‘‘ছেলে হোক মেয়ে হোক, দুটি সন্তাই যথেষ্ট”-জন্ম নিয়ন্ত্রণের জনপ্রিয় এ োগানটি বাড়িওয়ালাদের নাকি খুবই পছন্দ। তবে নিজের ক্ষেত্রে নয়, ভাড়াটিয়ার ক্ষেত্রে। এ কথা শুনে আমার এক সাংবাদিক বন্ধু বলেছিলেন, ভাগ্যিস দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বাড়িভাড়া করে থাকতে হয় নি। কারণ তাঁর ছেলে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন চতুর্দশ সন্তান এবং এও বলা উচিত তিনিই সর্বশেষ ছিলেন না। তাঁকে যদি বাড়িভাড়া করে থাকতে হতো, তবে তাঁর কী দশা হতো তা জানিনা।
তবে ‘গীতাঞ্জলির পাশাপাশি বাড়িওয়ালার প্যাঁচালি অথবা নৌকা ডুবির মতো ভাড়াটিয়ার ভরাডুবি শীর্ষক কোন রম্য গাঁথা বাংলা সাহিত্যে সৃষ্টি হতো। এ প্রসঙ্গে একটা কৌতুক মনে পড়ে গেল। পাঠককে কিছুটা স্বস্তি দেয়ার চেষ্টায় তা এখানে নিবেদন করলাম।
সামনের মাস থেকে বাড়িভাড়া এক হাজার টাকা বাড়িয়ে দিতে বলেছেন বাড়িওয়ালা। ভাড়াটিয়ার স্পষ্ট জবাব, তিনি দিতে পারবেন না।
বাড়িওয়ালা হুংকার ছাড়লেন, না পারলে নতুন বাড়ি দেখুন। ক’দিন পর বাড়িওয়ালা নোটিশ পাঠালেন, আমার বাড়ি যে অবস্থায় ভাড়া নিয়েছিলেন, ঠিক সে অবস্থায় রেখে যেতে হবে। নয়তো ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। নোটিশ পেয়েও বাড়ি ছাড়ার নাম গন্ধ নেই। একদিন যায়, দু’দিন যায়, মাস যায়, ছয় মাস যায়।
বাড়িওয়ালা একদিন দরোজায় এসে হাজির। তাকে দেখে ভাড়াটিয়া লজ্জিত মুখ করে সামনে এসে দাঁড়ালেন। বললেন, এ মুখ আপনাকে দেখাতে পারছি না কিছুতেই। বাড়ি ভাড়া নেয়ার সময় ১০ হাজার তেলাপোকা, দুই হাজার টিকটিকি আর হাজার খানেক মাকড়সা ছিল বাড়িতে। কিন্তু এখন পর্যন্ত পাঁচশর মতো তেলাপোকা, মাকড়সা গোটা পঞ্চাশেক আর শখানেক টিকটিকি পেয়েছি।
বাকি গুলোর অর্ডার করা হয়েছে। সাপ্লাই এলেই আপনাকে বুঝিয়ে দিয়ে আমি চলে যাবো।
বাড়িওয়ালার চোখে মুখে বিস্ময়, ওসব দিয়ে কী হবে? রসিক ভাড়াটিয়ার সরস উত্তর, ‘‘আপনিইতো বলেছেন, যে অবস্থাতে ভাড়া নিয়েছি, ঠিক সেভাবেই ছেড়ে যেতে। ”
চট্টগ্রাম মহানগরীতে গত ২০ বছরে বাড়ি ভাড়া বেড়েছে সোয়া তিন গুণ। ভাড়াটেদের সঙ্গে অধিকাংশ বাড়িওয়ালার আচরণ স্বৈরতান্ত্রিক।
বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বাসা বাড়ির ভাড়া। ২০১০ সালে গড়ে শতকরা বাড়ি ভাড়া বেড়েছে ১৪.২১ ভাগ, ২০০৯ সালে বেড়েছে ১৪.৮৫%, ২০০৮ সালে ২১.০৭%, ২০০৭ সালে ২১.৪৮%, ২০০৬ সালে ১৪.১৪%, ২০০৫ সালে ৭.৮৯%, ২০০৪ সালে ৯.৯৬, ২০০৩ সালে ৮.৪০%, ২০০২ সালে ১৩. ৪৯%, ২০০১ সালে ১৭.৪০%, ২০০০ সালে ১৫.০৮%, ১৯৯৯ সালে ১৮.২৪%, ১৯৯৮ সালে ১৪.০৯%, ১৯৯৭ সালে ১৫.০৩%, ১৯৯৬ সালে ১৭.৮৬%, ১৯৯৫ সালে ২২.৬১%, ১৯৯৪ সালে ১৬.৪৪%, ১৯৯৩ সালে ১২.১৬%, ১৯৯২ সালে ১৩.৪৩%, ১৯৯১ সালে ২১.৭৫% এবং ১৯৯০ সালে বাড়িভাড়া বৃদ্ধির হার ছিল ২৫.৭৯%।
