কত কিছু যে করতে চাই, তবুও কিছু করতে না পারার দায়ে মাথা খুঁটে মরি ।
Click This Link style='border: 1px solid #ccc;align:center;clear:both'; width=400px; />
আমি এত গুছিয়ে কিছু ভাবতে পারি না, গুছানো-অগুছানো বুঝি না। আমি শুধু ভাবি, গোগ্রাসে ভাবি। সারাদিন আকাশ পাতাল, চাঁদ তারা ভাবি। আমার ভাবনার কোন শেষ নেই।
আজকে বাস দিয়ে আসার সময় হঠাৎ করেই মনে হল, এই বাসটা বানিয়েছে কোথায় ? হয়ত চীনে বা ভারতে অথবা জাপানে। যেসব শ্রমিকরা বানালো তাদের জীবনটা আসলে কেমন? তারা তাদের জীবনে কতটুকু খুশি? আমাদের মত তারাও কী এত সব জটিলতায় ভোগে? আমাদের শ্রমিকদের মত ওরাও কী মিছিল মিটিং করে? অনাহারে ভুগে? আসলে পৃথিবীটা এত বেশি বড় লাগে এখন, নিজের গণ্ডির বাইরে সবাইকে যেন অবাস্তব লাগে। আছে বলে বিশ্বাস হতে চায় না। মনে হয় শুধু আমি বাস্তব, আর সবাই মিথ্যা।
“ আরে ভাই, জানালাটা বন্ধ করেন না।
ভিজে যাচ্ছি ত সবাই ”, কার যেন উঁচু গলার স্বরে বাস্তবে ফিরে আসলাম। খেয়াল করিনি, শার্ট ভিজে একসার। তুমুল বৃষ্টি নেমে গেছে আর আমার পাশের জানালাটাই শুধু আমি খোলা রেখেছি। সবার কথা ভেবে তাড়াতাড়ি বন্ধ করে দিলাম জানালাটা। বুঝি না বৃষ্টিতে ভেজা নিয়ে সবাই এমন করে কেন ! আমার ত ভিজতে ভালই লাগে, তাছাড়া বাসাতে যেয়ে এমনিই ত গোসল করতাম।
জানালার কাঁচের বাইরে দিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরে পড়ছে পানি। এলোমেলো ধারায় গড়িয়ে পড়ছে। এর মাঝে দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছি আমি। প্রায় সন্ধ্যা। ঘন মেঘ জমেছে আকাশে।
আইডিবি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে,পেছনে মেঘের জঙ্গল। আর, রাস্তার এপাশে খোলা জায়গা। বিস্তৃত আকাশ। ব্যস্ত শহরের ঘর বাড়ির এমন ভীড়ের মাঝেও বড়সড় একটা জায়গা রয়েছে এটা, একদম খালি। ভিতরে অনেক বড় বড় গাছ।
সিগনালে গাড়ি অপেক্ষা করছে। বৃষ্টির মধ্যেও ভিক্ষুকদের হাত পাতা। বন্ধ জানালার এপাশে এসে গ্লাসে টোকা মারা। অতঃপর, এত বৃষ্টি মাথায় নিয়ে এসে খালি হাতে ফেরত যাওয়া। এবার যাবে হয়ত কোন প্রাইভেট কারের সামনে।
কতক্ষণ ধরে ফোনে খিল খিক করে হেসেই যাচ্ছে মেয়েটা। এত হাসি কী এই মেয়ের? আমি মোটামুটি নিশ্চিত, সেলফোনের অপরপ্রান্তের ছেলেটা খুব একটা হাসির কথা হয়ত বলছে না, মেয়েটার এই হাসি কৌতুকের না, খুশির। কাউকে প্রেম করতে দেখলে আমার বড় ভাল লাগে। মনে হয় ওরা কত খুশিতেই না আছে। নিজেদের মাঝেই নিজেরা ডুবে আছে।
আবার, খুব সুন্দরী মেয়েদের প্রেম করতে দেখলে রাগও লাগে। মনে হয়, সবাই এভাবে প্রেম করলে পরে আমার জন্য থাকবে কে? নিজের জন্য কারও থাকার কথা মনে হতে, ইচ্ছা করল সাদিয়াকে একটা কল দিতে। কিন্তু, চাইলেই সাদিয়ার সাথে কথা বলা যায় না। তাকে প্রথমে মিসকল দিতে হবে। সে বারান্দা বা নিজের রুমে আসবে, পরে কল ব্যাক করবে।
বাসার কারও সামনে কথা বলার সাহস পায় না ত। এখন অবশ্য তার ছোট খালা নাকি আসছে, তার ঘরেই থাকে। এটা একটা সমস্যা। তবুও সেলফোন বের করে ওকে একটা বড় করে মিসকল দিলাম, কল দিতে বলে একটা ম্যাসেজও পাঠালাম, “ সেলফোনে টাকা নাই। সুতরাং,মিসকল ধরবা না।
