আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি কোন পথে ?

চারিদিকে দেখো চাহি হৃদয় প্রসারি

সেটা ২০০৬। আগের বিধানসভা ভোটে বিপুল সাফল্যর পর ‘উন্নততর বামফ্রন্ট’ এর নামাবলী গায়ে চাপিয়ে বুদ্ধ নিরূপমের সি পি এম শুরু করেছিল দেশি বিদেশি একচেটিয়া পুঁজির প্রত্যক্ষ দালালি। এস ই জেড থেকে ১৮৯৪ সালের ঔপনিবেশিক আইনে জমি দখল, গণ আন্দোলন রুখতে লাগাতার ১৪৪ ধারা, লাঠি গুলির নির্মম প্রয়োগে রক্তস্রোত, গণহত্যা – বাদ থাকেনি কিছুই। সি পি এম তখন কেন্দ্রে প্রথম ইউ পি এ সরকারের বিশ্বস্ত রক্ষক। কংগ্রেসের কাছ থেকে প্রশ্রয় সমর্থন সাহায্য– সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম পর্বে কেন্দ্রীয় শাসকের সব দাক্ষিণ্যও মিলেছে।

কিন্তু সংসদে শাসকের প্রাণভোমরা হয়ে থাকার আত্মবিশ্বাস বা রাজ্য বিধানসভায় ২৩৫ এর নিরঙ্কুশ আধিপত্যর আস্ফালন – বিশ্বাসঘাতক সি পি এমকে কোনটাই শেষপর্যন্ত বাঁচাতে পারেনি। সিঙ্গুরের গণ আন্দোলনে ওঠা শাসক বিরোধী হাওয়া নন্দীগ্রাম পর্ব পেরিয়ে ঝড়ের আকার নিয়েছে বিগত পঞ্চায়েত, পুরসভা, লোকসভা - সব নির্বাচনেই। আর সেই ঝড়ে জনসমর্থন থেকে শাসনক্ষমতা, সবই একে একে যেতে বসেছে। এবারের বিধানসভা নির্বাচনে সি পি এম শুধু রাজ্যের শাসন থেকেই উৎখাত হবার মুখে তাই নয়, বামপন্থী শক্তি হিসেবে তার বিশ্বাসযোগ্যতার কফিনেও পড়তে চলেছে পেরেক। দীর্ঘদিন ধরেই এ রাজ্যে সি পি এম ‘বাম’ সরকারের ক্ষমতাকে পুঁজিতোষণ, শ্রমিক শোষণ, কৃষি সমস্যার প্রতি ধারাবাহিক ঔদাসিন্যের কাজে ব্যবহার করে আসছে।

কেন্দ্রের কংগ্রেস বিজেপি সরকারগুলির অনুসৃত নয়া উদারনৈতিক কর্মসূচীর মূল রাস্তার সঙ্গে গত এক দশকে সি পি এম নেতৃত্বাধীন ‘বাম’ সরকারের আর্থিক নীতির মৌলিক ব্যবধান খুঁজে পাওয়া খুবই কঠিন। অপারেশন শানসাইনে হকার উচ্ছেদ থেকে টাটা সালেমের মতো একচেটিয়া পুঁজির কারবারীদের জন্য রেড কার্পেট, শ্রমিকদের কোটি কোটি টাকার পি এফ পেনসন হাতিয়ে নেওয়া মালিকদের সাথে স্বার্থান্বেষী বোঝাপড়া থেকে বন্ধ কারখানার জমিতে প্রমোটারীর নিয়ন্ত্রক ও মদতদাতা হয়ে ওঠা, কৃষকের জমিকে পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দেওয়া থেকে খুচরো ব্যবসায়ে একচেটিয়া হাঙরদের অনুপ্রবেশকে বৈধতাদান, গণ আন্দোলনকে নির্মমভাবে দমন করা থেকে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে চোখরাঙানি দাদাগিরির রাজ কায়েম করা – প্রাক স্বাধীনতা আমল থেকে বামআদর্শ পুষ্ট বঙ্গে বামপন্থার ঐতিহ্যকে ধূলিস্যাৎ করার সব সম্ভাব্য আয়োজনই সি পি এম তার শাসক চেহারায় দাঁড়িয়ে থেকে লাগাতার করে চলেছে। সি পি এমের ঔদ্ধত্য আর মেহনতি জনগণের প্রতি ধারাবাহিক বিশ্বাসঘাতকতাই বঙ্গে ব্রাত্য দক্ষিনপন্থী তৃণমূল-কংগ্রেসকে সুযোগ দিয়েছে জনমোহিনী রূপে প্রত্যাবর্তনের। দৃষ্টান্তস্বরূপ কলকাতার পার্শ্ববর্তী কামারহাটি বিধানসভা নির্বাচনী ক্ষেত্রটি (১১২ নং) র দিকে যদি আমরা তাকাই, তাহলে দেখতে পাব গোটা রাজ্যের মতো এই শিল্পাঞ্চলটিও ধুঁকছে। মোহিনি মিল সহ অনেক কারখানা বন্ধ।

