উৎপাদিত পণ্যের সঠিক মূল্য নির্ধারণ না হওয়ায় ও মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের প্রভাবে প্রান্তিক কৃষক তথা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা প্রতিনিয়ত অর্থ ও শ্রম শোষণের শিকার হচ্ছে।
সমাজের মূল জনগোষ্ঠীর কথা বিবেচনায় না রেখে বুর্জুয়া বাজার নীতি অনুসরণ করার কারণে প্রান্তিক ব্যবসায়ীরা আর্থিক ক্ষতির মোকাবেলা করতে করতে অবশেষে ব্যবসা থেকে সরে আসছে। অন্যদিকে পুঁজিপতিরা ক্রমশ: পুঁজির পাহাড় গড়ে তুলছে। সুষ্ঠু, সঠিক বাজার ব্যবস্থাপনা ও পণ্য বিপনণ নীতির উন্নয়ন ও বাস্তবায়নই পারে এ সমস্যার মোকাবেলা করতে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি কৃষি নির্ভর।
বাজার আধুনিক অর্থব্যবস্থার প্রাণকেন্দ্র। বাজারকে ঘিরেই অর্থনৈতিক কর্ম প্রবাহ আবর্তিত হয়। কৃষি নির্ভর অর্থনীতির সাথে যে বিষয়টি ওতোপ্রতোভাবে জড়িত তার নাম কৃষি বাজার । উৎপাদিত দ্রব্য কৃষকের কাছ থেকে ভোগকারীর নিকট পর্যন্ত পৌঁছার জন্যে বাংলাদেশে নানা রকম বিপনণ ব্যবস্থা রয়েছে। এ সকল বিপনণ ব্যবস্থাকে হাট, গঞ্জ ও বাজার নামে অভিহিত করা হয়।
হাট: এ বিপনণ কেন্দ্রে বিক্রেতা মূলত: কৃষক। কৃষক তার নিজস্ব উৎপাদিত দ্রব্য সামগ্রী এখানে নিয়ে আসে এবং বিক্রি করে। কৃষকের উৎপাদিত যাবতীয় দ্রব্য সামগ্রী হাটে বিক্রি করার পেছনে যে যুক্তিটি কাজ করে তা মূলত প্রয়োজন। ‘অভাব অনটন আমাদের নিত্য দিনের সাথী। তাই আমরা আমাদের উৎপাদিত ফসল বেশি দিন ধরে ঘরে তুলে রাখতে পারি না।
ফসল আসার সাথে সাথে আমরা তা বিক্রি করে ফেলি’। এ কথাগুলো বললেন বড় রামদেবপুর গ্রামের মোঃ আজিম মিয়া। সরজমিনে পরিদর্শনে আরো দেখা যায়, প্রান্তিক কৃষক তাদের কোন না কোন প্রয়োজনে নিজের উৎপাদিত ফসল নামে মাত্র দামে বিক্রি করে ফেলে। এতে করে কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হয়। এ সকল হাট সাধারণত: প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে অবস্থিত।
যেখানে কৃষক সরাসরি উৎপাদিত পণ্য সামগ্রী নিয়ে আসেন। গ্রামের সাধারণ মানুষ এ সকল পণ্যের ক্রেতা হলেও মূলত: গঞ্জের দালাল, ফড়িয়া শ্রেণীই এ সকল বাজারের বড় ক্রেতা।
এ সকল হাটে পণ্যের মূল্য নির্ধারিত হয় অতি তুচ্ছ মূল্যে। একজন কৃষক হিসেব কষে এক মন শশা উৎপাদন করতে বীজ, সেচ, সার সব মিলিয়ে ৩২০ টাকা খরচ হয়েছে। তাই কৃষক সামান্য লাভে একমন শশা ৪০০ টাকা বিক্রি করে ফেলে।
কিšদ এ শশা উৎপাদনে যে জমি ব্যবহার করতে হয়েছে, কৃষককে কায়িক শ্রম দিতে হয়েছে কৃষক সকল হিসেব কষে না। ফলে আমাদের কৃষকরা সর্বদাই তাদের শ্রমের দাম থেকে বঞ্চিত হয়। আর তাদের এ শ্রমকে পুঁজি করে জীবন চালিয়ে যায় মধ্যস্বত্বভোগীরা।
গঞ্জ: গ্রামের ছোট ছোট হাট থেকে সামান্য দামে এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী কৃষি দ্রব্যসমূহ কিনে নিয়ে আসে এবং এখানে বিপনন করে। এ বিপনণ কেন্দ্রটি মূলত: মধ্যস্বত্বভোগীদের দখলেই থাকে।
