দিগন্তের উপর মাথা তুলে দাড়াতে চাই
বেশ করেছি খোপা খুলেছি,
চুল ছুঁয়েছি-ছোঁবোই তো...
তোমার ঐ রেশমি কালো চুল দেখে
পাগল আমি হবই তো !!!
নারীর রেশমি কালো চুল দেখলে ছুঁয়ে দেয়া যাবে, খোপা খোলা যাবে এমন কি প্রকাশ্যে পাগল হওয়া ও দোষের কিছু নয়! এই হলো মিডিয়াতে নারী। আজ মিডিয়াতে নারীর অংশগ্রহণের মাত্রা দেখে আমরা তৃপ্তির ঢেকুর তুলছি। ভাবছি, এই বুঝি নারী এগিয়ে আসছে, তাদের অগ্রাধিকার প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে। মিডিয়ার মত গুরুত্বপূর্ন প্রতিষ্ঠানে নারীর আধিক্য দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়।
আমি বলব গর্ব করার কিছু নেই, গভীর ভাবে চিন্তা করলে বরং অনুতাপ’ই হবে।
নিজেকে ধন্য করতে যেয়ে হয়েছি পন্য। কারন এই মিডিয়াতে বেশির ভাগ নারীর স্থান কোথায় এবং নারীকে কি হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে এটি ভেবে দেখার বিষয়।
উপরের বিজ্ঞাপনটি কি অজান্তেই আজকের ইভটিজিংকারীদের মানসিক কাঠামোর ছাঁচ তৈরি করেনি? অবশ্যই করেছে। কারণ এই বিজ্ঞাপনের পর কম বেশি বন্ধু-বান্ধবীদের মধ্যে ঠাট্টা করে হলেও এর চর্চা দেখা গিয়েছে। বান্ধবীর গন্ডি পেরোতে খুব বেশি সময়ও লাগেনি।
আমি একটা বইয়ে পড়েছিলাম, ১৯৯৭ সালের ২৫ অক্টোবর ‘দৈনিক সংবাদ’ এর প্রথম পাতায় বড় করে বক্স আকারে ছাপা হয়েছিল ফ্যাশনশো’ তে ক্যাটওয়াকরত দুই সুন্দরী রমনীর ছবি। ছবিটি দুই কলামের এবং সাড়ে পাঁচ ইঞ্চি দৈর্ঘের। অপরদিকে রায়ের বাজারের বস্তিতে আগুন লেগে শতাধিক বাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মারা গেছে দুটি শিশু। মানুষ হাহাকার করছে। তাদের সারা জীবনে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যা কিছু তারা সঞ্চয় করেছে, সব কেড়ে নিয়েছে আগুন।
সেই খবরটি পত্রিকার পাতায় এসেছিলো সাধারন একাট দু’কলামের খবর হয়ে। তাও আবার সেই ফ্যাশন শো বিজ্ঞাপনের নিচে।
এমন হয় কিভাবে? উত্তরটি খুব সহজ, সবাইকে বলে না দিলেও চলে। পুজিবাদী ভাবাদর্শের পত্রিকা আজ নারীকে পন্য মনে করে। সেই পন্যকে বিক্রি করে তারা মুনাফা কামায়।
যত বেশি আকর্ষনীয় ভঙ্গিমায় তারা নারীর ছবি ছাপাতে পারে তত বেশি বিক্রি হয় পত্রিকা। বিজ্ঞাপনের মূল বিষয়ের চেয়ে নারীই প্রাধান্য পায় বেশি।
বিজ্ঞাপনে নারীকে যৌনবেদনাময়ী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। যেমন সিগারেট, মোটরসাইকেল, কিংবা সেভিং ক্রিমের এ্যাডে কেন নারীকে উপস্থাপন করতে হবে তা আমি বুঝে উঠতে পারিনা।
নারী এমনই এক শখের জিনিস, যখন যেমন ভাবে খুশি পাওয়া যায়।
আহ, কী মজা! তাই তো আরসি’র বিজ্ঞাপনে নায়ক বলছে-
আরসি’র মজা কত, তোমার মত
যখন যেমন চাই....।
