‘বাউল বাউল করো তোমরা/ বাউল কি আর আছে?
বড় দুঃখে বাংলার বাউল মইরাছে...’
— বিজয় সরকার
রাজনীতিতে যখন সরকার বনাম ফতোয়াপন্থীদের বিবাদ, তখন রাজবাড়ীতে বাউলদের দমনে স্থানীয় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আর স্থানীয় মাদ্রাসার শিক্ষকদের জোটবদ্ধতার বিষয়টি ইঙ্গিতবহ। মোল্লা আর মাতব্বর এখানে দুজনে দুজনার। তাদের হাতে বাউল-নিগৃহ দেখে কুবেরের কিংবদন্তির কথাই মনে হলো। একদা কুবের নামের অসীম সম্পদবান রাজা ছিলেন। তাঁর সেসব ধন নাকি তাঁরই পাপে ভেসে গিয়েছিল।
বালুতে চিকচিক করা রুপালি ঝিলিক, তা নাকি কুবেরের ধনসম্পদের অবশেষ। বাংলার বাউল-ফকির-সাধুরা যেন সেই কুবেরের ধনের মতো ছন্নছাড়া হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছেন। অথচ উদার-অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদী বাঙালি সংস্কৃতি নিয়ে কত গর্ব আমাদের! কিন্তু তা কাদের অবদান, সে বিষয়ে আমরা বেহুঁশ।
যখন এ দেশে ইংরেজও আসেনি, যখন ইউরোপজুড়ে চলছিল ধর্ম নিয়ে হানাহানির অন্ধকার যুগ, তখন বাংলায় এক মানবতাবাদী জাগরণ ঘটে যাচ্ছিল। একদিকে সুফি-দরবেশরা, অন্যদিকে চৈতন্যদেবের অনুসারীরা জাত-পাত-বৈষম্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন।
অজস্র সমাজসংস্কারক সাধক ও সাধ্বীদের আবির্ভাব হয়েছিল। এঁদেরই সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি ফকির লালন সাঁই। তাঁর অনুসারী বাউল-ফকিররাই সেই মানবতাবাদী জীবন জিজ্ঞাসার উত্তরাধিকারী। তাঁদের হাত ধরেই কৃষকসমাজের মধ্যে চলছিল দেশজ রেনেসাঁ। ব্রিটিশের পৃষ্ঠপোষকতায় চলা কলকাতাই ‘রেনেসাঁর আলো’ পাশের গ্রামে পৌঁছাতেই যেখানে শত বছর লেগে গিয়েছিল, সেখানে গ্রামের বাউলেরা জাগাচ্ছিলেন গণমানুষকে।
সৃষ্টি হচ্ছিল অজস্র পালা-গাথা-সাহিত্য। বাংলা ভাষা নতুন জীবন পেয়েছিল এদের হাতেই। আমাদের নিম্নবর্গীয় সংস্কৃতি ও শিল্পে এখনো তার ছাপ জ্বলজ্বল। গণমানুষের সন্তান বাউলেরাই আমাদের লোকায়ত সক্রেটিস, লালনের ভাষায় ‘সহজ মানুষের’ আদর্শ নারী-পুরুষ। গ্রামীণ সমাজে নারীমুক্তির সংগ্রাম তাঁরা যতটা চালিয়েছিলেন, আজও তা কল্পনা করা কঠিন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বা কাজী নজরুলের কথা যারা জানে না, সেসব মানুষও কিন্তু লালনের গান শোনেন ও বোঝেন। এঁদের কল্যাণেই আমরা বলতে পারি ‘উদার বাঙালি সংস্কৃতির’ কথা। অন্যদিকে এদের বিরোধীরাই মানুষকে ভয় দেখিয়ে পদানত রাখার জন্য প্রচার করেন, ‘বাংলার মানুষ ধর্মভীরু, কুসংস্কারাচ্ছন্ন’ ইত্যাদি। ধর্ম তাঁদের কাছে ভয় দেখানোর বিষয়, মনুষ্যত্বের বিষয় নয়।
ঔপনিবেশিক ইংরেজের আগমন আর তাদের শেখানো আধুনিকতার তোড়ে সেই বঙ্গীয় রেনেসাঁর ধারা থেকে আমরা বিচ্যুত হলাম।
এই ক্ষতির বোধ থেকেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘তোমরা বাংলা বাংলা করিয়া সর্বত্র খুঁজিয়া বেড়াইতেছ, সংস্কৃত ইংরাজি সমস্ত ওলট্-পালট্ করিতেছ, কেবল একবার হূদয়টার মধ্যে অনুসন্ধান করিয়া দেখ নাই। ’ (বাউলের গান/রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)। হ্যাঁ, আমরা দেখি নাই। আমরা ‘দেশের ঠাকুর ফেলিয়া বিদেশের কুকুর লইয়া’ মাতিলাম। এই সাংস্কৃতিক বিপর্যয়েরই শিকার হলেন বাউলেরা।
তাঁদের মর্যাদা কেড়ে নেওয়া হয়, তাঁরা হারাতে থাকেন তাঁদের আশ্রম, মাজার, আখড়া ও সাধুসংঘের গৃহগুলো। জমিদারেরা তাঁদের নির্যাতন করেছে, মোল্লা-পুরোহিতেরা তাঁদের তাড়িয়ে বেড়িয়েছে, আমলাতন্ত্র তাঁদের অধিকার কেড়ে নিয়েছে। এখন মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে এসেছে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে আখড়া-আশ্রম-মাজার থেকে বাউল বিতাড়নের হিড়িক। আর আমরা শহরে বসে কেবল ‘বাউল বাউল’ করছি।
