আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হিন্দু আইন



সৃষ্টির আদিকাল থেকেই বিভিন্ন দেব-দেবীর আদেশ আর প্রথা থেকেই প্রাথমিক পর্যায়ে হিন্দু আইনের উৎপত্তি বলে গণ্য করা হয়। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা তাদের শাস্ত্রীয় হিন্দু আইনকে কোন পার্থিব সার্বভৌমের আদেশ বলে গণ্য করে না বরং তারা হিন্দুধর্মকে অপার্থিব সার্বভৌমের আদেশ বলে গণ্য করে। হিন্দুধর্মের উৎপত্তি সম্পর্কে অনুসন্ধান করলে এই তথ্য বেরিয়ে আসে এটি ঈশ্বরের আদেশ এবং এই আদেশ রাজা ও প্রজা সবার ওপর সমানভাবে প্রযোজ্য। কোন দেশের শাসনকর্তা ঈশ্বরের নির্দেশকে কার্যকরী করে মাত্র। রাজার বা দেশের প্রধানের নিজের কোন নির্দেশ জারি করার মতা নেই।

যেহেতু রাজা/প্রধান নিজে কোন আইন প্রণয়ন করতে পারেন না। সুতরাং আইন পরিবর্তনের মতাও তার নেই। হিন্দুধর্মের মূলের সৃষ্টির কথা থেকেই বোঝা যায়, মূল থেকে এ আইনের উৎপত্তি হয়েছিল। হাজার হাজার বছর পরও এর আকার-আকৃতি, অবস্থান একই তিমিরে অবস্থান করছে। হিন্দু আইনের শুরুর দিকের সঙ্গে বর্তমান আইনের তুলনা করলে এদের মধ্যে পার্থক্য খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।

সভ্যতার বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুরই পরিবর্তন হয়েছে। পরিবর্তন এসেছে অধিকারের আর অধিকার আদায়ের মানদণ্ড তথা বিভিন্ন ধর্মের আইনের। মুসলিম আইন, খ্রিস্টান আইনÑ সব আইনের পরিবর্তনের হাওয়া লাগা শুরু হয়ে গেছে, সভ্যতার পরিবর্তনের হাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। শুধু হিন্দু আইন যে অপরিণত অবস্থায় জš§লাভ করেছে। এত বছর পর এটি বয়োবৃদ্ধ হয়েছে ঠিকই কিন্তু পরিপক্বতা পায়নি।

বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রধান ধর্ম - হিন্দুধর্ম। ১৯৯১ সালের আদম শুমারি অনুযায়ী এটি মোট জনসংখ্যার ১১.৫ শতাংশ। এই বিপুল জনসংখ্যার অধিকার রার ক্ষেত্রে পরিবর্তিত ও আধুনিক আইনের প্রয়োজনীয়তার ধারাবাহিক ও তুলনামূলক বিশেষণ করা হল : উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে : হিন্দু উত্তরাধিকারিত্ব দুই প্রকার মতবাদের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। এদের একটি দায়ভাগ এবং অন্যটি মিতারা মতবাদ। দায়ভাগ বলতে বোঝায়, যারা মৃত ব্যক্তির শ্রাদ্ধে শাস্ত্রমতে পিন্ড দান করতে পারে তারাই মৃত ব্যক্তির একমাত্র সম্পত্তির উত্তরাধিকার।

অন্যদিকে মিতারা মতবাদ মতে, সম্পত্তি লাভের অধিকার রক্ত নৈকট্য বা ঘনিষ্ঠ আত্নীয়তা থেকে উদ্ভব হয়। উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা দায়ভার মতবাদে বিশ্বাসী। এ তো গেল হিন্দু আইনের সম্পত্তি বিভাগের প্রাচীন নমুনা। যে নমুনায় নারীদের উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে চরম উদাসীনতা ল্য করা যায়। এ উদাসীনতার ফলস্বরূপ হিন্দু নারীরা পিতা বা স্বামী উভয়ের সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হয়।

