অগ্নিদেবতাকে বাগে আনার ফলে নতুন সূর্যের দেখা মেলে এই জনপদে। হাজার হাজার বছরের পথ চলায় বাঁচার তাগিদে মানুষ চাষবাসের মতো উপায় খুঁজে বের করে, সেচের কৌশল রপ্ত করে, ফলে চাষবাসের উন্নতি হয় বহুত। কৃষিসামগ্রির বহুবিধ ব্যবহারে যাত্রা শুরু হয় শিল্পের। বাষ্পচালিত যন্ত্রসহযোগে পাগলা ঘোড়ার মতো চলতে শুরু করে শিল্প। যন্ত্র শ্রমিকের কাজ করলেও এর মালিকানা থাকে পুঁজিপতিদের হাতে, যাদের ধর্ম হলো মুনাফা।
মুনাফার মূলে যে শ্রমশক্তি হাতিয়ে নেয়া তা এখন দিবালোকের মতো ঝকঝকে। সমস্ত মানবজাতির অর্জন এই আধুনিক যন্ত্র, যার শক্তি আসলে পুঞ্জিভুত শ্রম। শ্রমশক্তি প্রাণি ও মা ধরণীর প্রতিনিয়ত আন্তসম্পর্কের ফলে নবায়িত হয়। কিন্তু যন্ত্রের তো আর সেই দশা না তাহলে এর চলার শক্তি আসবে কোত্থেকে?
লক্ষ লক্ষ বছর ধরে প্রাণশক্তির ফেলে আসা ধ্বংসাবশেষ বের করে আনা হয়েছে মাটির নিচ থেকে। কয়লা পুড়ার তাপে পানি ফুটিয়ে বাষ্প কাজে লাগিয়ে চলা শুরু করেছে যন্ত্র।
গত দু'শবছরে তাপ ও বিদ্যুৎ শক্তির ব্যবহার এমন বেড়েছে যে মা প্রকৃতির গর্ভে ধারণ করা সকল জীবাশ্ম জ্বালানী - কয়লা, তেল ও গ্যাস এখন প্রায় নাই এর পর্যায়ে।
বহতানদীর গতিপথে বাধা সৃষ্টি করে টারবাইন ঘুড়িয়ে জলবিদ্যুৎের জন্য বাধ বানিয়ে বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছে পরিবেশ-প্রতিবেশের। জীবাশ্ম জ্বালানীর দহনে কার্বন ডাইঅক্সাইডসহ কারখানার নানান ধোঁয়া গ্রীনহাউজ প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে বৃদ্ধি করছে পৃথিবীর তাপমাত্রা। কৃষিতে সার-কীটনাশক, শিল্পের বর্জ্য সবমিলিয়ে দূষণের মাত্রা এমন হয়েছে যে প্রতিনিয়ত বিলুপ্ত হচ্ছে কোন না কোন জীব।
শক্তির সারিতে বিংশ শতকের মাঝামাঝি যোগ হয় নিউক্লিয়ার শক্তি।
জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে এই শক্তির 'অ্যাটম বোমা' দ্বারা মার্কিনিরা দুই লক্ষাধিক মানুষ হত্যা করলে আতকে উঠে দুনিয়ার মানুষ। কিয়ামত নামানোর মতো ধ্বংসাত্নক এই বোমার সাথে বর্তমান ক্ষমতা ও স্বার্বভৌমত্বকে এমনভাবে মিলানো হয়েছে যে এটা যেন সবার চাই। অনেক দেশই এখন এই বোমার অধিকারি। বোমার পরীক্ষা ক্ষেত্র হিসেবে গোপনে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে দে'য়া হচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে।
নিউক্লিয়ার শক্তি দ্বারা বিদ্যুৎশক্তি তৈরি করার প্রথম চুল্লী ১৯৫৬ সালে বৃটেনের উইন্ডস্কেলে চালু করার পরের বছরই আগুন ধরে।