পবন দাস বাউলের গলায় এই দুঃখের আরতি শুনলে মনটা থম ধরে যায়।
দেশে যতবার বড় বড় বিপর্যয় এসেছে, ততবার বাউলেরাও মরেছেন। বাংলার বেশির ভাগ বাউল-ফকির-সাধকেরা এসেছিলেন নিম্নবর্গের কৃষক-কারিগর-তাঁতি-জোলাদের মধ্য থেকে। ঔপনিবেশিক শোষণ-শাসনে এঁরা বিলীন হলে তাঁদের শ্রেণীভাই বাউলেরাও বিপন্ন হয়েছেন। কিন্তু ভাতের চেয়ে বেশি তাঁরা মরেছেন জানের আঘাতে। ফকির লালন সাঁইকে জমিদারের বিরুদ্ধে লাঠি নিতে হয়েছিল।
১৯৪২ সালের দোলপূর্ণিমার দিন কুষ্টিয়ার মাওলানা আফসার উদ্দিন আহমেদ লোকলস্কর নিয়ে বাউলদের অনুষ্ঠান পণ্ড করেন এবং অনেক সাধকের ঝুঁটি ও বাবরি কেটে দেন। বাংলা ১৩৩২ সনে রংপুরের মাওলানা রেয়াজউদ্দিন আহমদ ‘বাউল ধ্বংস ফৎওয়া’ দিয়ে তাঁদের প্রতিরোধের আহ্বান জানান। সে সময় থেকে এখন অবধি হাজার হাজার বাউলকে নির্যাতন করা হয়েছে, তাঁদের আশ্রয় ও আখড়া উচ্ছেদ হয়েছে, অনেকে গ্রামছাড়া হয়েছেন, কাফের ঘোষিত হয়েছেন আরও অনেকে। পাংশায় আমরা যা দেখলাম, তা সেই ‘বাউল ধ্বংস ফৎওয়ারই’ ধারাবাহিকতা।
কেবল কাঠমোল্লারাই নন, একশ্রেণীর শিক্ষিত আমলা-রাজনীতিবিদেরাও বাউল-ধ্বংসে কম যাননি।
কুষ্টিয়ার লালন সমাধিক্ষেত্রটির দখল শুরু হয় ১৯৬৩ সালে। আইয়ুবের মানসপুত্র তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খাঁ লালনের সমাধিক্ষেত্রের পাশে লালন লোকসাহিত্য কেন্দ্র নামে একটি প্রতিষ্ঠান বানান, পদাধিকারবলে এর সভাপতি হন কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক। ১৯৭৬ সালে এই প্রতিষ্ঠানের নাম রাখা হয় লালন একাডেমি। ১৯৮৪ সালে লালনের মৃত্যুবার্ষিকীর দিনে তৎকালীন জেলা প্রশাসক ফজলুল হক মিয়া সেখানে মিলাদ-মাহফিলের আয়োজন করেন এবং ভক্তদের লালনের গান গাইতে বাধা দেন। সেই ধর্মসভা থেকে লালনভক্তদের তওবা পড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়।
আনুমানিক পাঁচ হাজার ফকির-সাধককে সেদিন রিজার্ভ পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে মাজার এলাকা থেকে বের করে দেওয়া হয়। মাজারের সিন্দুকের চাবিও বেহাত হয়। এভাবে বাউল-ধ্বংস চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হতো না, যদি রাষ্ট্র সচেতনভাবে তাদের উপেক্ষা না করত এবং আমাদের শহরবাসী সাংস্কৃতিক মহল উদাসীন না থাকত।
সবচেয়ে বড় ক্ষতি করা হয় ১৯৯৭ সালে। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় লালন কমপ্লেক্স নির্মাণের জন্য বেছে নেয় মাজারের মূল চত্বরকেই।
লালনের স্মৃতিবিজড়িত কালিগঙ্গা নদী ভরাট করে বানানো হয় উন্মুক্ত মঞ্চ। এখন বাৎসরিক লালন মেলায় ঢাকাই শিল্পীর গান আছে, রংবেরঙের করপোরেট স্পনসরদের বাহারি আত্মপ্রদর্শনী আছে, ব্যবসা-বাণিজ্য-বিনোদন আছে, কেবল সাধক ও সাধনার চিহ্নই সেখানে অবাঞ্ছিত। ওদিকে পাংশায় মাদ্রাসাশিক্ষক ইউনুস কারি আর মুফতি রিয়াজ ফতোয়া দেন আর তা বাস্তবায়ন করেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। কাকে তাহলে বেশি দোষ দেব, একশ্রেণীর মোল্লাদের নাকি রাজনৈতিক পান্ডাদের?
বাউলবিনাশীদের ক্ষমতার খুঁটি তাই ধর্ম নয়, বিত্ত আর আধিপত্যবাদী রাজনীতি। যেমন ক্রসফায়ারের শিকার কেবল গরিব শ্রেণীর লোকেরা, মোল্লা-মাতব্বরি ফতোয়ার টার্গেটেও তেমনি গরিব নারী-পুরুষ।
অথচ সরকার বাউলপ্রেমী, কালচার ইন্ডাস্ট্রি বাউলপ্রেমী, মিডিয়া-চ্যানেল বাউলপ্রেমী, সংগীত ব্যবসায়ীরা বাউলপ্রেমী, এনজিওগুলো বাউলপ্রেমী, করপোরেট ব্যবসায়ীরা বাউলপ্রেমী। তার পরও রাজবাড়ীর নিগৃহীত ২৮ বাউলের অন্যতম ৯০ বছর বয়সী বাউল আজগর আলী শাহকে চোখের পানি মুছতে মুছতে বলতে হয়, ‘যে অপমান ওরা করেছে, এর চেয়ে ক্রসফায়ারও ভালো ছিল। ’
(সাংবাদিকের কলাম থেকে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।