দায়ভাগ মতবাদে মূলত ৪৮ জন পুরুষ ও পাঁচ ধরনের নারীর উত্তরাধিকারের কথা বর্ণনা করা হয়েছে, যারা শাস্ত্র অনুযায়ী উত্তরাধিকার লাভ করে। এরা হচ্ছেন বিধবা কন্যা, মা, পিতামহী, প্রপিতামহী। দায়ভাগ অনুযায়ী এই পাঁচজন শাস্ত্র অনুযায়ী উত্তরাধিকার লাভ করলেও তাদের ক্রমপর্যায় এত দূরে যে এই ক্রমান্বয় পেরিয়ে আদৌ কেউ সম্পত্তির অংশ পেয়েছে কিনা আমি আজও সন্দিহান। কেননা এই মতবাদ অনুযায়ী পুত্র, পৌত্র বা প্রপৌত্রের মধ্যে কেহ জীবিত থাকলে পাঁচজন নারীর মধ্যে কেহই সম্পত্তির কোন অংশ বিশেষ পাবেন না। আর এদের অবর্তমানে কেউ সম্পত্তি লাভ করলেও সেটি শুধু জীবনস্বত্বের ভিত্তিতে লাভ করতে পারে।

সত্যি বিচিত্র! মজার ব্যাপার হল একই উপমহাদেশে বসবাস করা সত্ত্বেও আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত এই বিচিত্রতা থেকে বেরিয়ে এসেছে অনেক আগেই। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর ভারত তাদের জনগণের অধিকার রায় এই পুরনো আইনকে বিভিন্নভাবে সংশোধন করেছে। Hindu Succession Act-১৯৫৬ এর একটি বড় উদাহরণ। ভারত এসব প্রাচীন ও অসম পর্যায়মূলক মতবাদভিত্তিক উত্তরাধিকত্বের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে সে স্থানে সংযোজন করেছে নতুন নতুন আইন। বর্তমানে ভারতে হিন্দু মহিলারাও পুরুষদের সঙ্গে সমান অংশে উত্তরাধিকারিত্ব লাভ করেছে।

ভারতে অৎঃরপষব-৮ এ স্বামীর সম্পত্তিতে স্ত্রীর অধিকারের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে আরও বলা হয়েছে, বিচ্ছেদকৃত কোন মহিলা যদি পুনরায় বিয়ে না করে, যদি তার আয় অপর্যাপ্ত হয় তবে সে তার পূর্বোক্ত স্বামীর কাছ থেকে জীবন স্বত্বের ভিত্তিতে ভরনপোষণ দাবি করতে পারবে। এছাড়াও ১৯৪৬ সালের আইনে হিন্দু মহিলাদের দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে মামলা করার মতা দেয়া হয়েছে। এছাড়াও সম্পত্তি অর্জন বিষয়ক আইন ১৯৩০, ১৯২৫ সালের উত্তরাধিকার আইন। ভূমি আইনে হিন্দু মহিলাদের অধিকার ১৯৩৭সহ এরকম আরও বহু আইন অধিকার রায়, ভূমিকা পালন করছে।

আমরা শুধু অন্যের শেখানো বুলিই ‘হড়বড়’ করে আবৃত্তি করতে শিখেছি। এ ছাড়া এত বছর পর নতুন সুরে নতুনভাবে আবৃত্তি করার প্রয়োজনীয়তা কেউ বোধ করে না। ভারতে ১০০ কোটি জনগণের জন্য আইন সংস্কার করা যেতে পারলে বাংলাদেশের ২ কোটি হিন্দু জনগণের জন্য কেন সংশোধন আনা হবে না। বিয়ে বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে : হিন্দু আইন অনুসারে বিয়ে হচ্ছে ধর্মীয় কর্তব্য পালনের উদ্দেশ্যে একজন পুরুষ ও একজন মহিলার পবিত্র বন্ধন। বিয়ে মূলত একটি ধর্মীয় সংস্কার।

মোম লাভের জন্য হিন্দুশাস্ত্রে যে ১০টি সংস্কারের কথা উলেখ আছে, বিয়ে তাদের মধ্যে শেষ সংস্কার। সুতরাং ধর্মীয় এ সংস্কার থেকে বের হওয়ার বিধান হিন্দু আইনে নেই। বিয়ে একটি পবিত্র বন্ধন এ কথা যেমন সত্য, তেমনি এ বন্ধন যদি দৃঢ় না হয়, যদি বন্ধনে ফাটল দেখা যায় সেটা যে কারণেই হোক না কেন, সে ক্ষেত্রে বিচ্ছেদ নামক শব্দটির ব্যবহার অপরিহার্য। Article-১৩(১) এবং বিয়ে বিচ্ছেদ আইন ১৯৫৫ এর মাধ্যমে ভারতে বিয়ে বিচ্ছেদের মতা দেয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, প্রাচীন হিন্দু আইনে বিয়ের অনেক কিছুই সংশোধন করা হয়েছে।