যেভাবে পার দ্রুত কল ব্যাক কর। ”
সিগনালে বাস ছেড়ে দিল। বাস আবার আগানো শুরু করল। শেষবারের মতন পপকর্নওয়ালাদের ডাকাডাকি। ঝুপ করে অন্ধকার পরে গেলে আর বেঁচা বিক্রী হবে না।
তখন ওরা হাওয়াই মিঠাই নিয়ে ঘুরবে। পাশে বসা ভদ্রলোক কার সাথে যেন সেলফোনে কথা বলছে। কালো চেকশার্ট আর কালো ফরমাল প্যান্টস। কী সব জমি জমা বিক্রী নিয়ে কে ভাঁওতাবাজি করেছে তার বৃত্তান্ত। মানুষ পারেও।
এত হাজার সমস্যা এদের। প্রাচীন যুগ থেকে মানুষ এখন কত জটিল হয়ে গেছে।
সামনে আবারও একটা ট্রাফিক জাম পড়বে শ্যাওড়াপাড়ায়। মেইনরোড, অথচ একটু বৃষ্টি নামতে না নামতেই পানি জমে। রাস্তার পিচ্চিগুলার তখন অনেক মজা, লাফালাফি আর ঝাপাঝাপি।
সেই তুলনায় ফ্লাট নামের খাঁচায় থাকা ভদ্র পোশাক পরা বাচ্চাগুলোর জীবনে মজার পরিমাণ অনেক কম। একই নোট পড়ে পিছনের রোলের ছেলেটা কেন এক নাম্বার বেশি পেল, বাচ্চা আর বাচ্চার মায়ের এই চিন্তা সারাদিন। ধূর, কী থেকে কীসে এসে পড়লাম।
সেলফোনটা বেজে উঠে। সাদিয়ার কল।
কীরে সাথি, কেমন আছিস?
হা হা হা। হমমম, আজকে তাহলে আমি সাথি? তোমার ছোট খালা কী সামনে?
না।
তাহলে আন্টি সামনে?
হমমম।
এখন কথা বলবা নাকি পরে?
এখন আমি খাতা নিয়ে বসছি, তুই বল আমি লাইন দাগাই।
হা হা হা, ভাল ভাল।
আন্টি শুনে ভাবতেছে মেয়ে কত পড়াশুনা করে। বাসায় আসছ কখন?
দুটায়। এই শুন, কথা আছে।
বল।
এখন না, এভাবে বলা যাবে না।
বাসায় যেয়ে ঘুমিও না, আরও কিছুক্ষণ পরে আমি কল দিব।
এখন হঠাৎ ‘তুমি’ ? আন্টি কী চলে গেছে?
হমমম। কে যেন নক করছে দরজায়। আব্বু বোধ হয়। শুন,তুমি ঘুমিও না কিন্তু, আমি কল দিব।
আচ্ছা, বাই।
বাই।
অতক্ষণ ঘুম লাগে নি। না ঘুমানোর কথা শুনে এখন ঘুম লাগছে খুব। ক্লান্তিতে শরীরটা ভেঙ্গে আসতে চাচ্ছে।
বাস থেকে নেমে আরো কিছুদূর হাঁটতে হবে। বিশাল একটা মাঠ পেরুতে হবে। যেভাবে বৃষ্টি পড়তেছে, এই কাঁদার মধ্যে ত অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে।
যা আন্দাজ করেছিলাম, শ্যাওড়াপাড়ার ট্রাফিক জামে আবার আটকা। আরে, আজকে বাসায় যাব কখন! এত দেরী লাগছে কেন আজকে? হঠাৎ খেয়াল করি, জানালার পাশেই একটা রিকশায় একটা জুটি হাসছে খুব।
ওদের দিকে একটু মনোযোগ দিয়ে তাকালাম। নাহ, যেমন ভেবেছিলাম তেমন না। ভার্সিটিতে পড়া উচ্ছল তরুণ-তরুণী না, হতে গার্মেন্টসে কাজ করে এরা। বৃষ্টি বলে রিকশা নিয়েছে, এটাও এদের কাছে হয়ত বিলাসিতা। দুজন তাকিয়ে আছে একে অপরের দিকে।
মেয়েটার তাকানো দেখে মনে হল, নিজের জীবনের প্রতি এই মুহূর্তে সে খুব কৃতজ্ঞ। পাশে বসা ছেলেটা তার কাছে অনেক কিছু। এই তো প্রেম। অনুভূতি। পাশের জনকে নিয়ে যা ইচ্ছা তাই ভাবা।
ছেলেটা আমার দিকে পেছন ফিরে আছে। ওকে দেখছি না। এদের ভবিষ্যত কী? জানি না কী হবে এদের। হয়ত দুদিন পরেই মেয়েটার উপর লোভ পড়বে তার কোন উর্ধ্বতনের। ঘরে স্বাস্থবতী ফর্সা স্ত্রী রেখে শীর্ণ আর ঘামে ভেজা গার্মেন্টসের মেয়েদের দিকে নজর দেবে সে।
