অতি দক্ষ মিথ্যুক না হলে সত্যবাদিতা উৎকৃষ্ট পন্থা
দি ভারত বারাক নদীতে বাঁধ দেয়, সেটার নির্মাণ কাজে বাধা দেওয়ার ক্ষমতা কি বাংলাদেশের আছে? যৌথ নদী কমিশনে যদি কোনো সিদ্ধান্ত হয় এবং সেটা যদি ভারত মান্য না করে তাহলেও কি আমদের কিছু করার আছে? আমরা এখানে লাল-নীল-সবুজ-বেগুনী বিপ্লব করে ফেললে কি টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ বন্ধ করতে পারবে বাংলাদেশ?
নির্মাণ বন্ধ করবার ক্ষমতা সম্ভবত বাংলাদেশের নেই। তারা অনুনয় করতে পারে, আনুরোধ করতে পারে, কিন্তু ভারতের মর্জির বাইরে গিয়ে তারা বাঁধ নির্মান বন্ধ করতে ভারতকে বাধ্য করতে পারবে না।
ভারতও সম্ভবত বাংলাদেশের দুর্দশার কথা চিন্তা করে বাঁধ নির্মাণের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবে না। সুতরাং আমাদের কৌশলী হতে হবে, কুটনৈতিক তৎপরতা ছাড়া অন্য কোনো সহিংস উপায়ে বাঁধ নির্মাণ বন্ধের কোনো পরিকল্পনা যদি অতিবিপ্লবী কারো মাথায় থাকে সেটা নিয়ে আলোচনা হোক। টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ শুরু হলে আমরা কি ভারতীয় দুতাবাসে বোমা হামলা করবো? সেটা কি আমাদের জন্য ভালো কোনো সমাধাণ বয়ে নিয়ে আসবে?
টিপাইমুখ বাঁধের সাম্ভাব্য লাভ-ক্ষতি বিবেচনা করে অবশেষে ভারতের পারিবেশ অধিদপ্তর এই বাঁধ নির্মাণের অনুমতি দিয়েছে।
এই বাঁধ ও বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান নিজেদের ওয়েবসাইটে এই সংক্রান্ত রিপোর্টগুলো উন্মুক্ত করেছে। অনেকগুলোই তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়, এটার উপযোগিতা-প্রয়োজনীয়তা এবং লাভ-ক্ষতির খতিয়ান এবং আক্রান্ত পরিবারবর্গের পুনর্বাসন এবং তাদের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ও জীবিকাকে কিভাবে পুনর্গঠিত করা যায় এইসব বিষয়ে পরিকল্পনা এবং সে জন্য গৃহীত পদক্ষেপসমুহ কি হবে এসব নিয়ে বিস্তারিত বলা আছে এই রিপোর্টগুলোতে।
এই বাঁধ নির্মানের ফলে তলিয়ে যাবে সেখানে বসবাস করা ২১০০ জন মানুষের বসতি এবং তাদের চাষাবাদের জমি। আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যাও খুব বেশী নয়। সেসবের বিস্তারিত দেওয়া আছে রিপোর্টের এনেক্সে।
যেকোনো পরিকল্পনায় স্থানীয় জনসাধারণের উন্নয়ণ এবং তাদের দারিদ্রসীমার উপরে উঠিয়ে আনবার অঙ্গীকার থাকে, এখানেও আছে। তাদের নির্ধারিত ভুখন্ড বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় চাষাবাদ শেখানো হবে, শেখানো হবে পশুপালন, তাদের এ বাবদ আয়ের পরিমাণ ছাড়িয়ে যাবে ২ কোটি টাকারও বেশী।
বন্যা নিয়ন্ত্রিত হবে, কাচার এলাকা বন্যার পানিতে তলিয়ে যাবে না, এমন কি যদি স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার পুনরাবৃত্তিও হয় তবে এই নদীর মাত্র দুটি পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ০.৭৫ মিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হবে। কিন্তু যদি এই বাঁধ নির্মান না করা হয় তবে এমন বন্যায় সমস্ত কাচার অঞ্চল অন্তত ৯ দিন জলমগ্ন থাকবে।
সেখানে বাঁধ দেওয়ার ফলে যে লেক তৈরি হবে সেখানে ভ্রমনকারীদের আনন্দ উৎসব হবে এবং সেটার জন্যও মনিপুর অঞ্চল লাভবান হবে অর্থনৈতিক ভাবে।
লাভ ক্ষতির হিসাব কষলে একটা কথাই বলা যায় ভারত এই বাঁধ নির্মাণ থেকে পিছিয়ে আসবে না।
বাংলাদেশের সিলট অঞ্চল মরুভুমি হয়ে যেতে পারে, উদাহরণ সামনেই আছে, ফারাক্কায় পদ্মার উপরে বাঁধ এবং তিস্তা নদীর উপরে বাঁধ বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলকে প্রায় মরুভুমি বানিয়ে ফেলেছে, সেখানকার অন্তত ৩০টি নদী মরে গেছে। এখন বারাক নদীতে যদি বাঁধ নির্মিত হয় তবে বাংলাদেশের ৬ ভাগের ১ ভাগ অঞ্চল মরুভুমি হয়ে যেতে পারে।
এই নিয়ে আবেগের জোয়ার বইছে ব্লগে। মানুষ হঠাৎ করেই তীব্র দেশপ্রেম ও ভারত বিদ্বেষে আক্রান্ত হয়েছে।
