার কথা বলছিলাম –যাকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন “ ভাল বই হল এমন বই যা পড়ার সময় মনেই হবে না যে আমি বই পড়ছি ।
” রবীন্দ্রনাথ নিঃসন্দেহে ভাল কথা বলেছেন । তবে এতেই তৃপ্ত থাকা যায় না । আমাদের আরও কিছু জানার আছে, বুঝার আছে বলে মনে হয় । কেন বই পড়ি? কেন একটা বই ভাল লাগে অন্য একটা খারাপ লাগে ? কি লাভ বই পড়ে? কি আছে বইয়ের মাঝে? বইয়ের যে লেখক সে কি সত্যি তা বিশ্বাস করে যা সে লিখেছে ? কিংবা লেখক কি নিজেই বুঝে সে কি লিখছে ? না কি বই লেখাকে জীবিকার প্রধান ভিত্তি করে অধিক লাভের আশায় মনগড়া এবং আকর্ষণীয় লেখা লিখে যাচ্ছে ? আর আমরা কি অমৃত ভেবে তা পান করে যাচ্ছি ? এমনও প্রশ্ন আসে আমার চিন্তায় । বিশেষ করে যখন কোন অর্থহীন বই পড়ে শেষ করি তখন বেশি করে অস্থিরতা জন্মে আমার শরীরে আমার মস্তিষ্কে ।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় হুমায়ূন আহমেদ এর কতক বইয়ের কথা । বলে নেওয়া জররী যে আমি নিজেও তার অন্ধ ভক্তদের একজন । তবুও মনে হয় তার কিছু বই আর সিনেমার সিডি একই মানের । কিন্তু তা জেনেও আমি এবং আমরা অনেকেই সিনেমা সিডির চেয়ে কয়েক গুণ দামে তার বই কিনছি ,পরছি ,এবং ফেলে দিচ্ছি ।
মনে পড়ে গেল ২০১০ সালের বই মেলার কথা ।
অন্য প্রকাশনীর সামনে বিশাল ভিড় জমে আছে । স্বাভাবিক ভাবেই জাতের টানে আমিও সেই ভিড়ে যোগ দিলাম । জানতে পারলাম, খুব ভাল একটা বই বের হয়েছে হুমায়ূন আহমেদের ‘মাতাল হাওয়া’ । বিপুল উৎসাহ নিয়ে আমিও বই কিনব বলে স্থির করলাম । আমার সামনে এর মাত্র একজন মধ্য বয়স্ক লোক খুব তারাহুড়ো করে বই কিনছে ।
বইয়ের নাম ‘মাতাল হাওয়া’, মূল্য ২৩০ টাকা । আমি বিশ্বাস করতে পারলাম না । কিন্তু দেখলাম তিনি ঠিকই ২৩০ টাকা দিয়ে ‘মাতাল হাওয়া’ কিনে নিয়েছেন । আমি খুব হতাশ হলাম । কোন বিজ্ঞানের বইয়েরও দামও কারন ছাড়া এত হই না ।
অন্তত বইমেলা ঘুরে এমনটাই দেখা গেল । ভাবলাম হুমায়ূন আহমেদ হয়ত বিরাট কোন উপন্যাস লিখে ফেলেছেন । এর তাই হয়ত সব সচেতন মানুষেরা হুমড়ি খেয়ে পড়ছে তা লুফে নেয়াওর জন্য । আমার বইটা আর কিনা হল না । কারন আমার কাছে এত টাকা ছিল না ।
ভাবলাম একবার গিয়ে দর কষাকষি করে দেখি দামটা একটু কমানো যায় কি না । কিন্তু লাইন ছেড়ে আসার সময় মনে হল দোকানের লোকজন বিরক্ত হয়েছে । বাড়তি ঝামেলা মনে করেছে হয়ত। তাই আবার যেতে সাহস পাচ্ছিলাম না । অনেকদিন পড়ে আমার এক বই পাগল বন্ধু কামাল(হিমু টাইপের , তবে ভাবের হিমু নয় আসল হিমু ) আমার বাসায় হাজির হল ‘মাতাল হাওয়া’ নিয়ে ।
বলল বইটা অনেক দামী, অনেক পৃষ্টা আছে কিন্তু পড়তে মাত্র কয়েক ঘণ্টা লাগলো মাত্র । ভাল লাগে নাই । এর চেয়ে এই টাকাগুলা দিয়ে অনেক গুলা সিনেমা দেখতে পারতাম । শুনে আমার ভালই লাগল । তবুও বইটা নিয়ে পড়লাম ।
পড়ে মনে হল বইটা না কিনে ভালই করেছি । আমার কাছে যে টাকা ছিল তা দিয়ে সেদিন কোয়ান্টাম ফিজিক্সের একটা বই কিনেছিলাম । যে বইটা আমার সামনে সম্ভাবনার একটা নতুন দুয়ার খুলে দিল । আমি হুমায়ূন আহমেদ এর নিন্দা করছি না । তাকে ছাড়া আমার দিন কাটে না ।
ভীষণ ভাল লাগে এই আধাপাগল মানুষটাকে । এইজন্যই তার সংকীর্ণতা আমার ভাল লাগে না ।
তেমনি ভাল লাগে না পৃথিবী এবং জীবনের সংকীর্ণতা । অথচ কি প্রবলভাবে আমরা ভালবাসি আমাদের পৃথিবীকে আমাদের জীবনকে । কিন্তু এই রহস্যময় পৃথিবী কিংবা জীবন তাদের রসহ্য হয়ত কোনদিন আমাদের কাছে উন্মোচন করবে না ।
তবুও থেমে নেই মানুষের অগ্রযাত্রা । মানুষ পাড়ি দিচ্ছে আকাশ মহাকাশ , সৃষ্টি করছে জিন, ক্লোন । হাজার বছরের চেষ্টায় হয়ত মানুষ খুঁজে পেত জীবন এবং পৃথিবীর সঠিক ঠিকানা । কিন্তু তা হবে বলে মনে হয় না । কেননা মানুষ একদিকে যেমন সভ্যতা গড়ে তুলছে অন্য দিকে তা ধ্বংস করার নীল নকশা আঁকছে ।
আমরা তা টের পাই না । হয়ত এটা বিশ্ববিধাতার ইচ্ছায় হয় । যেন মানুষ কোনদিন তার অতীত –বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ না জানতে পাড়ে । আমাদের তাই আক্ষেপ করে হয়ত লাভ নেই । তবে মেনে নিতে পারি না ।
খুব রাগ হয় নিজের অসহায়ত্ব দেখে । কিন্তু কিছুই করার থাকে না । আসহায় দৃষ্টি পড়ে আকাশের দিকে , বিশ্ববিধাতার আনুগ্রহের আশায় । দৃষ্টি ফিরে আসে । ঈশ্বর বর দেন না ।
আমি অস্থির হই কিন্তু পরক্ষনে চেতনা ফিরে আসে কঠিন বাস্তবতার । আমি সব ভুলে যেতে চেষ্টা করি । ভুলে থাকার অভিনয় করি । কিন্তু আসলে ভুলতে পেরেছি কি ? আমার অতীত- বর্তমান এবং ভবিষ্যতের চিন্তা আমাকে ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে কি অনবরত ? আমার নিজের কাছে করা এই প্রশ্নের উত্তর আসে না । আমি তাতে আরও অস্থির হয়ে উঠি ।
কিন্তু কাউকে বলতে পারি না । এই ভাবেই চলছে আমার জীবন , হয়ত আপনার জীবন কিংবা আমাদের সবার জীবন ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।