সঙ্গে সাহিত্যের সুবাস ... শাহবাগ আন্দোলন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি করেছে। কিন্তু সেটাই সব বা একমাত্র বিষয় নয়। রক্তস্নাত বাংলার কিছু মানুষ এই জাতির জন্মকে অস্বীকার করতে চেয়েছে, হত্যা-লুণ্ঠন-ধর্ষণ যাবতীয় যুদ্ধাপরাধ করেছে। তাদের বিচার হচ্ছে চার দশক পরে। এই বিচারে জনমতের প্রতিফলন হয়নি, হতে হবে Ñ আন্দোলনের এই-ই বহিরঙ্গ।
কিন্তু বাংলা বসন্তের অন্তরঙ্গে আছে চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিকেই প্রত্যাখ্যানের প্রস্তাবনা। পশ্চাৎপদ-প্রগতিবিরুদ্ধ রাজনীতি এদেশে থাকবে কি থাকবে না, তারও হিসেব সম্পন্ন করতে চায় শাহবাগ আন্দোলন। বড় দুই দলের পুনরাবৃত্ত হ্যাংলামো, এই আন্দোলন নাকচ করে। কিন্তু এই জন-আন্দোলন যাদের বিরুদ্ধে, সেই জামাত-শিবির ও তার প্রতি সহানুভূতিশীল চক্র এই অভূতপূর্ব আন্দোলনে কালিমা লেপন করতে চেয়েছে। প্রপাগান্ডার আশ্রয় নিয়ে তারা শাহবাগকে কতকগুলো স্টিগমায় বেঁধে ফেলতে চেয়েছে Ñ ১. শাহবাগ সরকারের সাজানো নাটক ২. এই আন্দোলন নাস্তিকদের আন্দোলন ৩. এখানে যে তরুণেরা গিয়েছে তারা মাদকসেবী আর যে তরুণীরা গিয়েছে তারা মন্দ নারী।
এই কালিমা লেপন চলেছে ফেসবুকে-ব্লগে, রাজনীতিবিদদের বক্তব্যে এবং ‘আমার দেশ’-এর মতো পত্রিকার পাতায়।
শাহবাগ আন্দোলন মোটেই সরকারের সাজানো নাটক নয়। মনে রাখতে হবে ৫ ফেব্র“য়ারির বিকেলে যেই জনা পঞ্চাশেক মানুষ জাদুঘরের সামনে মানববন্ধনে দাঁড়িয়েছিল, তারা সরকারের বিরুদ্ধেই দাঁড়িয়েছিল। তারা মনে করেছিল, সরকার ও জামায়াতের মধ্যে সম্ভবত একটা আঁতাত হয়েছে, নইলে ছয়টি মামলার পাঁচটি প্রমাণ হলেও ফাঁসি না হয়ে যাবজ্জীবন কেমন করে রায় হয়? অন্য সবার মতো সরকারও হতভম্ব হয়ে স্বতঃস্ফূর্ত জনসমাবেশের প্রকৃতি বুঝতে প্রথম দু’তিনদিন পার করে দিয়েছে। সরকারের সাজানো নাটক হলে আওয়ামী লীগ নেতা হানিফকে প্রজন্ম চত্বরে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না।
এরপর সরকার বুঝতে পেরেছে এই আন্দোলনকে সমর্থন দেয়া দরকার, আখেরে তাদেরই লাভ। ফলে প্রকাশ্য না হলেও, অপ্রকাশ্য সমর্থন সরকার প্রথম দুই সপ্তাহ দিয়ে গিয়েছে। কিন্তু ২১ তারিখের মহাসমাবেশের পর থেকে ছাত্রলীগ সামনের সারিতে চলে আসে, এবং সরকারপক্ষের অংশগ্রহণ প্রকাশ্য হয়ে ওঠে।
ব্লগার রাজীবকে হত্যার পর ‘ব্লগারদের আন্দোলন’রূপে পরিচিত শাহবাগ যেক্ষেত্রে আরও ফুঁসে ওঠার কথা, রাজীবের নিজস্ব/ফেইক নানান পোস্টকে সামনে হাজির করে কেবল তার অপমৃত্যুর অবমাননাই করা হয়নি, পুরো আন্দোলনই নাস্তিকদের আন্দোলন বলে চালানোর চেষ্টা করা হয়েছে। ধর্মাশ্রয়ী সেই প্রপাগান্ডা বেশ কল্কেও পায়।
কিন্তু যদি ধরেও নেই, রাজীব নাস্তিক ছিলেন, দায়িত্বজ্ঞানহীন অনেক পোস্টের স্রষ্টা তিনি, কিন্তু তারপরও তাকে হত্যা যেমন বৈধ হয়না, তেমনি পুরো আন্দোলন নাস্তিকদের হয়ে যায়না। নাস্তিকরা সবকালেই সব সমাজে ছিল, কিন্তু তাদের সংখ্যা সবসময়ই কম থাকে। ফলে শাহবাগে আন্দোলনরত কেউ কেউ হয়তো নাস্তিক ছিল, কিন্তু তার শতকরা হার একের চেয়েও কম হবে।
অন্যদিকে শাহবাগের তরুণেরা মাদকসেবী, বা সুনির্দিষ্টভাবে গাঁজাসেবী, এই কলঙ্কলেপনেরও চেষ্টা করা হয়েছে। এই সংখ্যাটাও নাস্তিকদের মতোই হবে।
ওপরের সবগুলো প্রপাগান্ডার অতি সামান্য হলেও ভিত্তি আছে। কিন্তু শাহবাগের নারীরা মন্দ নারী, এই অভিযোগের ভিত্তি একেবারে শূন্য শতাংশ। লক্ষ করার বিষয় হলো শাহবাগ আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো। তাদের দিক থেকে এই অংশগ্রহণের ভিন্ন দিকমাত্রা রয়েছে। জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নারীপ্রগতিবিরুদ্ধ।
আজ যে নারীর পরনের জিন্স তার পদক্ষেপে দৃঢ়তা এনেছে, জামায়াত-শিবির ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে প্রথম আঘাত আসবে তার পোশাকে। ফলে লাকী-মুক্তা-সামিয়ারা এই আন্দোলনের অন্যতম অংশ। নারীকণ্ঠ শাহবাগের স্লোগানের নেতৃত্বে, নারীর এই স্লোগানকণ্ঠ দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। নারীর অগ্রযাত্রা পশ্চাৎপদতা ও পিতৃতন্ত্রকে বিপর্যস্ত করে। শাহবাগের নারীরা পতিতা, এই প্রপাগান্ডায় সত্যের লেশমাত্র নাই।
শাহবাগের প্রজন্ম চত্বর বলছে ‘সৎ লোকের শাসন’ নয়, আগামী বাংলাদেশের জন্য অপেক্ষাকৃত সৎ রাজনীতি অপেক্ষা করছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।