আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী।(২)



১৯৬২ সনে কম্যুনিষ্ট পার্টি একটা অবস্থান নিলো চিন যুদ্ধের প্রেক্ষিতে। পার্টি তখনও ভাগ হয়নি। কিন্তু আন্দোলনের লাইন নিয়ে তখন বিস্তর বিতর্ক পার্টির ভেতর। অবস্থানটা ছিলো যে ঐ সময়ের চিন ভারত যুদ্ধে আক্রমণকারী কে ---এই প্রশ্নে । পার্টির বক্তব্য --চিন নয়, আক্রমণকারী ভারতই।

আর এইকথাটা পার্টিকে অত্যন্ত চাপের মধ্যে ফেলে দিলো। সাধারণ ভাবে বামপন্থীদের কাছে এটা গ্রাহ্য ছিল যে চিন একটি সদ্য বিপ্লবোত্তর সমাজতান্ত্রিক দেশ । পররাষ্ট্র আক্রমণ সে আক্রান্ত না হলে করতে পারেনা । কিন্তু বৃহত্তর ভারতীয় জনগন এটাকে বিশ্বাস করেনি । সেটা ভারতের জাতীয়কংগ্রেসের প্রচারের ফল অথবা রাষ্ট্রীয় মদতে যেভাবেই হউক হয়েছে।

তার ফলও হয়েছিলো মারাত্মক। ভারতরক্ষা আইনে কম্যুনিষ্টদের গ্রেপ্তার নিপীড়ন শুরু হয়ে যায়। জনজীবনে কম্যুনিষ্টদের দেশদ্রোহী সাজানো চলতে থাকে। এর ফলশ্রুতি পুরনো বিতর্ককে উষ্কে দেয়। দেখা যায় সবাই গ্রেপ্তার হয়নি, কেউ কেউ গ্রেপ্তার হচ্ছে।

পার্টির অভ্যন্তরে প্রচন্ড সন্দেহ সংঘাত করা শুরু হলো । পার্টি ভাগ হলো ১৯৬৪তে। অনেক দলিল দস্তাবেজ তৈরি হলো। ভাগের একটি হলো সিপিআই(এম)অন্যটি পুরনো নামেই সিপিআই । সিপিআই(এম)কে বলা হলো চিনপন্থী।

সিপিআই কে বলা হলো মস্কোপন্থী। অবশ্য অচিরেই সিপিআই(এম)এর চিন মোহ চলে যাবে কিছুটা। সে বিষয়ে পরে আসছি। পার্টি ভাগের ফলে সিপিআই(এম) অংশটি এই বঙ্গে বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠলো। তার কারণ দেশভাগ, কেন্দ্রীয়সরকারের পক্ষপাত এবং এইজাতীয় কিছু কারণে পিছিয়েপড়া এই বঙ্গে একটা কংগ্রেসবিরোধী ভিত্তি ছিলোই যা সিপিআই(এম)এর কাজে লেগে গেল।

সিপিআই কিছুটা প্রো কংগ্রেসী হিসেবে এখানে দুর্বল হয়ে পড়ল। সিপিআই(এম) এই সুযোগ কাজে লাগালো তখনকার দুর্বল এবং দ্বিধাবিভক্ত কংগ্রেসের বিরুদ্ধে এবং সফলও হলো। কংগ্রেস থেকে ভেঙ্গে বেরিয়ে আসা বাংলাকংগ্রেসের সাহায্যে রাজ্যে ক্ষমতাও দখল করে বসল। সেটা ১৯৬৭ । আমি তখন ক্লাস এইটের ছাত্র।

কলেজের বড় বড় ছাত্ররা এসে মাঝেমাঝেই স্কুল বন্ধ করে দিত। আমাদের লাইন করে নিয়ে যেত মিছিলে। সেই সব নবীন ছাত্রনেতারা তখন আমাদের আদর্শ। তাদের নির্দেশে আমরা ভীষণ জোরে জোরে স্লোগান দিতাম। সেই করে একবার আমার গলা দিয়ে আওয়াজ বের হলোনা ক'দিন।