নারী অবলা, দুর্বল। সে কর্মজীবি হতে পারে, হতে পারে দায়িত্বশীল কোনো ব্যক্তি, কিন্তু পথ চলতে কোনো পুরুষের সাহায্য নেয়াটা তার জন্য খুবই জরুরী। তাই অফিস-ফেরতা নারীকে আগ বাড়িয়ে তার সহকর্মী বলেÑ “আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিই” (লাইফবয় প্ল ¬াস সাবানের বিজ্ঞাপন)। তার মানে নারীরা এতই দুর্বল যে, বাড়ি ফিরে যেতে তাদের পুরুষের সাহায্য নিতে হয়।
টিভি’র বিজ্ঞাপন নারীকে অবলা ভাবে।
টেলিভিশনের বিজ্ঞাপন শেখায়Ñ পুরুষের দৃষ্টি আকর্ষণই নারীর একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান। কেননা, তাকে তো পুরুষের ওপরই নির্ভরশীল হতে হবে! তাই, পুরুষকে ভোলাতেই হবে। আর, এজন্য চাই ফর্সা, উজ্জ্বল ত্ব্কÑ এমন ত্বক যাতে ‘রফিক ভাই’দের নজরে পড়ে যায়। এমন ত্বকের জন্য চাই “ফেয়ার এন্ড লাভলী” ক্রীম যার ‘গুনে’ রং হবে ফর্সা, তখন ‘রফিক ভাই’য়ের অজানা থাকবে না ‘তিনি কী হারালেন’ (লক্ষ করুন ফেয়ার এন্ড লাভলীর বিজ্ঞাপন: রফিক ভাই জানলেন না তিনি কী হারালেন)।
আবার রাধুনী গুড়া মসলার এ্যাডে আমরা দেখেছি মা ছেলেকে বলছে,‘এবার সত্যিকারের একটা রাধুনী নিয়ে আয়’। নারী আসলেই সত্যিকারের রাধুনীÑ তবে মিডিয়ার কাছেই!
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, নারী বিষয়ক সংবাদের পরিমাণ পত্রিকাভেদে মোট সংবাদের শতকরা ৪ ভাগ থেকে ৭ ভাগের মধ্যে। যদিও বর্তমানে সাংবাদিকতায় মেয়েরা আসছে। তবু সেখানেও অনেক বৈষম্য। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদেরকে কোন গুরুত্বপূর্ন বিটে কাজ দেয়া হয় না, ধরে নেয়া হয় তারা কেবল নারী বা শিশু বিষয়ক রিপোর্টিং’র জন্য।
সংবাদপত্রে যে সামান্য সংখ্যক আইটেমে নারীর প্রসঙ্গ আসে তার একটা উলে¬খযোগ্য অংশ বিনোদনধর্মী। যে কারণে দেখা যায়, নায়িকা বা অভিনেত্রীদের পছন্দ-অপছন্দ, প্রেম-রোমান্স, দাম্পত্য জীবন, স্ক্যান্ডাল কিংবা ফ্যাশন সম্পর্কে পাঠক সংবাদপত্র থেকে যতটা জানতে পারে; কৃষি, অর্থনীতি কিংবা শিক্ষায় সফল নারীদের খবর ততটা জানতে পারে না।
আপনারা কখনো বিচ ভলিবল বা সিনক্রো-নাইজিং খেলেছেন? আপনারা সুইমিং বা লন টেনিস খেলতে আর কতটুকু অভ্যস্ত? কিন্তু পত্রিকায় খেলার পাতা খুল্লেই কুর্নিকোভা-উইলিয়ামস্ ভগ্নীদ্বয়ের খেলার বিভিন্ন কারিসূচীর ছবি দেখে নিশ্চয় অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। আর হালের টেনিস সেনসেশন সানিয়া মির্জার কথা আর কী বলবো। তার ছবিতে তো আজকাল ক্যাপশনও লাগে না!
সার দেশে এসএসসি পরীক্ষা, এইচএসসি পরীক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিপরীক্ষা, চিত্র প্রদর্শনী, বইমেলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান কেবল যেন নারীরাই অংশ নেই।
আর এসব ফিগারই কেবল পত্রিকার সৌন্দার্য বাড়ায়!
