সাংবিধানিকভাবে ফ্রান্সে প্রত্যেক নাগরিকের স্বাধীনতা ও মানবিক অধিকার সুরক্ষিত। কিন্তু বর্তমান প্রেসিডেন্ট নিকোলাই সারকোজির বহু সংস্কৃতিবাদ অভিবাসন ও বিরোধী পদক্ষেপ দেশটিতে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করিয়াছে। কিছুদিন আগেও অবৈধ অভিবাসী প্রত্যাবর্তন কর্মসূচি সফল করিতে ফ্রান্সে বসবাসকারী রোমা বা জিপসি সমপ্রদায়ের বস্তি উচ্ছেদে ফরাসি পুলিশের কঠোর ভূমিকা বিশ্বের গণমাধ্যমে দেখানো হইয়াছে। সমপ্রতি আল জাজিরা সূত্রে প্রাপ্ত খবরে জানা যায়, ফ্রান্সে অভিবাসীরা আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় এখন বেশি বর্ণবাদের শিকার হইতেছেন। সমপ্রতি প্রকাশিত ফ্রান্সের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ৩৬ ভাগ বর্ণবাদের শিকার উত্তর আফ্রিকার অভিবাসী।
দেশটিতে বোরকা, ধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়া অনুষ্ঠিত সামপ্রতিক বিতর্কে ফরাসি মুসলিমদের ভিনদেশী হিসাবে চিহ্নিত করা হইয়াছে। নির্বাচনে সুবিধা পাওয়ার জন্য রাজনীতিকরা ইসলামভীতি ব্যবহার করিয়া থাকেন বলিয়াও মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
ইতিপূর্বে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এজেন্সি ফর ফান্ডামেন্টাল রাইটস-এর এক জরিপ প্রতিবেদনেও ইউরোপে বসবসকারী জাতিগত সংখ্যালঘু এবং অভিবাসীদের জীবনে বর্ণবাদ ও বৈষম্যের শিকার হইবার বাস্তবতা খানিকটা ধরা পড়ে। কিন্তু সমপ্রতি ফরাসি সমাজে ইসলামের প্রশ্নে অসহিষ্ণুতা প্রদর্শন করা হইতেছে, তাহাতে দেশটির প্রায় ৫০ লাখ মুসলিম নাগরিকের বৃহত্তর সমপ্রদায় হইতে বিচ্ছিন্নতার বোধ উদ্বেগজনকভাবে বাড়িয়া যাওয়াই স্বাভাবিক। গত ১১ এপ্রিল হইতে ফ্রান্সে জনসমাগমস্থলে দেশী অথবা বিদেশী মুসলিম নারীদের নেকাব ও বোরকা পরা নিষিদ্ধ করিয়া একটি বিতর্কিত আইন কার্যকর করা হইয়াছে।
ইহাছাড়াও ফ্রান্সে মুসলিম অভিবাসীদের নিরুত্সাহিত করার নানা কর্মসূচির মাধ্যমেও দেশটিতে ইসলাম-বিদ্বেষী প্রবণতা তীব্রতর হইতেছে বলিয়া জানা যায়। প্রেসিডেন্ট সারকোজির অভিবাসন ও মুসলিম বিদ্বেষী প্রবণতার প্রভাব রহিয়াছে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত অন্যান্য দেশেও। গত সপ্তাহে বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনও যুক্তরাজ্যের ব্যাপক অভিবাসনের বিরুদ্ধে তাহার দল ও সরকারের কঠোর অবস্থানের কথা পুনর্ব্যক্ত করিয়াছেন। ইতিপূর্বে যুক্তরাজ্যে দীর্ঘদিন ধরিয়া চলিয়া আসা রাষ্ট্রীয় বহু সংস্কৃতিবাদ তত্ত্ব (স্টেট মাল্টিকালচারালিজম) ব্যর্থ হইয়াছে বলিয়াও দাবি করেন তিনি এবং ব্রিটিশ মুসলিমদের রাষ্ট্রীয় মূলধারায় সম্পৃক্ত হওয়ার পরামর্শ দেন। ইহার আগে জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেলও অনুরূপ মন্তব্য করিয়াছেন।
তাহারা ৮০ মিলিয়ন মুসলিম অধ্যুষিত শক্তিশালী তুরস্ককে ইউরোপীয় ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্ত করারও ঘোর বিরোধী।
অস্বীকার করা যাইবে না, নাইন-ইলিভেনের পর সৃষ্ট বিশ্ব পরিস্থিতিতে ইউরোপ-আমেরিকায় মুসলিম সমপ্রদায়কে দেখা হইতেছে ভয় ও সন্দেহের দৃষ্টিতে। ফ্রান্সসহ পাশ্চাত্যের যে দেশগুলির নেতারা এ্যাগ্রেসিভ বা উগ্র জাতীয়তাবাদের পক্ষে কথা বলিতেছেন, সেসব দেশে মুসলিম অভিবাসন-বিরোধিতা, সংখ্যালঘুর প্রতি অসহিষ্ণুতা, সামপ্রদায়িকতা ও বর্ণবাদ আবারও মাথাচাড়া দিয়া উঠার লক্ষণ স্পষ্ট হইতেছে। প্রশ্ন জাগে, ইতিহাসে ঘৃণিত বর্ণবাদ, সামপ্রদায়িক দাঙ্গা বা আগ্রাসন যুদ্ধের মতো কলঙ্কজনক অধ্যায়গুলি ফিরাইয়া আনিতে চায় কাহারা? মনে রাখা দরকার, সভ্যতার বিকাশে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় অভিভাসন এবং অভিবাসীদের সাংস্কৃতিক গ্রহণ-বর্জন স্বাভাবিক নিয়মেই ঘটিয়া চলিয়াছে। ভবিষ্যতেও ঘটিবে।
বহু সংস্কৃতিবাদ বা বহু মতের সমন্বয়েই গড়িয়া উঠে গণতান্ত্রিক সভ্য সমাজ। যে ইউরোপ গণতন্ত্র, পরমত সহিষ্ণুতা, ব্যক্তিস্বাধীনতা, ধর্মনিরপেক্ষতা ও মানবিধার রক্ষার প্রশ্নে সোচ্চার এবং গর্ব করিয়া থাকে, তাহারাই আজ যখন মানবাধিকার লংঘন বা মানবতা বিপর্যয়কারী পরিস্থিতি সৃষ্টি করিয়া চলিয়াছে, তখন শান্তিপ্রিয় বিশ্ববাসীর জন্য তাহা অবশ্যই উদ্বেগজনক।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।