এককথায় প্রান্তিকমানুষের এই উচ্চকিত কন্ঠস্বরই যেন সিপিআই(এম) এবং অন্যান্য বাম দলগুলোর জন্য পঃবঙ্গে একটা জায়গা করে দিলো। ঐ সময়টাতেই কলকাতা 'মিছিলনগরী হিসেবে খ্যাত হয়েছিলো। কিন্তু উচ্ছ্বাসে কিছু ঢাকা পড়েই। এই উচ্ছ্বাসেই ঢাকা পড়ে গিয়েছিলো বাঙালীজাতির প্রতি কম্যুনিষ্টদের দেশভাগকালীন অন্যায় অবস্থানটি। কারণ তারা বাংলাভাগে সায় দিয়েছিলেন মুসলিম জনগনের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রশ্নে।

তারা জাতীয়তাবাদে আস্থাহীন । অথচ ধর্মীয় জনগোষ্টীর প্রতি সমর্থন ! তাও একটা দেশভাগের প্রশ্নে ! ভাষাজাতি, বাঙালীত্ব ---এসব আবার কি----সবটাই শোষক এবং শোষিতের প্রশ্ন । দেশভাগ হলে মানুষ বাস্তুচ্যুত হলে সেটাও একটা শ্রেণী সংগ্রাম । বিশেষতঃ পূর্ববঙ্গে হিন্দুরা শোষকের দলেই পড়ে । ওরা ভাগাভগির কারণে উচ্ছেদ হলে ওটা প্রকৃতই শ্রেণীসংগ্রামের পর্যায়ে পড়ে ।

ভারতীয় তথা বঙ্গীয় কম্যুনিষ্টদের কপিবুক রাজনীতির কারণে এদেশে তাদের আজও কোনো জনভিত্তি তৈরী হয়নি । স্বাধীনতার পর থেকে কংগ্রেসের রাজত্বের অবসানে এই নিয়ে দ্বিতীয়বার কম্যুনিষ্টরা ক্ষমতা দখল করলো একটি রাজ্যে। প্রথমবার করেছিলো কেরালায় ১৯৫৫ সালে। পঃবঙ্গে ক্ষমতার আসার ক্ষেত্রে কম্যুনিষ্টদের নিজস্ব অবদানের চাইতে বরং কংগ্রেসের ব্যর্থতাই বেশী ছিলো। দেশভাগ---পুনর্বাসন---খাদ্যআন্দোলন---এগুলোর কোনোটারই মোকাবেলা কংগ্রেস তার নিজস্ব নীতি-আদর্শের উপর দাঁড়িয়ে করতে পারেনি।

ফলে যেমন লক্ষাধিক উদ্বাস্তু তৎকালীন দেশভাগের সমর্থক অবিভক্ত কম্যুনিষ্ট পার্টিরই শহর এবং শহরতলির সমর্থক হয়ে উঠলো তেমনি খেতে না পাওয়া শ্রমিক এবং বিশেষতঃ প্রান্তিক কৃষকরাও তাদের সমর্থক হয়ে উঠলো। এই শ্রেণীর মানুষদের প্রতি কংগ্রেসের কোনো কার্যকরী কর্মসূচী সেই অর্থে কোনো কালেই ছিলোনা। বিত্তবান শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বের মধ্যেই তারা আটকে রইলো। আমাদের ছোটবেলা থেকেই দেখেছি, ,শুনেছি যে কংগ্রেস বড়লোকের দল। চরম খাদ্যাভাবের মধ্যে এইরকম এক উপলব্ধি তৈরী হচ্ছিলো যে বড়লোক তারাই যারা দু'বেলায় পেটপুরে খেতে পায়।