বন্ধ কারখানাগুলি খোলার কোনও উদ্যোগ দূরে থাক, সেখানকার জমিতে চলছে বহুতল আবাসন আর শপিং মল এর রমরমা। শ্রমিকদের পি এফ পেনসনের টাকা লোপাট হয়ে গেছে। প্রায়শই গৃহস্থ বাড়িগুলিতে বন্ধ কারখানার শ্রমিকদের ভিক্ষুকের চেহারায় করুণ আবেদন নিয়ে আমরা হাজির হতে দেখি। সংগঠিত শিল্পের পিছু হঠার সূত্রে এখানে হোসিয়ারি সহ ক্ষুদ্র শিল্পোদ্যোগের যে মরীয়া ব্যক্তিগত উদ্যোগ এর প্রাবল্য, তার প্রতিও সরকারের নির্মম উদাসীনতা। এর বিকাশের জন্য কোনও সরকারী সাহায্য বা উদ্যোগ দূরে থাক, এখানে ন্যূনতম মজুরী বা শ্রম আইন লঙ্ঘনের ঘটনাগুলিতে সরকারী প্রশ্রয় লাগাতার।

জুটমিলগুলিতে শ্রমিকদের নানাবিধ ধারাবাহিক বঞ্চনা, ঠিকাদারী প্রথার মাধ্যমে ব্যাপক শোষণ- সবই মিল মালিক ও শাসক পার্টির গাঁটছড়ায় দিনের পর দিন অবাধে চলছে। বি টি রোডের ধারের ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের সংস্কার ও পুনরুজ্জীবনের জন্য চরম অনীহা সি পি এমের শ্রমিক স্বার্থ রক্ষার অনীহা ও তাদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতারই নগ্ন প্রকাশ। জনগণের প্রতি সি পি এমের বিশ্বাসঘাতকতাকে পুঁজি করেই রাজ্যের শাসনক্ষমতা দখলের জন্য তৃণমূল-কংগ্রেস দীর্ঘদিনের লালসা নিয়ে এবার শিঁকে ছেঁড়ার অপেক্ষায়। সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের গণ আন্দোলনের ময়দানে শক্তি সংহত করে আসা আর সেইপর্বে ‘বামবুলি’ ও ‘সংগ্রামী বামশক্তি’র কারো কারো সহযোগ তৃণমূলকে বাম গণতান্ত্রিক শক্তির একাংশের ভরসাযোগ্যও করে তুলেছিল, অন্তত ‘বিশ্বাসঘাতক সি পি এম’ এর তুলনায় ‘মন্দের ভালো’ হিসেবে। কিন্তু শর্টকাট বিকল্পের সন্ধানমত্ত এই ‘পেটিবুর্জোয়া’ অংশকে হতাশ করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর তৃণমূল এর মধ্যেই মূল কংগ্রেসের শাসকশ্রেণির রাজনীতির দিশাকে পুনরায় বরণ করে নিয়েছে।