ভারতবিদ্বেষের যথাপোযুক্ত কারণও বিদ্যমান, তাদের আচরণ এবং আধিপত্যবাদ নিয়ে কিংবা বাংলাদেশের মানুষের অর্থনৈতিক দাসত্বের অভ্যাসে তাদের বাণিজ্যিক উপনিবেশ হয়ে ওঠা বাংলাদেশে ভারতীয় মানুষদের গালাগালি করে সওয়াব কামানোর আগ্রহও অনেকের আছে।
কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবাদ প্রতিরোধ করে ভারতের কোন বালটা ছিঁড়তে পেরেছে? ভারত কেনো বাংলাদেশের কাতর অনুনয় শুনবে? টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ বাংলাদেশের মানুষ এই সীমান্তের ভেতরে বসে সভা-সেমিনার- মানববন্ধন- বিক্ষোভ-সিলেটের সীমান্তে গিয়ে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মানের জায়গায় দিকে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করে কিংবা থুতু ছিটিয়ে কিংবা অন্য যেকোনো রকম প্রতীকি প্রতিরোধ ও ঘৃণা বর্ষণ করে ঠেকাতে পারবে না।
এই বাস্তবতাবোধটুকু যখন মানুষের ভেতরে জাগ্রত হবে তখন হয়তো অন্য রকম কোনো একটা আন্দোলনের ভাবনা আসবে মানুষের ভেতরে। অবাস্তব স্বাপ্নিক আচরণ হয়তো মানসিক প্রশান্তি আনতে পারে,
সেইসব অবাস্তব স্বাপ্নিক আচরণে যেহেতু বাঁধ নির্মাণের বাস্তবতাটুকু এড়ানো যাবে না, চুড়ান্ত লক্ষ্য অর্জন যদি মূল মোক্ষ হয়, তবে কৌশলী হয়ে উঠবার বিকল্প নেই। বাঁধের কারণে বাংলাদেশের ক্ষয়ক্ষতির চিত্রায়ন রাজনৈতিক ভোটের বিবেচনায় ভালো একটা পন্থা।
জনসমর্থন আদায়ের পন্থা হতে পারে। এই বাঁধ নির্মীত না হলে কোনো সুফল পাওয়া যাবে এমনটা বাংলাদেশের মানুষ বলতে পারবে না , তারা নিজেরাই পাহাড় কাটছে, ভুমিধ্বসাচ্ছে, মানুষ এবং প্রকৃতির ক্ষতি করছে- এবং ভুমিক্ষয় কিংবা অন্যান্য কারণে নদী মজে যাওয়ার বিষয়টা বাংলাদেশের বাস্তবতা- সেই সচেতনতাটুকু গড়ে উঠে নি এখনও
আমরা প্রকৃতিকে পছন্দ করি না। এমন কি প্রকৃতিপ্রেমিক বলতে যা বুঝায় তার ১৫০০ মাইল আশেপাশে আমরা নেই। আমাদের মুখে বড় বড় কথার ফুলঝুড়ি আছে, হ্যান করেঙ্গা, ত্যান করেঙ্গা ফালতু প্যাঁচালের সময় আছে। কিন্তু যারা এইখানে বসে বড় বড় বুলি কপচাচ্ছে তাদের একজনও শেষ পর্যন্ত এই বাস্তবতাকে ঠেকাতে পারবে না।
আবাল কাঁচি আর ক্ষুর হাতে সারাদিন বাথরুমে বাল চাঁচলেও একটা বালও গজাতে পারবে না। এটা বাস্তবতা। ব্লগে ব্লগে বিপ্লব, বিদ্রোহ, পাঠচক্র, রিপোর্টের অনুবাদ করে কোনো লাভ দেখাতে পারবে না তারা।
নীপকো যে পুনর্বাসন প্রকল্প হাতে নিয়েছে, সেটা একেবারেই ভারতের মানুষদের জন্য। তাদের নাগরিকদের জন্য তারা প্রত্যাশা আর প্রতিশ্রুতির জোয়ার বইয়ে দিয়েছে।
মনিপুরের সবাই এই বাঁধের বিরোধী নয়, সুতরাং বাঁধের বিরোধী পক্ষে তেমন জনবল নেই। নৈতিক সমর্থন দিয়ে নর্মদা এড়ানো যায় নি, নর্মদার আশে পাশে আরও বাঁধ নির্মীত হয়েছে, সেখানে বিদ্যুত উৎপাদন প্রকল্পও শুরু হয়েছে। বলিউডের নায়ক নায়িকা আর অরুন্ধুতি রায় মেধা পাটেকারের সাথে ছবি তুলে হয়তো নিজেদের মানবিক চেহারাটা গণমাধ্যমে তুলে ধরতে পেরেছে কিন্তু ভারতকে ঠেকানো যায় নি।
এবার বাংলাদেশের নাটক-সিনেমার মানুষদের সামনে বড় একটা উপলক্ষ্য এসেছে, উপলক্ষ্য এসেছে সেইসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা-কর্মীদের সামনে নিজেদের জাতীয় পর্যায়ে বিবৃতি আর সংবাদপত্রে ছবি দিয়ে নিজেদের পরিচিত প্রতিবাদী হিসেবে তুলে ধরবার। মানবতাবাদী এবং স্বদেশপ্রেমী মুখোশ ধারণের সময় এসেছে, এবং তারা এই উৎসবে কিংবা মচ্ছবে অত্যুৎসাহেই সামিল হবে।
যেকোনো প্রতিবাদী অবস্থান গণগ্রহনযোগ্যতা বাড়িয়ে দিতে পারে, নিজের বিপননের জন্য এরচেয়ে ভালো কোনো অবস্থান আর নেই। টিপাইমুখের অর্থনৈতিক শক্তি এখানেও বিস্তৃত হবে। এখানের কিছু প্রতিবাদী মানুষের ভবিষ্যতের পূঁজি হবে এই আন্দোলন। তারা নিজেদের সেই পূঁজি অর্জন করুক, তাদের শুভকামনা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।