উদাহরণস্বরূপঃ ১. ভিন্ন জাতিতে বিয়েকে বৈধ করা হয়েছে। ২. বহুবিয়ে নিষিদ্ধ ও শাস্তিমূলক অপরাধ হিসেবে ধরা হয়েছে। ৩. বিয়ের উপাদান ও শর্তকে শিথিল করা হয়েছে। বিয়ে বিচ্ছেদ আইন ১৯৫৫-এর মতে মহিলা ও পুরুষদের বিয়ে বিচ্ছেদের ত্রেগুলো নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। মহিলাদের ক্ষেত্রে ভরণপোষণ না দেয়া, ধর্ষণ ইত্যাদি, অন্যদিকে পুরুষদের ক্ষেত্রে পাগল বা ডাক্তারি ভাষ্য মতে মানসিক বিকারগ্রস্ত, ২ বছরের মতো নিখোঁজ, ধর্মান্তরিত ইত্যাদি বাংলাদেশেও ভারতের মতো বিয়ে বিচ্ছেদ আইন ১৯৫৫ অনুসরণ করে পর্যাপ্ত আর্থিক তিপূরণ সাপেক্ষে বিয়ে বিচ্ছেদের প্রচলনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

বিয়ে ও বিয়ে বিচ্ছেদ রেজিস্ট্রেশন আইন : এতক্ষণ হিন্দু আইনের যে ত্রেগুলো নিয়ে আলোচনা করেছি সেগুলো সংশোধনের মূল আইনকে এক পাশে সরিয়ে রেখে সংশোধনের কথা ভাবতে হবে। কিন্তু বিয়ে ও বিয়ে বিচ্ছেদ রেজিস্ট্রেশন এমন একটি আইন যেখানে মূল হিন্দু আইনের সঙ্গে এর কোন বিরোধ নেই। রেজিস্ট্রেশনবিহীন বিয়ে ও বিয়ে বিচ্ছেদ সংক্রান্ত মামলাগুলোতে যে সমস্যা হয় সেগুলো সমাধানের ও প্রতিকারের কোন জোরালো প্রমাণের উপাদান পাওয়া যায় না। তাই এ সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে নিবন্ধনকৃত নথি যাতে ভূমিকা রাখতে পারে সেজন্য এখনি বিয়ে ও বিয়ে বিচ্ছেদ রেজিস্ট্রেশনের জন্য রেজিস্ট্রার নিয়োগ দেয়া যেতে পারে। হাজার হাজার বছর আগের বিভিন্ন ধর্মের পৃথক পৃথক আইন সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য ছিল একদিকে যেমন অধিকার রা করা অন্যদিকে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা।

কিন্তু ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে যেসব আইন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সময়ের এত বিবর্তনের পর সময় এসেছে ধর্মীয় মূল্যবোধ ঠিক রেখে আইনকে যথাযথভাবে সংশোধন করার। আর এ েেত্র সঠিক ভূমিকা রাখতে পারেন বিভিন্ন রাজনৈতিক হিন্দু নেতা ও সংসদীয় আইন প্রণেতারা। কারণ অনেক হিন্দু নেতাই এ আইন সংশোধনের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেন না। প্রথমত তাদের ধারণা এটি সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত হানবে। দ্বিতীয়ত হিন্দু নারীদের উত্তরাধিকারের েেত্র সমবণ্টন নিশ্চিত করা হলে তাদের মধ্যে ধর্মান্তরিত হওয়ার প্রবণতা বেড়ে যাবে।

অর্থাৎ সম্পত্তি নিয়ে তারা ধর্ম ত্যাগ করবে। এটি একটি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা। কেননা, যখন কোন ব্যক্তি ধর্মান্তরিত হয় তখন সে তার নিজ ধর্মের আইন অনুযায়ী উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। সবকিছুর পরে একটি কথা না বললেই নয়। এত বছর ধরে আমরা যে সংস্কৃতি লালন করে আসছি তা যেমন একদিনে পরিবর্তন করা সম্ভব নয়, তেমনি পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও এর সামাজিক প্রেক্ষাপটের কথাটি মাথায় রাখতে হবে।



এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.