এসব মধ্যবর্তী ব্যবসায়ীরা হাটে কৃষকদের নিকট হতে অল্প দামে কৃষিজাত পণ্য ক্রয় করে এখানে এনে তা উচ্চদামে বিক্রি করে। এ সমস্ত মধ্যবর্তী ব্যবসায়ীরা, দালাল, ফড়িয়া, আড়তদার, ব্যাপারী প্রভৃতি নামে পরিচিত। এ সমস্ত ব্যবসায়ীরা কৃষকদের/প্রান্তিক ব্যবসায়ীদের অসুবিধাগুলোকে পুঁজি করে তাদেরকে পণ্যের ন্যায্য দাম হতে বঞ্চিত করে।
বাজার: এখানে প্রান্তিক ব্যবসায়ীদের কোন অস্তিত্বই থাকে না। এখানে বড় ব্যবসায়ীরা কৃষিজাত দ্রব্যসমূহ শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ক্রয় করে এবং মধ্যস্বত্ত্বভোগীরাই হয়ে থাকে তাদের যোগান দাতা।
একজন কৃষক তার উৎপাদিত পণ্য গ্রামের হাটে বিক্রি করার সময় মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের প্রতারণায় তার শ্রম মূল্য থেকে বঞ্চিত হলেও এ বাজারে পণ্য বিক্রির সময় মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা একটি দ্রব্যের দামের সাথে কৃষকের শ্রম, ভূমির কর সব কিছুর দাম উঠিয়ে নেয়। সে ক্ষেত্রে কৃষকের শ্রমে দাম পায় দালাল আর কৃষক আবারো আর্থিকভাবে শোষিত হবার প্যাকেট পণ্য পায়। এ বাজারে কোন বিনিময় কিংবা প্রয়োজনে কাজ করে না। এ বাজারে একটাই উদ্দেশ্য তা হল মুনাফা। মুনাফা থেকেই জন্ম নেয় লোভ, লালসা, মানবাধিকার লঙ্ঘন করার একটি অঙ্কুর।
বিক্রির ধরণ>বিক্রিত পণ্য>কিভাবে বিক্রি হয় : সরজমিন পরিদর্শনে এ তিন রকম বাজারে তিন ধরনের বিক্রির ধরণ খেয়াল করা যায়। সোন্দলপুর ইউনিয়নের আব্দুল্লামিয়ারহাট একটি গ্রামীণ হাট। এ বাজারে প্রচুর পরিমাণে মিষ্টি আলু বিক্রি হয়। মিষ্টি আলুর মৌসুমে দেখা যায় এখানে “োরছে আলু বিক্রি হচ্ছে। প্রান্তিক কৃষকরা বাজারের সাধারণ ক্রেতাদের কাছ থেকে ২/৩ কেজি করে বিক্রি করছে।
অন্যদিকে শহরের বা থানা সদরের গঞ্জ থেকে কিছু মধ্যস্বত্বভোগীরা আসে এবং তারা একসাথে অনেকগুলো আলু কিনে নেয়। এ ক্ষেত্রে অনেক সময় আলু ওজন করা হয় না। মধ্যস্বত্বভোগীরা প্রান্তিক ব্যবসায়ীদের থেকে একসাথে সবগুলো আলুগুলো কিনে নিয়ে যায়। এখানে সাধারণ ভোক্তারা সহজলভ্য দ্রব্য ক্রয়ে ব্যর্থ হয় আর শিকার হয় অর্থ শোষণের মুখোমুখি।
এ আলুগুলো পরবর্তীতে গঞ্জে আসে।
গঞ্জের সাধারণ ক্রেতার পাশাপাশি বড় বড় ব্যবসায়ীরা ও থাকে। যাদের উদ্দেশ্য শিল্পের কাঁচামাল সংগ্রহ করা। এ ক্ষেত্রে মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা ০১ কেজি আলু প্রান্তিক ব্যবসায়ীর থেকে ক্রয়ে যেখানে ০৪ টাকা লেগেছে সেক্ষেত্রে গঞ্জের সাধারণ ক্রেতাদের থেকে ০১ কেজি আলু ৮/৯ টাকা বিক্রি করে। আর শিল্পের কাঁচামাল সংগ্রহ করতে যারা আসে তারা মূলত: কয়েক মন আলু একসাথে কিনে নিয়ে যায়। তাদের কাছে বিক্রির সময় মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা একজন প্রান্তিক ব্যবসায়ীর যাবতীয় খরচই উঠিয়ে নেয়।
