বাগজানা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কামাল স্যারের নাম সহসা কেহ মুখে আনিত না, দূর্ভাগ্যবশঃত কদাচ তাঁহার চেহারাখানা যদি কাহারো অন্তরে ভাসিয়া উঠিত তাহলে আতংকিত মুখখানা দেখিয়াই বলিয়া দেওয়া যাইত যে অতীতে সে স্যারের হাতে কতখানি ধোলাই সেবন করিয়াছে। প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের মুখে মাঝে মধ্যেই শোনা যাইত, “ আহ! কত পিটুনি খাইছিরে। ”
কামাল স্যারকে যতখানি পাষাণ মনে হইত তিনি আসলে ততখানি ছিলেন না। ছাত্রদের সহিত তিনি বন্ধুদের ন্যায় মিশিতেন এবং কখনো কখনো তাহাদের সহিত ক্রিকেট খেলিবার সময় যখন ব্যাট করিতেন তখন অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী বালকগণ তাঁহার গা লক্ষ্য করিয়া জোরে বল ছুঁড়িয়া মনে মনে উচ্চারণ অযোগ্য শব্দমালা আওড়াইত। কামাল স্যারও বিশেষ অদক্ষ ছিলেন না; তিনিও জোরে বল পিটাইয়া জবাব করিতেন।
বিরল সুযোগে কেহ কৃতকার্য হইলে তৎক্ষণাৎ সে স্যারের সমব্যাথি হইত কিন্তু খেলা সাঙ্গ হইলে যতদূর সম্ভব পরিচিত দুষ্ট বালকগণকে পাওয়া যাইত তাহাদের সহিত ইহা লইয়া হাসি তামাশার কোন কমতি হইত না।
স্যারও কম যান না, কেউ পড়াশুনায় গাফিলতি করিয়াছে কিংবা ভুলেও কিছু একটা ভুল করিয়াছে তো তার আর রক্ষা নাই, সঙ্গে সঙ্গে বেত আনিয়া ইহার উপযুক্ত একটা বিহিত করিতেন। মারের প্রাক্কালে মার্জনাভিক্ষায় সাহসি হইয়া কেহ যদি বলিত, “ স্যার এবারের মত মাফ করে দেন” তো স্যার তাহাকে জিজ্ঞাসা করিতেন ,“আমার কাছে কি মাফের বস্তা আছে হে ?”
মাফের তো বস্তা হয় না, তাই অভিযুক্ত যখনই বলিত, “ না স্যার” অমনি শুরু হইত ধুম ধাড়াক্কা কিল।
একবার এক ছাত্র পঞ্চম শ্রেণী পাশ করিয়া গন্ডিমুক্ত হইয়া কামাল স্যারের কাছে গেল দোয়া চাইতে। স্যার দোয়া করিলেন।
ছাত্র আবার বলিল , “ স্যার দুষ্টামি তো কম করি নাই, নিজগুণে অধমকে ক্ষমা করে দেবেন। ”
স্যার ফিক করিয়া হাসিয়া বলিলেন, “ মাফ কিরে, যখনকার পাওনা তখনই তো বুঝে দিয়েছি! স্যারের সময়ানুবর্তী কর্তব্যনিষ্ঠা দেখিয়া অনুতপ্ত ছাত্র হো হো করিয়া না হাসিয়া থাকিতে পারিল না।
কামাল স্যার যেমনি পিটাইতেন ঠিক তেমনি ভালোওবাসিতেন। তাঁহার মারের গুরুত্বের কথা প্রায় সকল অভিভাবকের মুখে মুখে শোনা যাইত, যাঁহারা ভাবী ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারের পিতা হইবার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন থাকিতেন তাঁহারা নিজ সন্তানদের আচ্ছামত শাসন করিবার জন্য স্যারের কাছে বিশেষ অনুরোধ করিতেন; বলিতেন ‘স্যার, ছাত্রের হাড়গুলো আমার আর গায়ের মাংস সব আপনার, যা ইচ্ছা হয় তাতে তাই করেন। ’ এত ক্ষমতা পাইয়াও স্যার কখনই ইচ্ছামত যখন তখন ছাত্রছাত্রীর মাংস ভূনা করিতেন না।
এই যে শাসন সোহাগ মিলাইয়া এতখানি হৃদয়রাজ্য দখল করিয়াছেন যিনি তাঁহার বিরুদ্ধেও আমার একখানা গুরুতর অভিযোগ আছে।
