সৃস্টির সেরা মানুষ তার অতি ক্ষুদ্র জ্ঞানের সীমাবদ্ধতায় এ সুবিশাল মহাবিশ্বের অসীম অজানার কণাতম রহস্যও ভেদ করতে না পারার চরম ব্যর্থতায় স্রস্টাকেই অস্বীকার করার স্পর্ধা দেখায়!!!
বিয়ের গল্প
----- গুলনাহার ইসলাম মনু
আর কয়েকদিন পরই সিনথিয়ার বিয়ে। বর ওর পছন্দেরই। চার-পাঁচ বছর একসঙ্গে পড়াশোনা করে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি থেকে দুজনই ইন্ঞ্জিনিয়ারিং পাস করে বেরিয়েছে। ফ্যামিলি ভালো, ছেলেও ভালো চাকরী করে। কিন্তু সিনথিয়ার মন খচখচ করে।
আজকাল যে হারে বন্ধুবান্ধবের মধ্যেও ডিভোর্স হচ্ছে! ছেলেরা কি বিয়ে হলে পাল্টে যায়!
সিনথিয়া পায়চারি করছিল বারান্দায়। হঠাৎ কানে এলো দাদু বলছেন দিদাকে, তোমারকি মাথা ব্যাথা করছে এখনো, দাড়াও ভিক্সটা নিয়ে আসি,কপালটা টিপে দিচ্ছি। দিদা সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেন, না না, লাগবেনা। আমি ঠিকই আছি, তুমি একটু ঘুমাওতো! না ঘুমালে তোমার প্রেশারটা বেড়ে যাবে!
সিনথয়ার ঠোঁটে হাসি ঝিলিক দিল। ভাবলো, এই বুড়োবুড়ির এতো প্রেম এখনো! সারাক্ষণ দুজনা গল্প করছেন।
কই, ও মনে করতে পারেনা কখনো তাদের ঝগড়া করতে দেখেছে কিনা! তারা হয়তো জানেওনা ভালোবাসা দিবসের কথা। কিন্তু বাপিতো দাদুর মতো হননি। অল্পতেই মায়ের সঙ্গে যাতা ব্যবহার করেন। কেন একই পরিবারে দুই রূপ হবে? নাহ্ ! আজ দাদু-দিদার সঙ্গে গল্প করে জানবে তাদের ভালোবাসার রহস্য কি?
ও আস্তে করে ভেজানো দরজা ঠেলে ঢুকলো।
তারা অবাক হয়ে থাকলেন, যে নাতনী কখনো কাছে পায়নি, সে আজ নিজেই এসেছে!
দাদু খুব খুশী হয়ে বললেন, এসো আপু, এসো।
এ সময়ে বুড়োবুড়ির সান্নিধ্য ভালোলো লাগবে তোমার!
সিনথিয়া হাসলো, ভালো লাগবে বলেইতো এলাম। তোমাদের বিয়ের গল্প শুনতে এলাম।
ওমা! দাদী গালে হাত দিলেন। আমাদের আবার গল্প কি! আমরা কি আগে দেখাশোনা করেছি তোমাদের মতো! বিয়ে হবে, কাঁদতে কাঁদতে পুতুল খেলা, রান্নাবাটি খেলা ছেড়ে পালকিতে উঠেছি, ব্যাস শেষ।
উহু! ওরকম অল্প কথায় হবেনা।
আচ্ছা দাদু, আগে তুমিই বলো তোমার বিয়ের গল্প।
ঠিক আছে। বলছি। আমি তখন বিশ বছরের টগবগে যুবক। সদ্য ম্যাট্রিক পাস করে পোস্ট অফিসে কেরানীর চাকরী পেয়েছি।
আমার মায়ের খুব শখ হলো আমাকে বিয়ে করাবেন। পাত্রী তার সইয়ের মেয়ে জরিনা খাতুন। একদিন বাবা-মা গিয়ে গলার হার দিয়ে কথা পাকা করে আসেন।
কিন্তু দাদু,তুমি এত অল্প বয়সে রাজী হয়ে গেলে!