এতে করে শ্রম মূল্য থেকে প্রান্তিক কৃষক নিগৃহীত হলেও মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা হয়ে উঠে লাভবান।
ক্রেতা বিক্রেতা ধরণ: গ্রামের হাটে ক্রেতা বিক্রেতার ধরণ থাকে আন্তরিক। কেন না গ্রামের হাটের ক্রেতা বিক্রেতা উভয়ই হয় প্রান্তিক কৃষক। গ্রামের হাটে তারা নিজের উৎপাদিত দ্রব্য বিক্রি করে প্রয়োজনীয় অন্য কোন দ্রব্য ক্রয় করার জন্যে আসেন। তাও আরেকজন প্রান্তিক কৃষকের থেকে।
তাই তাদের সম্পর্ক হয়ে থাকে আন্তরিক।
গঞ্জে ক্রেতা বিক্রেতার মাঝে সম্পর্ক থাকে কারবারী সম্পর্ক। এখানে ক্রেতা বিক্রেতা উভয়ই হয় অপরিচিত এবং উভয়েই উদ্দেশ্য থাকে মুনাফা। ক্রেতা কাঁচামাল হিসেবে ক্রয় ইচ্ছুক পণ্য দ্রব্য ক্রয় করতে এখানে আসে আর বিক্রেতা হয় গ্রামের হাট থেকে প্রান্তিক কৃষক কিংবা ব্যবসায়ীদের নিকট থেকে পণ্যাদি খরিদকারী সেই একই ব্যক্তি। যার স্বরূপ মধ্যস্বত্বভোগী হিসেবে গ্রামের প্রান্তিক উৎপাদক ও শিল্পের জন্যে কাঁচামাল সংগ্রহকারীর মাঝখানে এদের অস্তিত্বকে মধ্যস্বত্ব দালালী ফড়িয়া নামে আখ্যায়িত করা হয়।
মুনাফার পরিমাণ: গ্রামের হাটে প্রান্তিক কৃষক যে মূল্যে তার উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করে সেখানে মুনাফার পরিমাণ থাকে একদম কম। গ্রামাঞ্চলে শীত মৌসুমে দেখা যায়, এক কেজি টমেটো ২ টাকা কেজি দরে পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। এখানে একজন কৃষকের লাভ তো দূরের কথা প্রতি কেজিতে ৩/৪ টাকা করে ক্ষতিরও শিকার হতে হয় বলে জানান বাটইয়া গ্রামের মোঃ সৈয়দ আহম্মদ।
একটি পণ্য উৎপাদন করতে কাঁচামাল লাগে, জমি লাগে, যন্ত্রপাতি লাগে সেই সাথে শ্রম লাগে। তারপরই উৎপাদিত হয় পণ্য।
একজন কৃষক তার উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করার সময় যাবতীয় খরচাদির যোগ করলেও কখনো তার শ্রম মূল্য যোগ করে না। ফলে সর্বদা সে তার সঠিক মুনাফা অর্জন করতে পারে না।
কিšদ গঞ্জের মধ্যস্বত্বভোগীরা পণ্যের মূল্য নির্ধারণের সময় একজন প্রান্তিক চাষীর যাবতীয় খরচ তো ধরে সেই সাথে তার মুনাফার অংশও যোগ করে। তারপর সে পণ্যের বাজার দর নির্ধারণ করে। মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা তাদের নির্ধারিত দরে পণ্য বিক্রি করার ফলে পণ্যের যে উদ্বৃত্ত মূল্য বেরিয়ে আসে তাতে জড়িত একজন কৃষকের শ্রমের দাম ও মুনাফা।
কিšদ মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যের কারণে সর্বদাই আমাদের প্রান্তিক কৃষকরা এ অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
পণ্যের ব্যবহার: গ্রামের হাটে যে সকল পণ্য ক্রয় বিক্রয় করা হয় তা মূলত ব্যক্তিগত কাজেই ব্যবহার করা হয়। এখানকার প্রত্যেক ক্রেতা গ্রামের পরিবার কর্তা। পরিবারের ব্যবহারের জন্যে এখান থেকে তারা পণ্যাদি ক্রয় করে।
