গ্রামীণ ব্যাংক গরিব মানুষকে ঋণ দেওয়ার কথা বলে স্বল্প সুদে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসহ দাতা সংস্থার কাছ থেকে ৪৭৮ কোটি ৭৩ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকে চড়া সুদে মেয়াদি আমানত (এফডিআর) হিসেবে বিনিয়োগ করেছে। ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বরভিত্তিক হিসাব অনুযায়ী ব্যাংকটি তারা মোট সম্পদের ২৩ শতাংশই বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকে এফডিআর করে রাখে। এমনকি ব্যাংকটি বিভিন্ন দাতা সংস্থার কাছ থেকে সুদবিহীন ঋণ নিয়ে কিংবা স্বল্প সুদে ঋণ নিয়ে চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে গরিব মানুষকে উচ্চ সুদে ঋণ দেয়।
১৯৯৯ সালের ভিত্তিতে ২০০০ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালিত তদন্ত প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রথম বেরিয়ে আসে। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, 'বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকে যে পরিমাণ অর্থ মেয়াদি আমানত হিসেবে বিনিয়োগ করা হয়েছে, উহার মোট পরিমাণ ব্যাংকের মোট সম্পদের ২৩ শতাংশ।
এর বিপরীতে অর্জিত সুদের হার সাড়ে ৯ থেকে সাড়ে ১০ শতাংশ। তা ঋণ ও অগ্রিমসহ সদস্যদের কল্যাণমুখী কার্যক্রমে বিনিয়োগ করা হলে একদিকে ব্যাংকের সদস্যরা অধিকতর সুফল লাভে সক্ষম হইত এবং অন্যদিকে ব্যাংকের আয়ের পরিমাণও বৃদ্ধি পাইত। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, গ্রামীণ ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংক হইতে ১০০ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করিয়াছে যাহার সুদের হার 'ব্যাংক রেট'-এর সমপরিমাণ। তা ছাড়া বন্ড বিক্রয়ের মাধ্যমে বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ হইতে ব্যাংকের গৃহীত কর্জের বিপরীতে বর্তমান পরিমাণ (১৯৯৯) ৪৬২ কোটি টাকা। উহার সুদের হার ২ থেকে ৬ শতাংশ।
এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, বাংলাদেশ ব্যাংক, বাণিজ্যিক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ হতে যে ঋণ গ্রহণ করা হয়েছে, উহা ব্যাংকের স্বাভাবিক কার্যক্রম (গরিব মানুষের জন্য ঋণ বিতরণ) পরিচালনার জন্য নয় বরং এর উদ্দেশ্য ছিল বিনা পরিশ্রমে ঝুঁকিহীন খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে ব্যাংকের আয় বৃদ্ধি করা। ভবিষ্যতে রেয়াতি হারে (স্বল্পসুদে) কর্জ গ্রহণের মাধ্যমে প্রাপ্ত তহবিল ঋণ, অগ্রিমসহ সদস্যদের কল্যাণমুখী কর্মকাণ্ডে বিনিয়োগের জন্য ব্যাংককে পরামর্শ দেওয়া হইল। '
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনকালে দেখা যায়, ব্যাংকটি মোট ১৬টি বাণিজ্যিক ব্যাংকে ৪৭৮ কোটি ৭৩ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছিল। এর মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকে ৮৯ কোটি ১৫ লাখ, সোনালী ব্যাংকে ১১৩ কোটি ২০ লাখ, জনতা ব্যাংকে ৬৪ কোটি ২১ লাখ, অগ্রণী ব্যাংকে ১২ কোটি, রূপালী ব্যাংকে ৫০ কোটি ৯০ লাখ, বেসিক ব্যাংকে ৩২ কোটি ৪৪ লাখ, সাউথইস্ট ব্যাংকে ২৮ কোটি ৬৭ লাখ, ন্যাশনাল ব্যাংকে ৩৩ কোটি ১২ লাখ, গ্রীন্ডলেজ ব্যাংকে ১৪ কোটি ৮৫ লাখ, দি সিটি ব্যাংকে এক কোটি ১৭ লাখ, ইস্টার্নর্ ব্যাংকে ছয় কোটি ৩২ লাখ, উত্তরা ব্যাংকে আট কোটি, ইউসিবিএলে তিন কোটি ২৫ লাখ, প্রাইম ব্যাংকে ১৫ কোটি ২০ লাখ, আরব বাংলাদেশ ব্যাংকে তিন কোটি ১৫ লাখ এবং আইএফআইসি ব্যাংকে তিন কোটি ১০ লাখ টাকা মেয়াদি আমানত তথা এফডিআর হিসেবে জমা রাখে।