আরে তখনতো সতের-আঠারো বছরের ছেলেও বিয়ে করতো। আমিতো মনে মনে খুব খুশী হয়েছিলাম।
সইয়ের মেয়ে যখন, তুমিতো আগেই দেখেছিলে, তাইনা?
আরে না। তখন কি আর মায়ের আঁচল ধরে বেড়াতে যেতাম? বিয়ে ঠিক হওয়ার পর তোমার দিদাকে দেখার জন্য পাগল হয়ে উঠেছিলাম।
যাহ্, বেশরম! দাদী এই বয়সেও লজ্জা পেলেন।
সিনথিয়া উৎসাহ দিল। বলো বলো দাদু, তারপর কি হলো?
জানতাম তোমার দিদা বান্ধবীদের নিয়ে রান্নাবাটি খেলে।
তখন বয়স ছিল মোটে নয়-দশ বছর। বন্ধু কলিমুল্লাহকে নিয়ে বের হলাম দেখার জন্য। দেখা পেয়েও যাই। দেখি লাল একটা শাড়ি গাছকোমর করে পেঁচিয়ে চুলা্য ফুঁ দিচ্ছে। চোখ-মুখ লাল হয়ে গিয়েছে।
পুতুলের মতো মেয়েটাকে দেখে কিযে ভালো লাগলো! ঝোপের আড়ালে ছিলাম। কখন যে সামনে এসে গিয়েছি তা খেয়াল ছিলনা।
হঠাৎ ওর সই রহিমুন মেয়েটা চিৎকার করে উঠলো দেখ দেখ, জরিনার সোয়ামী আইছে জরিনারে দেখতে।
সঙ্গে সঙ্গে ও মাথায় ঘোমটা দিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে গেল। ইচ্ছা হচ্ছিল রহিমুনরে একটা থাপ্পড় দেই।
দিদা ফোকলা মুখে বাচ্চা মেয়ের মতো হেসে উঠলেন দাদুর দিকে তাকিয়ে।
এবার বলো দিদা তোমার কথা। সিনথিয়া অনুরোধ করলো।
আমি কি বলবো! আমারতো সেদিনের পর থেকে বাইরে বের হওয়াও বন্ধ হয়ে গেল। খেলতাম যা উঠানের মধ্যেই।
না না, এভাবে বললে হবেনা। আরো বিস্তারিত শুনতে চাই। সিনথিয়া আবদার করলো।
দিদা এবার নড়েচড়ে বসলেন।
তাহলে শোন, তখনতো এরকম ক্লাব, কমিউনিটি সেন্টার ছিলনা।
বাড়িতেই বিয়ে হতো। বিরাট উঠানে শামিয়ানা টানানো। এক পাশে বড় বড় গর্ত করে ইট দিয়ে চুলা বানানো। ওখানে রাত-দিন রান্না হচ্ছিল। অনেক আত্মীয়স্বজন এসেছিলেন।
তারা থাকবে সপ্তাহখানেক, কি দশদিন।
একপাশে একটা পাটি বিছিয়ে গায়েহলুদের আয়োজন করা হয়েছিল।
আমাকে মুরুব্বীরা হলুদ শাড়ি পরিয়ে বসিয়ে রেখেছিলেন। কতো কুটুম্ব এসেছে। আমার ইচ্ছে হচ্ছিল সবাইকে ঘুরে ঘুরে দেখি।
কিন্তু গায়েহলুদের পাটি থেকে নাকি উঠতে নেই। তাই কেউ উঠতে দিচ্ছিলেন না। আমার সইরা কতো মজা করছিল!