প্রথম চুল্লী দুর্ঘটনায় তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে উত্তর ইউরোপ পর্যন্ত। শুরুতেই এতবড় ধাক্কা খেয়ে চুল্লী বানানো থমকে ছিল বেশ কিছুদিন। ১৯৭৩ সালের তেল সংকটের সুযোগে আবার চুল্লী বানানোর আয়োজন হয়। মার্কিনিরা ১৯৭৪ সালে প্রথম অনুমোদন দেয়। ১৯৭৯ সালে পেনসিলভানিয়ার থ্রি মাইল আইল্যান্ডে চুল্লী গলে যাওয়ার মতো (বা যাওয়া) ও তার পরেই ১৯৮৬ তে রাশিয়ার চেরনোবিলের চুল্লী গলার ঘটনায় সারাদুনিয়ার মানুষ এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠে।
তেজস্ক্রিয়তার ভয়াবহতা ছড়িয়ে পড়ে আশেপাশের এলাকায়। জাপানের হিরোশিমা-নাগাসাকির হত্যাযজ্ঞের দাগ হৃদয়বিদারি। তেজস্ক্রিয়তায় কি ক্ষতি হয় এই বিষয়ে মানুষের কোন ধারণাই ছিলো না হিরোশিমা-নাগাসাকির আগে। তেজস্ক্রিয়তা আক্রান্ত জাপানিদের উপর চালানো পরীক্ষা-নিরিক্ষাই চুল্লীমালিকদের বা সরকারের প্রধান খতিয়ান, যা দিয়ে বিভিন্ন নিরাপত্তার কথা আওড়ানো হয়। মুনাফাতাড়িত দর্শনের ষন্ডা বৈজ্ঞানিকদের নিরাপত্তার দলিল ফেলে মানুষ এর প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে এসেছে।
মানুষের প্রতিবাদের শক্তি জোরদার হচ্ছে দিনে দিনে।
ইতালির জনমত চেরনোবিলের পর এমন তুঙ্গে উঠে যে শেষ পর্যন্ত বিদ্যমান ৪টি চুল্লীর ভবিষ্যৎ নিয়ে গনভোট হয়। জনগণ প্রত্যাখ্যান করে পারমাণবিক শক্তি। ইউরোপের 'মাফিয়া' বারলুসকনি ২০১৩ সালে নতুন করে ৪টি চুল্লী বানাতে চায় এবং এ নিয়ে এবছরই গণভোগ অনুষ্ঠিত হবে। ফুকুশিমার পর আশা করা হচ্ছে এবারও তা প্রত্যাখ্যাত হবে ব্যাপকভাবে।
জার্মানি জনগণের প্রতিরোধের মুখে ২০২১ সালের মধ্যে ১৭টি চুল্লীই বন্ধ করার পরিকল্পনা ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। কিন্তু গতবছর চুল্লীর আয়ু দশ বছর বাড়ানোর একটি আইন পাস করে কনজারভেটিভরা। ফুকুশিমার পর জনমতের চাপে সদ্য পাসকৃত আইনটির উপর ৩ মাসের স্থগিতাদেশ জারি করে বন্ধ করে দিয়েছে বেশ কিছু পুরান চুল্লী। এবং পুনর্বিবেচনা করছে নিউক্লিয়ার শক্তির ভবিষ্যৎ। (জার্মানি শেষ পর্যন্ত ২০২২ সালের মধ্যে পারমাণবিক শক্তি থেকে বের হয়ে আসার কথা ঘোষণা করে)।
বেলজিয়ামের বিদুৎতের অর্ধেক আসে নিউক্লিয়ার শক্তি থেকে। গত ২০০৩ সালে এরা ২০১৫ সালের মধ্যে পারমাণবিক শক্তি থেকে বের হয়ে আসার কথা বললেও পরে তা আরও দশ বছর বৃদ্ধি করে। ফুকুশিমার পর সরকার আগের সিদ্ধান্তে ফেরত যাবে বলে পরিবেশবাদীরা আশাবাদী।