চট্টগ্রাম শহরে বাসাভাড়া বৃদ্ধির এই প্রবণতা শুরু হয় ৯০’র মাঝামাঝিতে। বছরে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ ভাড়া বাড়ানোর নিয়ম থাকলেও ভাড়া বাড়ানো হচ্ছে বাড়িওয়ালার মর্জিমাফিক। এক হিসেবে দেখা গেছে নগরীর ৭০ শতাংশ ভাড়াটে তাদের মাসিক আয়ের ৬০ শতাংশ খরচ করেন বাড়ি ভাড়া দিতে।
বাকি ৪০ শতাংশ দিয়ে পুরো মাসের সংসার চালাতে হয়। বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি ও মালিকদের ইচ্ছে মাফিক ভিন্নতার কারণে ভাড়াটেদের নাভিশ্বাস অবস্থা। জানা গেছে সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ প্রতি পাঁচ বছর পর পর বাসা ভাড়ার পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে। কিন্তু তাতে বাসা ভাড়ার বিষয়ে এ পর্যন্ত ইতিবাচক কোন উদ্যোগ দেখা যায় নি বলে মনে করেন ভাড়াটেরা। নগরীর ঘিঞ্জি, অনুন্নত এলাকার দুই কামরা বিশিষ্ট একটি বাসার ভাড়াও বর্তমানে চার হাজার টাকার উপরে।
একটু উন্নত ও অভিজাত এলাকা হলে একই বাসার ভাড়া পড়বে ৬ হাজার টাকা। খুলশী, দক্ষিণ খুলশী, সুগন্ধা আবাসিক এলাকা, নাসিরাবাদ, হাউজিং সোসাইটি, মেহেদিবাগ, জিইসির মোড়, লালখান বাজার, আগ্রাবাদ, জামালখান, চট্টেশ্বরী, চকবাজার কলেজ রোডের মতো জায়গায় এক হাজার বর্গফুটের একটি বাসার ভাড়া ১৫ থেকে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত।
অগত্য নিরুপায় হয়ে অধিকার বুঝে নিতে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে বাড়িওয়ালাদের স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পথে নেমেছে ভাড়াটিয়ারা। ‘‘নিয়ন্ত্রণহীন বাড়ি ভাড়া বিরোধী নাগরিক আন্দোলন-এর ব্যানারে রাজপথে নেমেছে নানা শ্রেণী পেশার মানুষ। গত ২৭ ডিসেম্বর তারা চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে।
চট্টগ্রামের শিক্ষক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, ব্যবসায়ি, পেশাজীবী, সংস্কৃতিকর্মী, রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মীরা মানববন্ধন কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে অযৌক্তিক হারে বাসার ভাড়া নির্ধারণ, খেয়াল খুশি মতো ভাড়া বাড়ানো, জামানতের নামে বিপুল অংকের অগ্রিম দাবিসহ স্বৈরতান্ত্রিক আচরণের বিরুদ্ধে একাত্মতা প্রকাশ করে। চট্টগ্রাম নগরীর বাড়ি ভাড়ার বিষয়টিকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে সুনির্দিষ্ট নীতিমালার আওতায় আনতে জনমত সংগ্রহের জন্য ধারাবাহিকভাবে কর্মসূচি দেয়া হবে জানিয়ে আন্দোলনকারীদের মুখ্য সংগঠক ও পরিবেশ কর্মী শরীফ চৌহান বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই বাড়িওয়ালারা আইন কানুন নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে তাদের মর্জিমাফিক ভাড়া আদায়ের মাধ্যমে ভাড়াটিয়াদের শোষণ করছে। আমরা এর বিরোধিতা করছি। বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ যুগোপযোগী করা, চট্টগ্রামে আরো রেন্টাল কোর্ট স্থাপন, নিরাপত্তা জামানতের নামে খেয়াল খুশিমতো অগ্রিম অর্থ আদায়-করাসহ সাতটি দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।