নাজমুল ইসলাম মকবুল
নির্বাচনে টাকার খেল আর উপচেপড়া তেল
নাজমুল ইসলাম মকবুল
(লেখাটির সাথে যেসব প্রসঙ্গ বাদ পড়েছে বলে আপনি মনে করেন সেসব প্রসঙ্গ স্মরণ করিয়ে দিলে বন্ধুদের নিকট কৃতজ্ঞ থাকবো এবং পরবর্তীতে লেখাটিকে আরও আপডেট করবো, ইনশাআল্লাহ)
ইউনিয়ন নির্বাচনের জোয়ারে কাঁপছে দেশ। অনেকগুলি জেলায় নির্বাচন শেষ হওয়ায় কেহ হেসেছেন বিজয়ের অট্টহাসি আবার অনেকেই পরাজিত হয়ে গায়ে জড়িয়েছেন অগণিত তালি লাগানো ফাড়া কাঁথা। অনেকের আমও গেছে ছালাও গেছে আবার অনেকে আনন্দে লাফাতে লাফাতে চিৎকার চেচামেচি করে গলাটাও ভেঙ্গে দিয়েছেন। গলায় পরেছেন গোলাপ গেন্ডাসহ কাচা পাকা ফুলের অসংখ্য মালা। হাতে নিয়েছেন কাঁচা ফুলের আস্ত তোড়া।
ছবি তুলেছেন দাত বের করে। বিজয় মিছিল বা বিজয় আনন্দের তুফানে দোলা দিয়েছে অনেকের মন পবনের নাও। বাসায় বা বাড়িতে গিয়ে গিন্নিকে দেখিয়েছেন বিডিও ফুটেজের কিংবা ডিজিটাল ক্যামেরায় তোলা ছবি। পত্র পত্রিকায় আসা ছবিগুলোকেও সযতনে ফাইল করে রাখতে কার্পন্য করেননি। ভবিষ্যতে যারা বিজয়ী হবেন তাদের সিংহভাগ প্রার্থীও এমন রুটিন ওয়ার্ক চালিয়ে যাবার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন।
আমাদের দেশে পার্লামেন্ট উপজেলা ইউনিয়নসহ যে কোন নির্বাচন এলেই ভোটারদের খাটি সরিষার তেল মারা শুরু হয় অত্যান্ত চাতুরতার সাথে পরিকল্পিতভাবে। বেশির ভাগ জনপ্রতিনিধিরা অত্যান্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে জনগনের সেবাকে ইবাদত আখ্যা দিয়ে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে খুবই তকলীফ করে স্ব-উদ্যোগে সস্তা জনসেবা করতে প্রতিযোগিতায় লেগে যান নির্বাচনের পুর্বেই। সালাম কালাম মুসাহাফা মোয়ানাকা কুশল বিনিময় সব খুবই বিনয়ের সাথে আগ বাড়িয়ে প্রার্থীকেই করতে দেখা যায় মিস্টি মিস্টি হেসে। শুধু তাই নয় আদর আপ্যায়ন চা বিস্কিট থেকে শুরু করে আরও বাহারি পদের মহামুল্যবান খেদমত চলে পরম আগ্রহ ও যতœ সহকারে।
তবে ভাবনার বিষয় হচ্ছে আমাদের দেশে বর্তমানে নির্বাচন যেন বড়লোকের খেলা।
যার অঢেল টাকা পয়সা আছে লাটিয়ল বাহিনী আছে তারাই কেবল নির্বাচন করতে ভোট আদায় করতে এবং বিজয়ী হতে সম হয়। টাকাও নাকি ছাড়তে হয় সময় সুযোগ ও জায়গামতো। বিগত কয়েকটি নির্বাচন দেখে মনে হয়েছে সৎ যোগ্য ও সর্বগ্রহণযোগ্য ব্যক্তি হলেও অঢেল টাকা পয়সা ঢালতে ব্যর্থ হওয়ায় বিজয়ের হাসি হাসতে না পেরে ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদেছেন। কিন্তু অশিতি মুর্খ অসাধু অসৎ টাউট বাটপার লুটেরা দখলবাজ কালোবাজারী হুন্ডি ব্যবসায়ী খুনি নির্যাতনকারী ছিনতাইকারী লাটিয়াল চাটুকার নেশাখুর শুধুমাত্র টাকা ও পেশিশক্তির জোরে নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়ে রেকর্ড সৃষ্টি করে কিংবা হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে জনপ্রতিনিধির খেতাব বাগিয়ে নিতে সফলতার সাথে সম হয়। গত কয়েকটি নির্বাচনে দেখলাম নির্বাচনের দু-তিন রাত পুর্ব থেকেই অধিকাংশ গ্রামের গুরুত্বপুর্ণ স্পটে বিভিন্ন প্রার্থীদের সমর্থকেরা বা ভাড়াটে লোকেরা রাত জেগে পাহারা দেয়।
