আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মায়া

যতোবার আমি শান্তি খুঁজেছি, ঠিক ততোবার আমার মাথায় শুধু একটি চিন্তাই এসেছে। সেটা হচ্ছে একটা ড্রিল মেশিন দিয়ে মাথার খুলিটা ফুটো করে দেওয়ার চিন্তা।
ঢাকা থেকে বেশিদূর আসিনি , এক ঘণ্টা হবে বড়জোর । লঞ্চের সামনে দাড়িয়ে রাতের সৌন্দর্য দেখছি , এমন সময় বচসা শুরু হল। পিছে ফিরে দেখি , লঞ্চ মাস্টারের রুমের সামনে অনেক লোক ।

চিল্লাচিল্লির আর গালির চোটে কান ফাটার উপক্রম । শফিককেও দেখছি না। ভিড়ের পিছনে থাকা একজনকে সরিয়ে নিয়ে এলাম । কি হয়েছে ভাই ? সমস্যা কি ? আরে ভাই , লঞ্চ নাকি আর যাবেনা । কেন ? ঢাকা থেকে লঞ্চ মালিক সমিতি এইমাত্র জানিয়েছে , লঞ্চ ধর্মঘট শুরু হয়েছে ।

আগেও শুনেছিলাম যদিও । তো এখন কি হবে ? লঞ্চ ঢাকা ফেরত যাচ্ছে । বরিশালে যাওয়া দরকার ছিল । হারামজাদারা ধর্মঘট ডাকছে ,কয়দিনে উঠাবে কে জানে । চিন্তিত হয়ে গেলাম ।

শফিকের কাল রাতের মধ্যেই ঝালকাঠি পৌছুতে হবে । কই যে গেলো , কে জানে । রাগ উঠলে আবার না হাতাহাতি করে বসে । প্রচণ্ড জেদি শফিক । একবার যা বলে ,তাই করে ছাড়ে ।

৫ মিনিটের মধ্যেই শফিক আসলো । মুখ থমথমে । কি করবি এখন ?? নেমে যাবো এইখানে । মানে ? এইখানে নদীর মাঝে নামবি কিভাবে ? জানিনা , মাষ্টারের সাথে তর্ক করছি । ব্যাটা বলেছে ফেরত যাবে ,আমিও বলছি আমি ফেরত যাবনা ।

বলছে , না গেলে নামেন । আমি হতভম্ব হয়ে রইলাম । আমার খাবি খাওয়া মুখ দেখে শফিক বলল , কয়েকটা নৌকা এসেছে । ওদের বললে ওরা কোন এক জায়গায় নামিয়ে দিবে । ভোর হলে নারায়নগঞ্জ থেকে বাস ছাড়বে ।

বাসে করে চলে যাবো। নে ,ব্যাগ গুছিয়ে নে । বুড়ো মতো এক মাঝি বৈঠা হাতে নিয়ে দাড়িয়ে আছে । আমরা যেতেই বৈঠা এগিয়ে দিলো । নৌকায় উঠার সময় লঞ্চের কয়েকজন একটু সহানুভুতি দেখানোর চেষ্টা করছিল , শফিক আমাকে বলল - চুপ থাক ।

বাজান , কই যাইবেন ? চাচা , আমাদের একটু পাড়ে নামিয়ে দিন । আলো দেখে নামিয়েন । রাতে থাকবো তো । একটু দেখে নামালে ভালো হয় । কাছেই আলো দেখা যাচ্ছে ।

বেশ একটা বাড়িও তো । অনেক খোলামেলা। নদীর পাশেই । শফিক কে দেখালাম । শফিক দেখেই বলল , চাচা , সামনের ডানের ওইখানে নামা যাবে ? হ বাজান , যাইব ।

ঠিক আছে , তাহলে নামিয়ে দিন । নদীর পাড় থেকে বেশ কিছুটা উঁচু জায়গায় দুটি রুম । নদীর পাড়ে বাধ দেওয়া , ভাঙ্গন ঠেকানোর জন্য । নদীর এতো কাছে কোন বাসা হতে পারে আমার ধারনা ছিলনা । হয়তো বাসাটা দুরেই ছিল ,ভাঙতে ভাঙতে এই পর্যন্ত আসার পর বাঁধ দেওয়া হয়েছে ।