তৃতীয় শ্রেণী পাশ করিয়া সবেমাত্র চতুর্থ শ্রেণীতে প্রবেশ করিয়াছি। নূতন ক্লাসে নূতন অনুভূতি,পুরাতন দুষ্টামিগুলি হইতে আগের মত আর মজা পাইতেছলাম না। ইহার মাঝে পুরাতন একজনের সাথে বেশ ভাব হইয়া গেল। ইহার প্রধান শখ হইল রং বেরংয়ের বেলুন উড়ানো, আমিও তাহাতে সাগ্রহে যোগ দিলাম।
আমার দৈনিক বরাদ্দ ছিল এক টাকা। ইহার মধ্য হইতে বারো আনার ডালমুট খাইতাম আর চার আনা দিয়া একটা বেলুন কিনিতাম। সস্তা বেলুন কিনিতে কোন সমস্যা হইত না, কিন্তু তাহা ফুলাইতে গেলে বিশেষ অসুবিধা ঘটিত, কেমন জানি অপরিচিত একটা বোঁটকা গন্ধে নাক আপনা আপনিই বন্ধ হইয়া আসিত, কখনো কখনো বমি হইবারও উপক্রম হইত। আমরা বড় পাটকাঠি যোগাড় করিয়া নাসারন্ধ্র উপযুক্ত দুরত্বে রাখিয়া চার আনার বেলুন চতুর্গুণ উৎসাহে ফুলাইতাম।
দিন ভালই কাটিতেছিল।
একদিন হইল কি বন্ধুর নিকট পয়সা নাই, বেলুন কিনিতে আমি তাহাকে পয়সা ধার দিলাম, অতঃপর দুইজন মিলিয়া ঈষৎ গোলাপী রঙের বেলুন উড়াইতে লাগিলাম। চারিদিকে ছেলেমেয়েরা খেলা করিতেছে, আমরাও করিতেছি ; হঠাৎ লক্ষ্য করিলাম কামাল স্যার দূর হইতে ইশারায় বেলুন উড্ডীনকারী আমাদের দুইজনকে ডাকিতেছেন। আমরা ভাল করিয়াই জানিতাম, স্যারের নিজে মুখে আহ্বানের অর্থ কিছু একটা গোল বাধিয়াছে। খানিকটা ভয় পাইয়া দুরু দুরু বুকে নিকটবর্তী হইতেই তিনি বেলুন দুইখানা কাড়িয়া লইয়া দুই করতলের সাহায্যে ফটাস করিয়া ফাটিয়া দিলেন। আমরা অবাক হইয়া লক্ষ্য করিলাম যে, ক্রীড়াসামগ্রীদ্বয় বিনিষ্টকরণ সমাপ্ত করিয়াই কামাল স্যারের দুই হস্ত হাস্য করিতে করিতে আমাদের শ্রবণযন্ত্র অভিমুখে আসিতেছে।
পালাইবার চিন্তা করিবার পুর্বেই দুইজনেই ধৃত হইলাম। তাহার পরে উভয়ের কানের উপর যে কি পরিমান অত্যাচার সাধিত হইল তাহা ভাষায় প্রকাশ করিতে পারিবনা। কানের যদি মুখ থাকিত তবে স্যার নিশ্চিত অপমানিত হইতেন।
প্রায় মিনিটখানেক শাস্তিভোগের পর অব্যাহতি পাইলাম। জীবনে আর এই বেলুন লইয়া খেলা করিব না এমন শপথবাক্য পাঠ করিয়া দুই বন্ধু মুক্তি পাইলাম।
নিজের চার আনা ক্ষতি হইল, বন্ধুকে যে পয়সা ধার দিয়াছিলাম তাহা ফেরৎ পাইবার বেলুন ব্যাতীত আর অন্য কোন খাত ছিল না, সুতরাং তাহাও মার গেল। অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয়, এই যে এত কিছু ঘটিল তবুও নিজের অপরাধখানা ঠিক ধরিতে পারিলাম না।
বহুদিন পার হইয়াছে, একদিন হঠাৎ করিয়া আবিষ্কার করিলাম যে, যে বেলুন স্যারের রাগের উদ্রেগ করিয়াছে তাহা সাধারণ বেলুন নহে, শিশুক্রীড়ার সামগ্রীতো নয়ই বটে।
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে এই বেলুনের গুরুত্বের কথা জানিতে পারিয়াছি আরো অনেক পরে। সেদিন বুঝিয়াছি স্যার যদি উপযুক্ত সময়ে আমাদের না থামাইতেন তাহলে কি যে ক্ষতি হইত !
কান মলিয়াছে মলুক, ব্যাথা যাইবার সঙ্গে সঙ্গে রাগও পড়িয়াছে, কিন্তু আট আনা ক্ষতি করিবার জন্য স্যারকে মনে মনে কতবার দোষারোপ করিয়াছি ; কিন্তু যেদিন প্রকৃত ব্যাপারখানা বুঝিয়াছি সেদিন শুধু শোকই ভুলি নাই, হাসিয়া গড়াগড়িও খাইয়াছি।
এফ এইচ রিগ্যান
২৩.০৩.১১
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।