কারন জানতে চাইলে উত্তর মিলে প্রতিপ প্রার্থীর লোকেরা টাকার বস্তা নিয়ে বের হয়েছে বিতরনের জন্য। ভোট প্রতি একশত টাকা থেকে শুরু করে হাজার কিংবা তার চেয়েও বেশি দেয়া হয়। তাই প্রতিপরে লোকেরা যাতে গ্রামে বা মহল্লায় টাকা নিয়ে ঢুকে ভোট খরিদ করতে না পারে সেজন্য এই রাত জেগে পাহারা দেয়া হচ্ছে। নির্বাচনের পরে দেখা যায় টাকার বস্তার মোকাবেলায় সত্যিই জনসমর্থন যোগ্যতা ও সততার পরাজয় ঘটে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এসব লোমহর্ষক ঘটনা সাধারন মানুষের যেন গা সওয়া হয়ে গেছে।
মানুষ এতে অবাক হয়না বরং মন্তব্য করে টাকা দিয়ে ভোট কিনে নিয়ে গেছে। রিটার্নিং অফিসার বা নির্বাচন কমিশনারের কাছে যে নির্বাচনী ব্যয়ের হিসাব দেয়া হয় তাতে আসল হিসেব দেয়া হয়না। আসল হিসেব থাকে শুধুমাত্র প্রার্থীর কলবের ভিতরে। জানেন শুধু দুই কাধের মুনকির ও নকীর ফেরেশতা। সংশ্লিষ্ট দফতরে দেয়া হয় গুজামিলের হিসেব।
অনেকে আবার টার্গেট ভিত্তিক কয়েক বছর পুর্ব থেকেই জায়গামতো তেল দিয়ে নিজের পাল্লা ভারি করার কাজ সারতে কসুর করেননা। আবার অনেকেই নির্বাচনকে টার্গেট করে ভোটারদের পারিবারিক সামাজিক বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান যেমন আকদ বিয়েশাদী গায়ে হলুদ শিরনী সালাদ আকিকা খতনা ওয়াজ মাহফিল খেলাধুলা সালিশী বিচার আচার এমনকি জানাযাতেও ঘন ঘন শরিক হন নির্বাচনকে টার্গেট করে। অনেকে পকেটের টাকা কড়ি বরাদ্ধ দিয়ে কর্মী সমর্থকদের মাধ্যমে বিভিন্নস্থানে খেলাধুলা ও ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করে নিজে প্রধান অতিথিও সাজতে দেখা যায় নির্বাচনকে টার্গেট করে। প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ ভোটারদের আপদে বিপদেও লোকদেখানো সাহায্য করতে দেখা যায় ভোট ও জনসমর্থনের পাল্লা ভারী করার উদ্দেশ্যে।
তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে নির্বাচনের পরে সে ঘোর সম্পুর্নরূপে কেটে যায়।
পরিচয় পাওয়া যায় মানুষের ভেতরে আরেক মানুষের। আসল মানুষের স্বরূপ তখন ধীরে ধীরে বের হয়ে আসে জনসম। ে সেবার ধরনও সম্পুর্ণরূপে পাল্টে যায়। স্রোত তখন উল্টো বইতে শুরু করে। এতো টাকা কড়ি খরছ ও রাত জেগে খেয়ে না খেয়ে যে সেবা প্রদান করা হয় নির্বাচনের পুর্বে তা কড়ায় গন্ডায় আদায় করা হয়।