আমাকে বসিয়ে রেখে সবার উপদেশ শুরু হয়েছিল। এই করতে পারবেনা,ওই করতে পারবেনা। হাসবেনা জোরে জোরে, লোকে বেহায়া বলবে।
স্বামী বাইরে থেকে এলে পাখায় বাতাস করবে। হাত-মুখ ধোয়ার জন্য পানি এগিয়ে দেবে। যতক্ষণ না ঘুমায় ততোক্ষণ পা টিপে দিতে হবে। উপদেশের ঠ্যালায় তখন আমার চোখে পানি এসে যাচ্ছিল। মনে হলো জামাইবাড়ি না, যমের বাড়ি যাচ্ছি।
স্বামীকে চোখে না দেখই ভয় পেতে শুরু করলাম।
তারপরদিন আবার শুরু হলো পাঁচজনে মিলে গোঁসল করানো। বালিশের নিচে লোহা। কোমরে লোহা দিয়ে ঘুমানো।
সিনথিয়া প্রশ্ন করলো, লোহা কেন?
যাতে বদনজর না লাগে।
এ সময় জ্বীন-পরীরা নাকি বদনজর দেয়!
সিনথিয়া অনেক কষ্টে হাসি চাপা দেয়, বুঝতে পারলো দিদা আর বলবেননা কিছু।
রাতে আমাকে সুন্দর করে খোপা বেধেঁ শাড়ি-গয়না পড়িয়ে দেয়া হলো। মাথার কাপড় পড়ে যাচ্ছিল বলে ধমকও খেলাম। আমার স্বামীর লোকজন মাটির পাতিলে অনেক মিঠাই-মন্ডা নিয়ে বাজি পোড়াতে পোড়াতে এলো। সবাই মিলে আমাকে এতো উপদেশ দিচ্ছিলো, আমি ভয়ে কান্না শুরু করে দিলাম।
আমাকে থামাবে কি,বরং মনে হলো সবাই হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো। কারণ স্বশুরবাড়ী গেলে যে কাদঁতে হয়!
তারপর দাদু তুমি কি করলে?
ওই ছোট্ট পুতুলটা তো কাদঁতে কাদঁতে পালকির মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। আমারও এমন মায়া হতে লাগলো যে, আর জাগালামনা।
আচ্ছা দাদু, তোমাদেরতো কোনদিন ঝগড়া হতেও দেখলামনা। অথচ দেখো, বাপি-মায়ের কোন অভাব নেই।
তবুও তারা অল্পতেই ঝগড়া, চেচাঁমেচি শুরু করেন।
দিদা হাসলেন। আসলে আপু, আমরা অশিক্ষিত মানুষ! বাবা-মা শিখিয়েছিলেন স্বামীকে সম্মান করতে হয় আর সম্মান করতে গিয়ে ভালোওবাসলাম। এখন শুধু মনে হয়,ওর আগে আমি চলে গেলে ও তো পাগল হয়ে যাবে!
দাদু বললেন আমার বাবা-মা বলতেন, বৌকে ইজ্জত দিতে হয়। ইজ্জত দিতে গিয়ে পুতুলটাকে এতো ভালোবাসলাম যে, ওকে ছাড়া আমি ভাবতেও পারিনা কিছু।
আমি ছাড়া ও কিভাবে থাকবে সেটাই ভাবি। আমরা দুজনাই সুখ-দুঃখগুলো ভাগ করে নিয়েছি। কিন্তু মুখে কখনো বলিনি ভালোবাসি কথাটা।
সিনথিয়া ভাবলো সম্পূর্ণ দুটো অচেনা মানুষ একে অন্যকে কতো ভালোবাসে। আর ওর এতো দিনকার চেনাজানা ছেলেটা ওকে ভালোবাসবেনা?
দাদু-দিদাকে বললো, তোমরা দোয়া করো যেন তোমাদের মতো সুখী হতে পারি।
আমরাও যেন একে অন্যকে এভাবে ভালোবাসতে পারি। আমদের সংসারে যেন মা-বাপির মতো অশান্তি না হয়।
তাঁরা নাতনীকে কাছে টেনে নিলেন। তুমি খুব সুখী হবে, এই দোয়া করছি।
________________________________________________
Hai Prothom Alo! Hai Grey Advertising!
Hai Abashon!!!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।