নারীত্বের চিনহ এসব মেয়েদের শরীরে এখনও অস্পষ্ট। এদেরকেই জোর করবে সে। এই মেয়েটার কপালে কি এমন কিছু আছে? অথবা এই ছেলেটাই ওকে ছেড়ে চলে যাবে অন্য কারও কাছে। অথবা হয়ত এই মেয়েটাই টাকার বিনিময়ে উর্ধ্বতনের চাহিদায় সাড়া দিয়ে আসে মাঝে মাঝে। হয়ত কিছুই না, শেষে সব কিছুই সুখের হবে।
আমি ভাবি একটা মানুষের জীবনে কত স্বপ্ন, কত ভাবনা। এই যে এরা রিকশায় করে বাসায় যাচ্ছে, তার জন্য হয়ত আজকে রাতে নিজেদেরই গালি দিবে যে, এত খরচের কী ছিল! যদি শুনি এক্সিডেন্টে একজন মারা গেল, মিছিলে একজন মারা গেল, যুদ্ধে পঞ্চাশজন মারা গেল মনে হয় কমই ত মরল। অন্যবার ত আরও বেশি মরে। মনে হয় না, আসলে একজনের মৃত্যুই অনেক বড় কিছু। একটা মৃত্যু মানে একটা সত্ত্বার বিনাশ।
এই সত্ত্বাটা মানে কী সহজে বুঝা যায় না, বুঝি তখন যখন ভাবি ওই একজন যে এখন লাশ, সে যদি আমি হতাম? ওই অমুক তোমার প্রিয় দল? ওই দলের অমুক নেতা ত অমুককে মারছে, তমুককে মারছে। কত সহজেই উত্তর আসে, “এই ত নেতা টেতা হতে হলে একটু আধটু মারামারি করা লাগবেই। “ মৃত্যুর কথা বলা কত সহজ। হঠাৎ মনে হয়, যাদের মারছে, তাদের কেউ যদি আমি হতাম? লঞ্চডুবিতে একশজনের মৃত্যু শুনে মনে মনে গালি দেই লঞ্চের মালিকদের। টিভি চ্যানেলের হট টপিক।
প্রচণ্ড রাগ হয় লঞ্চ মালিকদের প্রতি, মৃতদের জন্য দুঃখ হয় সামান্য। খেয়াল আসে না, সেই একশজনের একজন আমি হলে আমার কাছে ব্যাপারটা কী দাড়াত! আমি না হই, আমার খুব কাছে কেউ যদি হয়! অথবা আমার পরিবারের কাছে! প্রতিদিন খবরের কাগজে এত মানুষের মৃত্যু আসলে কত মানুষের কান্না। আমরা কতটুকু অনুভব করি !
ইদানীং মাঝে মাঝে একই কথা মনে মনে বার বার বলতে থাকি। বার বার তারপর আবার বলি। কী যেন হইছে! ঝাঁকুনিতে সতবিৎ ফেরে।
বাস থেমেছে। এবার নামতে হবে।
-------
এই সময়টা সোলায়মান সাহেবের খুব ভাল লাগে। প্রতি শুক্রবারের সকালটা। তার অফিস নেই।
মেয়ের কলেজ আর ছেলের স্কুল কোনটাই নেই। সবাই একসাথে সকালের নাস্তা খায়। আর, উনি খবরের কাগজের গুরুত্বপূর্ণ হেডিং সবাইকে পড়ে পড়ে শোনান,“সাদিয়া তুমি কিন্তু এখন বড় হয়ে গেছ। কলেজ শেষ করে এবার কিন্তু ভার্সিটিতে ভর্তি হবা। রাস্তায় এখন খুব সাবধানে চলবা।
আর, ঝড় বৃষ্টিতে বের হওয়া একদম বন্ধ। কালকেও মিরপুরে এক ছেলে সন্ধ্যার দিকে খালি মাঠ পার হতে যেয়ে বজ্রপাতে মারা গেছে। খুব সাবধান। ” সোলায়মান সাহেব চায়ের কাপে একটা চুমুক দিলেন।
সাদিয়া ভাল মত শোনে না।
ওর এখন মন ভাল না। ওর প্রিয় একজনকে ও কালকে থেকে কল দিয়ে যাচ্ছে একটু পর পর। কিন্তু তার সেলফোন বন্ধ। কোন না কোন ছেলে বজ্রপাতে মারা গেছে সেটা শোনার সময় নেই তার।
সোলায়মান সাহেব কাপের বাকি চা টুকু এক চুমুকে শেষ করে রান্নাঘরে থাকা সাদিয়ার মাকে লক্ষ্য করে হাঁক দিলেন, “ এই শুনছ, সামনের রোযায় জিনিসপত্রের দাম নাকি আরও বাড়বে! আর চায়ের কাপটা নিয়ে যাও।
” সাদিয়াই উঠে আসে চায়ের কাপটা নিয়ে যেতে।
বজ্রপাতে অচেনা কোন ছেলের মৃত্যুর খবর মনের মধ্যে চায়ের কাপে এক চুমুকের চেয়ে বেশি সময় স্থায়ী হবার কোন কারণ নেই।
© আকাশ_পাগলা
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।