শফিকও ভাড়া মিটিয়ে পিছে ঘুরে চেয়ে রইলো বেশ কিছুক্ষন । রুম দুইটি দেখে মনে হলনা কেউ এখানে থাকে । অথচ জিরো পাওয়ারের একটা বাল্ব জ্বলছে । পিছনের রুমটি লোহা লক্কড়ে ঠাসা। একমাত্র নদীর পাশের রুমটিই খালি ।

কিছুই নেই রুমে । তবু অনেক পরিষ্কার । মনে হয় আজই কেউ এসে ঘর মুছে গেছে । জানালা দুইটা , নদীর দিকে মুখ করা । দুটো জানালা থেকেই বাতাস এসে ঘরটিকে ভরিয়ে রাখে।

মাদুর আনা হয় নি ,লঞ্চ এ দরকার ছিলনা । যদিও এখানে মাদুরের দরকার নেই । দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে পড়লাম । কটা বাজে রে ? সোয়া ১১ । খাবার আছে সাথে ,আয় খেয়ে নেই ।

ইচ্ছা করছে না রে দোস্ত । একটা সিগারেট দে । শফিক সিগারেট ধরাল । জানালা থেকে নদীটার দিকে চেয়ে আছি । নির্জনতা ছাপিয়েও ঢেউ এর শব্দ আসছে কানে ।

কোনোদিন থাকা হয়নি ,নদীর পাড়ে রাতের বেলা ,এতোটা কাছে । নড়তেও ইচ্ছা করছে না । কেমন যেন নেশা ধরানো সবকিছু । তন্দ্রা আসি আসি করেও আসছে না । এক অদ্ভুত ক্লান্তি কখন যে ভর করলো শরীরে , বুঝতে পারছি না ।

মনে হচ্ছে বহুকাল ধরেই জায়গাটা চিনি । শফিক বিড়বিড় করে কিছু একটা বলল । জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা করছে না। বসে রইলাম । চোখে ভেসে আসছে কিছু ছবি ?এগুলি কি আমারই স্মৃতি ? চেনা চেনা লেগেও তো বড় অচেনা ।

মায়ের যক্ষের ধন ছিল ছেলেটা। ৩ বছরের একটা ছেলে এতো শান্ত হতে পারে ,কল্পনাও ছিল না । সারাদিন ফিট বাবু হয়েই থাকতো। বা পাশে সিতি করা চুল ,আর বড় বড় চোখের মায়াবি চাউনি। যে একবার দেখেছে , কোলে না নিয়ে পারেনি।

ঠাকুর পাড়ার সবার চোখের মনি ছিল বাচ্চাটা। মা চোখে চোখে রাখতো সবসময় । চোখের আড়াল হলেই মনটা কেমন যেন করত। সেই ছেলেকেই এক দুপুরে নিয়ে গেলো নদী । মা বসে থাকে এখানে।

সকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে ,রাত্রি আসে। তবু কেউ ফেরত আসেনা। অপেক্ষা শেষ হয়না মা এর । কখন তার হারানো মানিক ফিরে আসবে । ও আমার বাজান ,আমার বাপধন।

কই গেলি তুই ? অশ্রুহীন তপ্ত চোখে নেই কোন জীবনের স্বপ্ন। শুন্য চোখে নেই কোন আকুতি। শুধুই বসে থাকা , এখানেই , একই জায়গায় বসে থাকা। তেরো বছর কেটে গেছে। এক জীবনের অপেক্ষায় শেষ হয়েছে আরেক জীবন।

সন্ধ্যা হলেই রুমের বাতি জ্বালিয়ে দেন জীবনবাবু । সেই বাতি নিভেনি এক রাতের জন্যেও। মায়ের অপেক্ষার শেষ হয়েছে , তবু মায়াটা পরে আছে এই রুমে,এই খানে। এই মায়া অমর , এই মায়ার মৃত্যু নেই ।
 


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।