প্রেম ছিল, আশা ছিল
বাংলাদেশের উন্নয়নকর্মীরা জলবায়ু পরিবর্তনকে আখ্যা দিচ্ছেন নিত্যদিনের সমস্যা হিসেবে৷ দ্য ইন্টারগর্ভমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেইঞ্জ বা আইপিসিসি-র মতে, বাংলাদেশ এবং সংশ্লিষ্ট এলাকা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে৷ একই ধরণের মত বিশ্ব ব্যাংকেরও৷ তারা জানাচ্ছে, বাংলাদেশ হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশ৷
দ্য সায়েন্টিফিক কমিটি অন এন্টার্কটিক রিসার্চ বা এসসিএআর জানিয়েছে, বৈশ্বিক উষ্ণতার ফলে যেহারে বরফ গলছে তাতে ২১০০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রায় পাঁচ ফুট বাড়বে৷ নতুন এই পরিসংখ্যান বিগত দিনের পরিসংখ্যানগুলোর প্রায় দ্বিগুন৷ আর এই পরিসংখ্যান সত্যি হলে সবচেয়ে ভুগবে বাংলাদেশ৷ ব্রিটেনের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ডিএফডিআই এর মতে, পাঁচ ফুট পানি বাড়লে বাংলাদেশের এক পঞ্চমাংশ তলিয়ে যাবে৷ ফলে প্রায় ৩ কোটি মানুষ হবে গৃহহীন, একইসঙ্গে কমে যাবে ফসল উৎপাদন, বাড়বে রোগ বালাই৷ ইতোমধ্যে সিডর ও আইলার মতো প্রলয়ঙ্করী প্রাকৃতিক দুর্যোগ-কেড়ে নিয়েছে অনেক প্রাণ। আর ক্ষতি করেছে কষ্টার্জিত ফসলসহ অমূল্য সম্পদ। এছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দৈনন্দিন জীবনে সারা দেশ মোকাবেলা করে চলছে নানা দুর্যোগ-বন্যা, খরা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, সাইক্লোন, ঘুর্ণিঝড়সহ নানরকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বাংলাদেশেরূপ্রকৃতির চিরচেনা রুপ ক্রমাগত বদলে যাচ্ছে। ষড়ঋতুর এদেশকে ছ’টি নতুন সাজে এখন আর দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না।
একেবারেই হারিয়ে গেছে দুই ঋতু শরৎ ও হেমন্ত। নেই বর্ষার সময় বৃষ্টি, নেই শীতের সময় শীত। মনে হচ্ছে, একটি ঋতু গ্রীষ্মই যেন এখন প্রভাব বিস্তার করে আছে। আমাদের জীবন-জীবিকা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা-সংস্কৃতি, অর্থনীতি সবকিছুই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এভাবে চলতে থাকলে আরও লক্ষ লক্ষ প্রাণ হারাতে হবে, বাস্তহারা হবে অনেকে, ব্যাহত হবে জীবন-জীবিকা, থেমে যাবে উন্নয়ন।
বিশ্বের পরিবেশ সচেতন মানুষের কাছে বাংলাদেশের পরিচয় ভিন্ন রকমে । তারা বলে, ওহ্, বাংলাদেশ, তোমরা তো সমুদ্রের পানিতে ডুবে মরবে। বিশ্বের তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে বঙ্গোপসাগরের পানির উচ্চতা বেড়ে যাবে এবং এর ফলে উপকূলীয় অঞ্চলের একটি বড় অংশ সমুদ্রগর্ভে তলিয়ে যাবে। কিন্তু আরেকটি বিষয় মনে রাখা দরকার সমুদ্র যেমন রাগে ফুঁসছে, তেমনি হিমালয়েরও বরফ গলা শুরু হয়েছে। বাংলাদেশে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র মিশে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ে।
জাতিসংঘের জলবায়ুসংক্রান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে হিমালয়ের গ্লেসিয়ার গলে যাওয়ার ফলে এশিয়ার, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার, নদীর উৎস ২০৩৫ সাল অর্থাৎ মাত্র ২০ থেকে ২১ বছরের মধ্যে ধ্বংস হয়ে যাবে। ফলে বাংলাদেশসহ ভারত, তিব্বত, নেপাল, পাকিস্তান ও মিয়ানমারে আগামী কয়েক দশকে বন্যা ও খরার ঘটনা বেড়ে যাবে। এর অর্থ হচ্ছে, বঙ্গোপসাগরে পানির উচ্চতা এমনিতেই বাড়বে, তার ওপর যোগ হবে হিমালয়ের বরফগলা পানি। বাংলাদেশের মাথার ওপরে এবং পায়ের তলায় সব দিক থেকে আঘাত আসবে।
কোপেনহেগেন সম্মেলনে পর পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ জার্মান আন্তর্জাতিক বেতার ডয়চে ভেলেকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে বলেন, কোপেনহেগেন সম্মেলনে যেটা সম্ভব হয়নি, আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে, কোপ-১৬ সম্মেলন, যা মেক্সিকোতে অনুষ্ঠিত হবে, সেখানে এ বিষযে একটি ঐকমত্যে পৌঁছানোর তিনি আরও বলেছেন, কোপেনহেগেনে ২০১০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে ৩০ বিলিয়ন ডলারের একটি বৈশ্বিক তহবিল গঠনের ধারাবাহিকতায় ২০২০ সাল নাগাদ ১০০ বিলিয়ন ডলারের তহবিল গঠনের যে ঐকমত্য হয়েছে এই তহবিল এখন বাস্তবায়ন হবে, তা আমরা আশা করতে পারি৷ বাংলাদেশ যেহেতু সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ, এই তহবিল থেকে আমরা যেন প্রয়োজনীয় অর্থ পেতে পারি, সেভাবেই সরকারের প্রকল্পগুলো প্রনয়ণ করা হচ্ছে৷ ৩০ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ তহবিলের ১৫ ভাগ দাবি করেছে বাংলাদেশ৷ পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷
তবে কি আজ সময় এসেছে ভিক্ষার ঝুলি হাতে নিয়ে সামনে দাঁড়ানোর? শুধু কি আর্থিক ক্ষতিপুরণ দিয়ে এই ধরনের একটা সমস্যার সমাধান সম্ভব? বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে কৃষি উৎপাদন হ্রাস পাওয়ার কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্যাভাব দেখা দিতে পারে।
২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে ধানের উৎপাদন কমবে প্রায় আট শতাংশ এবং গমের উৎপাদন কমবে প্রায় ৩২ শতাংশ। ফলে খাদ্যনিরাপত্তায় দেখা দেবে এক অনিশ্চয়তা। তাহলে এই ক্ষতিপুরণের অর্থ চিবিয়ে খাওয়া ছাড়া আর কোন পথ খোলা থাকরে না।
জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ বিপদ সম্পর্কে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণের উদ্দেশ্যে সমুদ্রের পানির নিচে ডুবন্ত অবস্থায় মালদ্বীপ মন্ত্রিসভার যে বৈঠক হয়েছে, তাকে শুধু প্রতীকী অর্থে বিবেচনা করলেই চলবে না। যদি বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশগুলোর বিবেক জাগ্রত না হয় তাহলে মালদ্বীপ তো বটেই, বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশের উপকূলীয় নিম্নাঞ্চলও সাগরে ডুবে যেতে পারে।
এর ফলে বিশ্বে দেখা দেবে অভাবনীয় মানবিক বিপর্যয়। এই সম্ভাব্য দূর্যোগ একক কোন দেশ বা জাতির পক্ষে মোকাবিলা সম্ভব নয়, দরকার রাজনৈতিক অঙ্গীকার।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।