গঞ্জে বিক্রিত পণ্য সাধারণত: মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা আরো বেশি মুনাফা লাভের আশায় গ্রামের হাট থেকে ক্রয় করে।
সে অনুসারে তারা এগুলো গঞ্জে বিক্রি ও করে। এ সকল বিক্রেতার পণ্যাদি ক্রয়ের ক্রেতারা সাধারণ পুঁিজ হয়ে থাকেন। এখান থেকে পণ্য ক্রয় করে পরবর্তীতে তা আবার পুনরুৎপাদন করেন নতুন কোন দ্রব্যের মোড়কে।
পুনরুৎপাদিত পণ্য: গ্রামীণ হাট থেকে বিভিন্ন পণ্যাদি সংগ্রহ করে তা পরবর্তীতে পুনরুৎপাদন করে গ্রামের মানুষের কাছেই পৌঁছানো হয়। কথা হলো গ্রামের একজন ব্যবসায়ী আবুল খায়ের সাথে।
তিনি বললেন, সরিষা মিলের মালিকরা গ্রামের হাট থেকে সরিষা সংগ্রহ করে। তা শহরের মিলে এনে সরিষা থেকে তৈল উৎপাদন করে আবার গ্রামে পাঠানো হয়। তারপর গ্রামের মানুষ এমনকি সরিষা উৎপাদনকারী কৃষক ও সে তৈল ব্যবহারের জন্যে খরিদ করে নিয়ে যায়।
পুনরুৎপাদন ও প্রান্তিক কৃষক: শুধু সরিষার তৈল নয় প্রত্যেক পুনরুৎপাদিত পণ্যের বাজারই মূলত: গ্রাম। গ্রামের হাট থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করে আবার তা পুনরুৎপাদন করে গ্রামের মানুষের কাছে পাঠানো হচ্ছে।
এতে গ্রামের কৃষক শ্রেণী বার বার অর্থনৈতিক শোষণের মুখোমুখি হচ্ছে।
প্রথমত: একজন কৃষক কৃষি পণ্য উৎপাদনের সময় যে হারে খরচ যোগান দেন বিক্রি করতে গিয়ে সে হারে পণ্যের দাম পায় না। ফলে কৃষক হয়ে পড়ে উৎপাদনের প্রতি বিমুখ। আবার কৃষি পণ্যকে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে যখন পুনরুৎপাদিত পণ্য গ্রামের হাটে পাঠানো হয় তখন সেই পণ্য ক্রয় করতে গিয়েও প্রান্তিক কৃষক অর্থনৈতিক ক্ষতির শিকার হন। ফলে জীবন যাপনের জন্যে দ্বিতীয় বার অর্থের যোগান দিতে গিয়ে কৃষক ক্রমেই আর্থিক ক্ষতির চাকায় পিষ্ট হয়।
এ প্রসঙ্গে আলাপকালে শিক্ষক মিজানুর রহমান বলেন, বাজার ব্যবস্থাপনা নিয়ে আমাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে যে নীতিমালা রয়েছে তাতেই রয়েছে যথেষ্ট সমস্যা। কৃষক কৃষিপণ্য উৎপাদন করে তা গ্রামের হাটে বিক্রি করে। সেখান থেকে দালাল, ফড়িয়া হয়ে তা আবার কোন না কোন দ্রব্য হিসেবে পুনরুৎপাদিত হয়ে কৃষকের হাতে ফিরে আসে। এতে সময় এবং অর্থনৈতিক দুই-ই দারুনভাবে ক্ষতির মুখোমুখি হয়। সময় যেমন বাড়ত তেমনি দেশের কৃষককুলও অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হত।
যে এলাকায় সরিষা বেশি উৎপাদন হয় সেই এলাকায় যদি সরকার সরিষা তৈল কারখানা স্থাপন করতো তাহলে কৃষককে বার বার এ ক্ষতির মোকাবেলা করতে হতো না।
বার বার এ ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার কারণেই কৃষক উৎপাদনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। যে অঞ্চলে যে পণ্য বেশি সে অঞ্চলে সে পণ্যকে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে শিল্প কারখানা গড়ে তোলা উচিত বলে মন্তব্য করেন মাহবুবুল আলম দুলাল।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।