চটকল ধর্মঘটের সক্রিয় বিরোধিতা থেকে মিছিল মিটিং প্রতিবাদের ভাষার প্রতি জেহাদ, স্থানীয় ক্ষমতা কেন্দ্রগুলিতে সদ্য অধিষ্ঠিত হয়েই সেগুলিকে দুর্নীতির আখড়া বানানো থেকে শুরু করে ক্ষমতা অধিগত করা অঞ্চলগুলিতে সি পি এম সুলভ সামাজিক দাদাগিরি – বাদ থাকছে না কিছুই। কমনওয়েলথ গেমস, টু জি স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারী, সাংসদ কেনাবেচা - ইউ পি এ সরকারের লাগাতার দুর্নীতির ঘটনাগুলিতে দ্বিতীয় বৃহত্তম শরিক তৃণমূল ও তার ‘সততার প্রতীক’ নেত্রী আশ্চর্যজনকভাবে নীরব। রেল থেকে রাজ্যের জন্য ‘রূপকথার ইস্তাহার’ - পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের নামে বেসরকারী একচেটিয়া পুঁজির অবাধ মৃগয়াক্ষেত্র তৈরি করার উপযুক্ত প্রচারাভিযান এখন চলছে বিরামহীন। একচেটিয়া পুঁজিপতিদের আশীর্বাদের নিদর্শন হিসেবে তৃণমূলের প্রার্থী তালিকায় ফিকির সচিব এর ‘পরিবর্তনের অর্থমন্ত্রী’ হিসেবে উঠে আসা বা সম্ভাব্য বিধায়ক তালিকায় প্রাক্তন শীর্ষ আমলাদের সমাবেশ – তৃণমূলের একচেটিয়া পুঁজিবান্ধব আমলাতান্ত্রিক ভবিষ্য শাসনের ছবিকেই তুলে ধরছে। কর্পোরেট মিডিয়া সহ যাবতীয় প্রাচারমাধ্যম, শাসকশ্রেণির যাবতীয় শক্তি সি পি এম ও তৃণমূল-কংগ্রেস এই দুই মেরুর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক লড়াইকে সীমাবদ্ধ করে দিতে চাইছে।

জনগণের একটা বড় অংশও মেরুকরণের প্রভাবে শর্টকাট খুঁজছেন। কিন্তু রুক্ষ রাজনৈতিক বাস্তবতার বর্তমান জমিতে জনগণের আন্দোলন ও উদ্যোগকে বাড়িয়ে যাওয়া ছাড়া জনগণের রাজনৈতিক আধিপত্যকে শাসকশ্রেণির রাজনীতির ওপরে প্রতিষ্ঠা করার সত্যিই কোনও বিকল্প নেই। সি পি এম থেকে তৃণমূল- এই শাসক বদলের মধ্য দিয়ে আম জনতার মৌলিক সমস্যার সামান্যতম সমাধানও সম্ভব নয়। জনগণ দীর্ঘদিনের গণ আন্দোলনের ময়দানে তাদের অর্জিত অধিকারগুলিকে বাম জমানার বিশেষ করে শেষ দশকে যেভাবে একে একে হারিয়েছেন, এই তথাকথিত ‘পরিবর্তন’ তাকেই আরো ত্বরাণ্বিত করবে মাত্র। দীর্ঘ অপেক্ষার পর সি পি এমের মেকি বামপন্থার ভেকটি জনগণের সামনে উন্মোচিত হয়ে গেছে।

বিধানসভা নির্বাচনের এই পর্ব তাই পশ্চিমবঙ্গের সংগ্রামী বামপন্থী রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণের আগামী দিনের কঠিন পথের উপযুক্ত মহড়াপর্ব। আসুন আমরা সমস্ত সহজ শর্টকাটের মায়াবী প্রলোভন ছেড়ে গণ আন্দোলন গণসংগ্রামের শক্তি কে শক্তিশালী করি।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.