এ ছাড়া গ্রামীণ ব্যাংক দাতা সংস্থার দেওয়া টাকা চুক্তির শর্তের চেয়ে বেশি সুদে দরিদ্র মানুষকে ঋণ দিয়েছে।
এর ফলে একদিকে যেমন চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করে দাতাদের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে, অপরদিকে দরিদ্র মানুষও তাদের প্রাপ্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ১৯৮৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংক ডাচ্ গ্রান্ট হিসেবে চার কোটি ৪৩ লাখ টাকা পায় মাত্র ১ শতাংশ সুদে। শর্ত ছিল এ টাকা দরিদ্র মানুষ তথা গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্যদের মাঝে ৫ শতাংশ সরল সুদে ঋণ হিসেবে বিতরণ করবে। অথচ গ্রামীণ ব্যাংক ষাণ্মাসিক ভিত্তিতে ৮ শতাংশ সুদে ঋণ বিতরণ করেছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ১৯৯৯ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'ডাচ্ গ্র্যান্টের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহিত গ্রামীণ ব্যাংকের ১৯৮৫ সালের ২৪ নভেম্বর সম্পাদিত ঋণ চুক্তির ৩ নং শর্ত অনুযায়ী গ্রামীণ ব্যাংক এই স্কিমের অধীনে ইহার সদস্যদেরকে প্রদত্ত ঋণের উপর বার্ষিক ৫ শতাংশ সরল হারে সুদ চার্জ করতে পারবে।
কিন্তু পরিদর্শনকালে দেখা যায় যে, গ্রামীণ ব্যাংক ইহার সদস্যদের গৃহনির্মাণ খাতে প্রদত্ত ঋণের উপর ৮ শতাংশ হারে ষাণ্মাসিক ভিত্তিতে সুদ চার্জ করে যাহা উক্ত শর্তের পরিপন্থী। '
গরিব মানুষের কল্যাণের টাকা বিভিন্ন ব্যাংকে বিনিয়োগের বিষয়ে জানতে চাইলে গ্রামীণ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক এম শাহজাহান সম্প্রতি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমাদের সব সময় ঋণের চাহিদা থাকে না। সাধারণত শুষ্ক মৌসুমে ঋণের চাহিদা থাকে বেশি এবং বর্ষাকালে ঋণের চাহিদা কমে যায়। আমরা আমাদের পলিসি অনুযায়ীই ঋণের উদ্বৃত্ত টাকা ব্যাংকে এফডিআর হিসেবে জমা রাখি। আবার ঋণের চাহিদা বেড়ে গেলে সে টাকা তুলে নিই।
' দাতাদের দেওয়া শর্ত থেকে বেশি সুদে ঋণ দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, 'তা আমাদের পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন নিয়েই করা হয়েছে। '
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে দেখা যায়, ১৯৯৭ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত গ্রামীণ ব্যাংক তার এফডিআরের টাকা কমায়নি বরং বাড়িয়েছে। অথচ একই সময়ে অন্যান্য প্রকল্পে টাকার চাহিদা থাকায় খানিকটা উচ্চ সুদেই (এফডিআরের চেয়ে কম) টাকা ধার করেছে, যা ব্যাংকটির সদস্যদের ঋণের বোঝা ভারী করে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।