ভোটাররা পাল্টা এসব রথি মহারথিদের সেবা শুশ্র“ষা করতে হয় সতর্কতার সাথে, টই টুম্বুর করে তৈল মালিশ করতে হয় সময় সুযোগমতো। চেয়ারম্যান মেম্বারদের কাছের লোকদের কদরও তখন হয়ে যায় আকাশচুম্বী। অনেক সময় কাছের লোকেরা মাধ্যম বা দালাল হিসেবেও কাজ করতে দেখা যায়। দালালরাও সময় সুযোগমতো পকেট ভারি করতে কসুর করেননা। তাই অনেককে বলতে শুনি যা খেদমত উদ্ধার করার তা ইলেকশনের আগেই উদ্ধার করে নাও, ইলেকশনের পরতো উল্টো খেদমতের পালা।
তখন তাদের দর্শন লাভ করতে কয়েকদিন পুর্ব থেকে সিরিয়াল নেবার প্রয়োজন হতে পারে। তাছাড়া ওই জনপ্রতিনিধির খাতিরের লোকদের কাছে বার বার ধর্না দিয়ে সাহেবের দিদার নসীবের পরিবেশও সৃষ্টি করার প্রয়োজন হতে পারে। সত্যিই দেখা যায় যারা পরবর্তী পাচটি বছর নিজের আয়েশ আরাম ও মহামুলবান সময়কে কুরবানী দিয়ে জনগনের সেবা করার মহান ব্রত নিয়ে নিজেকে উৎসর্গ করতে চান তাদের সিংহভাগই জনগনের সেবা শুশ্র“ষা বা খেদমত নির্বাচনের আগেই করেন হৃদয় মন প্রাণ উজাড় করে। এমন উজাড় করেন যে, নির্বাচনের পর আর অবশিষ্ট থাকে না, সব নিঃশ্বেষ হয়ে যাওয়ায় জনসাধারনের সেবার পালা শুরু হয় এসব রথি মহারথিদেরকে। সুদে আসলে নির্বাচনের পুর্বের সেবা উসুল করেন মান্যবর জনপ্রতিনিধি।
সালাম দিলে অনেক সময় সালামের জওয়াব পেতেও ভাগ্যবান হতে হয়। দেখা যায় নির্বাচনের পুর্বে যে নেতা আগেই কুশল বিনিময়ের জন্য হুমড়ী খেয়ে পড়তেন সেই জনপ্রতিনিধিই পার্শ্ব দিয়ে যাবার সময় কুশল বিনিময় দুরের কথা তাকে উল্টো খুবই আদব ও সতর্কতার সাথে সম্ভাষন জানাতে হয়। অনেক সময় দেখা যায় নির্বাচনের আগে ঠিকই চিনলেও নির্বাচনের পর না চেনার ভান করেন। তখন বায়োডাটা দিতে হয় চৌদ্দ পুরুষের নাম বলতে হয়। এই হলো আমাদের দেশের অধিকাংশ জনদরদী জনসেবকদের জনসেবার বাস্তব নমুনা।
দেশে যে কোন নির্বাচন এখন টাকার খেলায় পরিণত হওয়ায় আমাদের আজ পদে পদে এই পরিণতির শিকার হতে হয়। যাদের অঢেল টাকা কড়ি আছে, যারা রাতের আধারে দুহাত ভরে কাড়ি কাড়ি কালো টাকা অসাধু ভোটারদের মধ্যে বিলাতে কার্পণ্য করেননা তারাই কেবল নির্বাচনে জয়লাভ করে নিজের আখের গোছাতে দেখা যায়।
তবে এত্তোসব ভেজালের ভিড়ে এখনও কিছু সৎ যোগ্য ও খাটি দেশপ্রেমিক জনপ্রতিনিধি আছেন যারা নিজের স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে একমাত্র মহান আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি লাভের জন্য নিঃস্বার্থভাবে জনগনের সেবা করে জনগনের হৃদয়ে স্থায়ী আসন করে নিতে সম হচ্ছেন এবং ইতিহাসের পাতায় অমর অয় হয়ে বেঁচে আছেন ও বেঁচে থাকবেন। তবে তাদের সংখ্যা বের করতে হলে দুরবীনের যে প্রয়োজন পড়বেনা তা হলফ করে বলা যাবেনা।
লেখকঃ সভাপতি, সিলেট লেখক ফোরাম।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।