মিডিয়াতে নারীকে উপস্থাপনের ব্যাপারে চলচ্চিত্রের কথা আর কী বলব। আমাদের ঢালিউড চলচ্চিত্রে নারী তো খোলা বাজারের অথবা একটু কোয়ালিটি থাকলে মুদির দোকানের চাল-ডাল। এখানে আদর্শ নারী বলতে পতিপরায়না, নম্র, সকল দুঃখ-কষ্ট সহ্য করেও স্বামীর ঘরে পড়ে থাকা, স্বামীকে একমাত্র আরাধ্য ভাবাকে বুঝানো হয়। আর ভিলেন নারী মানে ছলনাময়ী, প্রতিশোধপরায়না, প্রতিবাদি, স্বামী বিদ্বেষী, মুখরা ইত্যাদি। এখানে নারীর মুখে সরাসরি উচ্চারিত হয়
“আমি তোমার বধূ,তুমি আমার স্বামী
খোদার পরে তোমায় আমি,বড় বলে জানি”
এটি কি নারী সম্পর্কিত চরম পুরুষতান্ত্রিক ও প্রথাগত ধারণার স্পষ্টতা নয়?
বাংলা চ্যানেলগুলোতে প্রচারিত নাটকগুলোর কথা ভেবে দেখেন।
টেলিভিশনে নায়িকা চরিত্র মানেই সে হবে, তরুণী, সুন্দরী, সুনিপুনা, স্বামী অন্তপ্রাণ। আমি বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব সারা যাকের’র একাট প্রবন্ধে দেখেছিলাম, তিনি উল্লেখ করেছেন “নারী চরিত্র নাট্যকাহিনীগুলোতে চা-বানানো, সাজগোজ, রূপচর্চা, বিছানা গোছানো, স্বামীর সাথে মান-অভিমানÑ এসব কাজ ছাড়া মেয়েদের তেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় দেখা যায় না। অথচ আজকের নারীরা পড়াশুনা করে, চাকুরী করে, ব্যবসায় করে, শ্রমিকের কাজ করে, এমনকি আন্দোলন-সংগ্রাম-বিক্ষোভ-বিদ্রোহেও অংশগ্রহণ করে। কিন্তু, এই দিকটি টেলিভিশনে প্রায়ই অপ্রদর্শিত থেকে যায়। ”
নায়িকাকে এমন কোন চরিত্রে আপনারা দেখেছেন? দেখলেও কয়টা নাটকে?
সাধারন মানুষের ধারনা যারা নারী স্টার তাদের জীবন যাপন আলাদা।
তাই তাদের প্রতি পাঠকের আকর্ষনের শেষ নেই। এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে পত্রিকা হাউজ গুলো তাদের হাত মচকা-পা মচকা খবর গুলোও অতিরঞ্চিত করে ছাপে। যেমন-প্রভা কেলেঙ্কারি, যে জীবনে কখনো পত্রিকা পড়েনি সেও বুঝি এ সময় একটা পত্রিকা কিনেছে। এমন উদাহ্রন আরো অজস্র আছে।
সিনেমার নায়িকা কেন প্রতিবাদি হবে না ? কেন সমাজসেবী হবে না? নায়িকা কেন গ্রামের কালো মেয়ে হবে না? এ কথার জবাবে পরিচালকরা হয়ত বলবেন ,“ওসব দর্শক খায় না, ব্যবসায় লস্ খাইতে হবে”
এই হলো আমাদের মিডিয়ার অবস্থা, সামাজিক প্রেক্ষাপট।
নারী সম্প্রদায় .....,আপনাদের বলছি, মিডিয়াতে আমাদের অংশ নিতে হবেই। নীতি নির্ধারনে এবং গুরুত্বপূর্ন সেক্টরে। কেননা আমাদের কথা আমাদের মুখেই বলতে হবে। ওরা আমাদের কী বুঝবে? ওরা তো ছেলে ভোলানো মোয়া দিয়ে আমাদের মিডিয়াতে নিয়ে যাচ্ছে পন্য করে। দু’দিন পর প্যকেটজাত করে হয়তো দোকানেও পাঠাবে!!! আমাদের অনেক আইডল আছেন, তাদের কথা ভেবে আমাদের সামনের পথ চলতে হবে।
বেগম রোকেয়া, শামসুন নাহার মাহমুদ, মোতাহেরা বেগম, সুফিয়া কামাল, রাবেয়া খাতুন ওদের কথা ভাবুন। আমরা যদি কলম চালাতে না পারি, ক্যমেরা ধরতে না জানি আমাদের চিত্র তুলে ধরবে কারা???
অনেকদিন ধরেই এটা নিয়ে একটা পোস্ট দেবার ইচ্ছা ছিল। সেদিন এ বিষয়ে আমাদের সাংবাদিকতা বিভাগের শাতিল সিরাজ স্যারের একটি লেকচার শুনে আরো অনুপ্রাণিত হলাম, যার অনেক তথ্যই এখানে সংযুক্ত হয়েছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।