সুইজারল্যান্ড ৪০% বিদ্যুৎ চুল্লীর মাধ্যমে আসলেও নতুন করে ৩টি চুল্লী করার প্রকল্প বাদ দিয়েছে এবং এর থেকে বের হয়ে আসার ব্যাপারে একমত হয়েছে সকল রাজনৈতিক পক্ষ। (সুইজারল্যান্ড নিউক্লিয়ার শক্তি বাতিল ঘোষণা করেছে।
)
৩/১১ ফুকুশিমায় 'মার্কিনিদের সাজানো' ৯/১১ অপেক্ষা অধিকতর বিপর্যয় নিয়ে হাজির হওয়ার সাথে সাথে নিউক্লিয়ার শক্তির চাম্পিয়ান তোড়জোড় করে লিবিয়া আক্রমনে নেতৃত্ব নিল 'মুই কি হনু'রে জাত্যভিমানে গর্বিত 'কালচার্ড' ফ্রান্স। তারা মোট ৫৯টি চুল্লীর দ্বারা দেশের ৭৮% বিদ্যুৎ তৈরি করে। এখনও তারা এই শক্তির পক্ষে।
যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশী ১০৪ টি চুল্লী। নিউক্লিয়ার শক্তি বিরোধী জনমতের কারণে গত তিন দশক ধরে নতুন চুল্লী বানানো বন্ধ।
ওবামা নতুন করে কর্মসূচি ঘোষনার কথা বললেও ফুকুসিমার পর সবকিছু নড়বড়ে হয়ে গেছে।
জাপানের অবস্থা তো অবর্ণনীয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তেজস্ক্রিয়তায় জ্বলে পুড়ে আমেরিকার কলোনি হওয়ার পর এমন এক দর্শনে চলা শুরু করে যেন আমেরিকার নকল করাই সাধনার ধন। আমরা বাংলার 'শিক্ষিত' জনগণতো জাপান নামেই বেহুস। তারা কি করে ফেলল আর আমরা কি করছি! (তবে গুরু ঠাকুর 'জাপান যাত্রীর ডায়েরি'তে চমৎকার ফুটিয়ে তুলেছেন জাপানিদের।
) তাদের 'উন্নয়নে'র ঠেলায় এমন বিদ্যুতের দরকার যে তেজস্ক্রিয়তার দগদগে ঘা নিয়েও গড়ে তুলে ৫৬টি চুল্লী। আর ফুকুশিমায় যা হচ্ছে মানুষ এখনও জানে না কিভাবে কি করা হবে। (আগামী জানুয়ারি (২০১২) নাগাত নাকি সবকিছু নিয়ন্ত্রয়ে আসবে)। জাপানিরা নিউক্লিয়ার শক্তির ছড়ানো তেজস্ক্রিয়তার এই নরক থেকে চিরতরে বের হয়ে আসবে নিশ্চয়ই।
এশিয়ার আরেক উপনিবেশ দ. করিয়া যারা জাত ধর্ম সবই বিসর্জন দিছে মার্কিনিদের কাছে।
তাদের 'জ্ঞান-অর্থ মন্ত্রী' (মন্ত্রণালয়ের নাম মাশাল্লা) বলেছেন এখন নাকি এসব নিয়ে ভাবনা চিন্তার সময় না, এখন হলো প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়। 'সূর্যের চেয়ে বালি গরম', তাদের প্রভুরা যেখানে লোকলজ্জার ভয়েও হলে বিষয়টি খতিয়ে দেখছে।
চীন ভারত রাশিয়াসহ অন্যান্য দেশেরা সতর্কতামূলক অবস্থান নিয়েছে। ভারতের সংসদে বেসামরিক নিউক্লয়ার শক্তি চুক্তি পাসের পিছনে ঘুষকারবারি ফাঁস হয়ে গেছে। আর চীনে তো লবণ নিয়ে ঘটে গেছে লঙ্কাকান্ড।
চুল্লী দুর্ঘটনাস্থল হাজার হাজার বছর বা চিরতরের জন্য মনুষ্য বা অনান্য প্রাণির বসবাসের অনুপযোগী হয়ে যায়। সজ্ঞানে মানবজাতির এমন কাজ মেনে নেয়া যায় না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।