কি বলব
সিঁথিতে সিঁদুর মাখা ছবি দেখে হিন্দু ধর্মাবলম্বী গৃহবধূ মনে হলেও আসলে তা নয়। তার পরিচয় সে সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারের কিশোরী। নাম রেহনুমা কামাল পিয়া। বয়স মাত্র ১৩ বছর। মানিকগঞ্জের শিবালয় সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্রী সে।
আড়াই লাখ টাকা মুক্তিপণের দাবিতে ৫৩ দিন আগে হিন্দু যুবকদের হাতে অপহৃত হয় ওই কিশোরী। এখন পর্যন্ত তার কোনো খোঁজ নেই। মুক্তিপণের টাকা না পেয়ে অপহরণকারী যুবকরা মেয়েটিকে ভারতের পতিতালয়ে বিক্রি করে দেয়ার হুমকি দিচ্ছে। এমনকি তাকে হত্যা করে লাশ গুম করার হুমকি দিয়ে ফোন করা হয় মেয়েটির বাবাকে। এতেও থেমে থাকেনি তারা।
কিশোরী মেয়েটির সিঁথিতে জোর করে সিঁদুর মেখে ছবি তুলে এলাকায় প্রচার করছে। মেয়ের আপত্তিকর ছবি কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে পাঠানো হয়েছে পরিবারের কাছেও।
অসহায় বাবা মোস্তফা কামালের (গাড়ি চালক) অভিযোগ, মেয়ের খোঁজে স্থানীয় থানা পুলিশের কাছে বহুবার ধরনা দিয়েও কাজ হয়নি। প্রিয় সন্তান বেঁচে আছে কিনা তাও জানা নেই। মেয়ের চিন্তায় পাগলপ্রায় তার মা।
স্থানীয় পুলিশ মেয়েটিকে উদ্ধারের নামে রহস্যজনক আচরণ করছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। প্রভাবশালীদের ভয়ে প্রতিবাদও করতে পারছে না দরিদ্র বাবা-মা। আদরের
মেয়ের কথা বলতে গিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠেন মোস্তফা কামাল। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, একজন সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের অপ্রাপ্তবয়স্কা মেয়েকে হিন্দু ধর্মাবলম্বী যুবকরা অপহরণ করে পতিতালয়ে পাচারের হুমকি দিচ্ছে এবং তারা মেয়েটির সিঁথিতে জোর করে সিঁদুর মেখে ছবি প্রচার করায় মুসলমানের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে। এ কারণে এলাকার মুসলিম জনসাধারণের মধ্যে চরম ক্ষোভ রিবাজ করছে।
মোস্তফা কামাল জানান, গত ২ মার্চ সকাল সাড়ে ১১টার দিকে শিবালয় বাজার এলাকার বাড়ি থেকে প্রাইভেট পড়তে স্কুলে যাওয়ার পথে পিয়া নিখোঁজ হয়। সে শিবালয় সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে এ বছর কেবল নবম শ্রেণীতে উঠেছে। বাড়ি শিবালয় বাজারে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, শিবালয় বাজারের মৌ জুয়েলার্সের কর্মচারী শিপন কর্মকার ও তার সহযোগীরা পিয়াকে জোরপূর্বক অপহরণ করে নিয়ে যায়। এরপর তারা মোবাইল ফোনে আড়াই লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে।
টাকা দিতে না পারায় মেয়েটিকে হত্যা করা হবে বলে তারা হুমকি দেয়। এ ঘটনায় মোস্তফা কামাল শিবালয় থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে একটি মামলা দায়ের করেন। শিপন কর্মকার, মৌ জুয়েলার্সের মালিক গৌতম চন্দ্র কর্মকার, মালতী কর্মকার, পলাশ ও মৌ কর্মকারকে আসামি করা হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মাহবুব আলম প্রথমে আন্তরিকভাবে মেয়েটিকে উদ্ধার ও অপহরণকারীদের গ্রেফতারের উদ্যোগ নেয় বলে জানান মোস্তফা কামাল। তদন্ত কর্মকর্তা অপহরণকারীদের মোবাইল ফোনের কল লিস্ট পরীক্ষা করে তাদের অবস্থানও শনাক্ত করেন।
মোবাইল ফোনের কল লিস্ট পরীক্ষা করে পুলিশ জানতে পারে অপহরণকারীদের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনে অন্য ব্যক্তির নাম-ঠিকানা। কল লিস্ট অনুযায়ী ওই এলাকারই মনা ও মেস্তফা নামে দুই জনকে পুলিশ আটক করলে মোস্তফা জানায়, তার মোবাইল ফোনটি মনার মাধ্যমে অপহরণকারী শিপনকে দিয়েছে। পুলিশ এ দু’জনকে আটক করার পর রাতে থানা থেকে রহস্যজনকভাবে ছেড়ে দেয়া হয়। এরপর থেকেই ঘটনা অন্যদিকে মোড় নেয়। পুলিশের পরিকল্পনা অনুযায়ী অপহরণকারীদেরকে ৫০ হাজার টাকা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মানিকগঞ্জ পেট্রল পাম্পের কাছে ডেকে আনার পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যায়।