যারা খেতে বসে দ্বিতীয়বার ভাতের জন্য হেঁসেলের দিকে জুলজুল করে তাকিয়ে থাকেনা । সে কারণে আমাদের একটা স্বাভাবিক ইর্ষা তৈরী হচ্ছিলো তাদের প্রতি। বোধহয় ভেতরে ভেতরে বামপন্থার বাসাটা এই ইর্ষাটাকে আশ্রয় করেই তখন তৈরী হচ্ছিলো। এদিকে দেখতে দেখতে সিপিআই(এম)এ আবার ভাঙন। যে দ্বন্দ্বের সুত্র ধরে ৬৪'র ভাঙন সেইটাই উস্কে উঠলো।

ক্ষমতায় থাকা সিপিআই(এম)এর একটা অংশ চেয়ে বসল সশস্ত্র বিপ্লব। এই বিপ্লবের স্বপ্ন পার্টির জন্ম লগ্ন থেকেই তাকে তাড়া করছে। পরবর্তীতে অনেক ধরণের বিপ্লবের কথা বলা হলেও এই সশস্ত্র বিপ্লবের প্রস্তাব সিপিআই(এম)এর ভিত নাড়িয়ে দিলো। বুর্জোয়া গনতন্ত্রকে ব্যবহার করে শান্তিপূর্ণ জনগনতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রতি কারোর কারোর আস্থা নেই । তাদের নেতৃত্বে ছিলেন চারু মজুমদার।

চারুবাবুর সেই বিপ্লবের দলিল সিপিআই(এম)এ প্রত্যাখ্যাত হলে ওনারা পার্টি নির্দেশ অমান্য করে সশস্ত্র বিপ্লবের ডাক দিলেন। জোতদারের জমি দখল করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে বেশ ক'জন কৃষকরমনী ও পুরুষ মারা যান। ঘটনার স্থানটি উত্তরবঙ্গের দারজিলিং জেলার নক্‌সালবাড়ী নামক স্থান। পরবর্তীতে পার্টি তৈরী হলে তার নাম সিপিআই(এমএল) হলেও বিপ্লবীরা নকসালপন্থী নামেই অচিরেই খ্যাত হয়ে উঠলেন। চিন সেখানে একটা প্রসঙ্গ হয়ে উঠলো।

শোনা গেল পিকিং রেডিওতে নকসালবাড়ী আন্দোলনের প্রতি সমর্থন। সিপিএমএর ভাগ্যে জুটলো অপবাদ, রাশিয়ার দালাল , সংশোধনবাদী ইত্যাদি । দেয়ালে দেয়ালে "চিনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান" লেখা হতে লাগলো। আসলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন গুলোর নেতৃত্ব নিয়ে চিন সোভিয়েতের মতাদর্শগত লড়াই বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়লো। তার ফলশ্রতিতে পঃবঙ্গেও ছড়িয়ে পড়লো বারুদের গন্ধ ।

সিপিআই(এম) চিন নিয়ে তার অবস্থানটাকে অনেক ভেতরে লুকিয়ে ফেলল। সিপিআই(এম) ও সহযোগী বামদলগুলোর যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় বেশীদিন থাকলে পারলনা । মূলত কংগ্রেসভাঙা বাংলাকংগ্রেস এর সংগে বিরোধে ভেঙ্গে গেল। তখন একদিকে ক্ষমতাচ্যুত কংগ্রেস , বৈরীসম্পর্কের কেন্দ্রীয়সরকার ও অন্যদিকে বিপ্লবের ডাক দেয়া সিপিআই(এমএল) তথা নকসালপন্থীরা, একরকম জ্ঞাতিশত্রু --আর মাঝখানে সিপিআই(এম)। রাজ্যটা প্রকৃতই নৈরাজ্যের প্রতীক হয়ে উঠেছিলো ৬৭ থেকে ৭২ পর্যন্ত।

এরমধ্যে আরেকবার সিপিআই(এম) তথা যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় আসলেও টেকেনি । তারপর রাষ্ট্রপতির শাসন এবং নকসালদের বিপ্লবের নানা কর্মকান্ড। আর এরমধ্যেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার লড়াই। (চলবে)

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.