শিপনের ওই দুই বন্ধু থানা থেকে বেরিয়ে রাতেই ফোন করে এ খবর ওদের পৌঁছে দিলে ক্ষুব্ধ হয়ে অপহরণকারীরা পিয়ার বাবাকে হুমকি দিয়ে বলে, পুলিশকে জানানোর কারণে তার মেয়েকে আর কোনো দিন ফিরিয়ে দেয়া হবে না। তারা এরপর থেকে একের পর এক হুমকি দিতে থাকে। তারা ০১৯২১৬৭৮৭৫৩ ও ০১৭৪৪৫২০৬৬৫ নম্বর দিয়ে ফোন করে আরও হুমকি দেয়, বাড়াবাড়ি করলে মেয়েকে ভারতের পতিতালয়ে পাচার করা হবে। এরপর থেকে তারা মোবাইল ফোনও বন্ধ করে রাখে। নিরুপায় হয়ে মোস্তফা কামাল মানিকগঞ্জ প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন ও র্যাব-৪ ইউনিটে গিয়ে লিখিত অভিযোগ দেন।
মোস্তফা কামাল বলেন, পুলিশকে জানানোর কারণে অপহরণকারীরা তার কিশোরী মেয়েটির সিঁথিতে সিঁদুর মেখে ছবি তুলে এলাকায় প্রচার করছে। বিভিন্ন লোকজনের হাতে হাতে সেই ছবি। এমনকি তারা আমার ঠািকানায় কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে এ ছবি পাঠিয়ে দিয়েছে। একজন মসুলিম পরিবারের নাবালিকা কন্যার সিঁথিতে সিঁদুর মাখা ছবি বাবা-মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেয়ার এ দুঃখ কোথায় রাখি। তিনি বলেন, এর আগে মানিকগঞ্জ থানার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই মাহবুব আলমকে সঙ্গে নিয়ে প্রধান আসামি শিপনের বাড়ি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ জেলার হাজিপুরে গিয়েও আসামিকে ধরা যায়নি।
তিনি বলেন, আমি একজন সামান্য গাড়ি চালক। আসামি ধরতে এসআই মাহবুবকে মানিকগঞ্জ থেকে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ নিয়ে যাওয়ার জন্য ১০ হাজার টাকায় মাইক্রোবাস ভাড়া করেও কোনো কাজ হয়নি। বরং তিনি সামান্য কারণে বেগমগঞ্জে আমার সঙ্গে চরম দুর্ব্যবহার করেন। আসামি ধরতে আমি স্থানীয় পুলিশের সহায়তা নিতে বললে এসআই মাহবুব লোকজনের সামনে আমাকে গাড়ি থেকে লাথি মেরে ফেলে দেয়ার হুমকি দেয়। এমনকি ওই পুলিশ কর্মকর্তা আসামি না পেয়ে ফেরার পথে মাইক্রোবাস নিয়ে তার এক আত্মীয়ের বাড়িতে রাত যাপন করায় মাইক্রোবাস ভাড়াও বেশি পরিশোধ করতে হয়েছে।
অভিযোগে আরও জানা যায়, মৌ জুয়েলার্সের মালিক গৌতম কর্মকারের সঙ্গে পিয়ার বাবা মোস্তফা কামালের পূর্বের বিরোধ রয়েছে। মামলার অপর আসামি গৌতম চন্দ্র সরকার, তার স্ত্রী মালতি সরকার ও কর্মচারী পলাশ ঘটনার পর গা ঢাকা দেয়। বর্তমানে শিপন ছাড়া অন্যরা আদালত থেকে জামিনে এসে এলাকায় প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা করছে। জানা যায়, শিপন পাঁচ বছর ধরে মৌ জুয়েলার্সে চাকরি করে। মৌ জুয়েলার্সের মালিক গৌতম এলাকার প্রভাবশালী হওয়ায় প্রশাসন ও স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান তার পক্ষাবলম্বন করছে।
তিনি এখন মেয়েকে আদৌ ফিরে পাবেন কিনা এ নিয়ে উদ্বিগ্ন। এমনকি প্রতিবাদ করতে চাইলে প্রভাবশালীরা তাকে এলাকা ছাড়া করবে বলে তিনি আশঙ্কা করছেন।
এ ব্যাপারে শিবালয় থানার ওসি রেজাউল করিম জানান, মেয়েটি অপহরণ হয়েছে নাকি প্রেম করে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। আমরা যতটুকু জানতে পেরেছি শিপনের সঙ্গে প্রেম করে সে বাড়ি ছেড়েছে। তিনি বলেন, মেয়েটির ইচ্ছেতেই সে সিঁথিতে সিঁদুর লাগিয়ে ছবি তুলে বাবা-মা ও পুলিশের কাছে পাঠিয়েছে।
এমনকি সে নিজের হাতে চিঠি লিখে তাকে খোঁজ না করতে থানা পুলিশের কাছেও পাঠিয়েছে। তবে চিঠির লেখা ওই মেয়েটির হাতের নাকি অন্য কারো তা কিভাবে নিশ্চিত হওয়া গেছে জানতে চাইলে ওসি বলেন, এটি মেয়েটির হাতে লেখা বলেই মনে হচ্ছে। একই সঙ্গে তিনি বলেন, তারপরও আমাদের ব্যর্থতা মেয়েটিকে এতদিনেও আমরা উদ্ধার করতে পারিনি। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মাহবুব আলম জানান, তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ দেয়া হয়েছে তা সঠিক নয়। মেয়েটিকে উদ্ধার এবং আসামি গ্রেফতারে আমরা আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।