হাঁটা পথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে হে সভ্যতা। আমরা সাত ভাই চম্পা মাতৃকাচিহ্ন কপালে দঁড়িয়েছি এসে _এই বিপাকে, পরিণামে। আমরা কথা বলি আর আমাদের মা আজো লতাপাতা খায়।
ক্ষুদ্রঋণের বৃহৎ বাণিজ্য
- আনু মুহাম্মদ
ক্ষুদ্রঋণের বাণিজ্যিক সাফল্য এখন বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। বাংলাদেশ ছাড়িয়ে বহু দেশে এখন ক্ষুদ্রঋণের বাণিজ্যিক তৎপরতা নতুন এক অর্থনৈতিক ক্ষেত্র হিসাবে ক্রমান্বয়ে বিস্তৃত হচ্ছে।
গ্রামীণ ব্যাংক ও মুহাম্মদ ইউনূসও ব্যবসা ক্ষেত্রে বিশ্বের শীর্ষ ব্যক্তিদের অন্যতম হিসাবে এখন নন্দিত।
যদিও বিভিন্নরূপে ক্ষুদ্রঋণ অনেক আগে থেকেই পরিচিত; কিন্তু গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে ড. মুহাম্মদ ইউনূসই একে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দিয়েছেন এবং বিশ্ব পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। বাংলাদেশের ক্ষুদ্রঋণ ও গ্রামীণ মডেল এখন বহু দেশে অনুসৃত হচ্ছে। বাংলাদেশে এর বিস্তার যেভাবে ঘটেছে তাতে বাংলাদেশ এখন ‘ক্ষুদ্রঋণের মডেল’ হিসাবে উন্নয়ন অর্থশাস্ত্রের এবং উন্নয়ন আলোচনায় বিশেষ মনোযোগ লাভ করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ২ কোটিরও বেশি মানুষ এখন ক্ষুদ্রঋণের সঙ্গে যুক্ত, যাদের মধ্যে দেড় কোটি গ্রহীতা এখনও সক্রিয় আছেন।
একই সূত্রে অন্য আরেক হিসাবে বলা হয়েছে, একই ব্যক্তি একাধিক সংস্থার কাছ থেকে ক্ষুদ্রঋণ নেন, তাদের শতকরা হার ৩৩ ভাগ, এই বিবেচনায় মোট ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতার সংখ্যা ১ কোটি।
মোট ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতাদের শতকরা ৭০.৩৬ ভাগ এবং সক্রিয় ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতাদের শতকরা ৮৫.৬৬ ভাগ মাত্র চারটি প্রতিষ্ঠানে কেন্দ্রীভূত। এগুলো হলো গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাক, আশা এবং প্রশিকা। গত বছর মোট ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ হয়েছে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৫ হাজার কোটি টাকাই বিতরণ হয়েছে গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাক ও আশার মাধ্যমে।
২০০৯ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত গ্রামীণ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে প্রদত্ত হিসাব অনুযায়ী, এই প্রতিষ্ঠান কাজ করে ৮৩ হাজার ৩শ ৪৩টি গ্রামে। মোট কর্মীসংখ্যা ২৪ হাজার ৩শ ২৫ জন। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে এ পর্যন্ত গ্রামীণ ব্যাংক ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ করেছে মোট ৪০ হাজার ৭শ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩৬ হাজার ৫শ কোটি টাকা আদায় করা হয়েছে। অবশ্য এর মধ্যে রিশিডিউল বা নতুন ঋণ দিয়ে পুরনো ঋণ পরিশোধের হার ধরা হয়নি।
একটি প্রকল্প আকারে গ্রামীণ ব্যাংক ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম শুরু করেছিল। এই প্রকল্প থেকেই একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে ১৯৮৩ সালে গ্রামীণ ব্যাংকের জন্ম হয়। প্রতিষ্ঠানের তখন একমাত্র তৎপরতা ক্ষুদ্রঋণ, গ্রহীতা গরিব মানুষ এবং প্রধানত নারী। এই ক্ষুদ্রঋণ দিয়েই গ্রামীণ ব্যাংক যে বিশাল বাণিজ্যিক সাফল্য লাভ করেছে তার প্রমাণ এই আয় থেকেই আরও বহুসংখ্যক বাণিজিক প্রতিষ্ঠানের উদ্ভব।
গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পর্কিতভাবে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানগুলো হলো :
গ্রামীণফোন, গ্রামীণ টেলিকম, গ্রামীণ কমিউনিকেশন্স, গ্রামীণ সাইবারনেট, গ্রামীণ সলিউশন্স, গ্রামীণ আইটি পার্ক, গ্রামীণ ইনফরমেশন হাইওয়েজ, গ্রামীণ স্টার, এডুকেশন, গ্রামীণ বাইটেক, গ্রামীণ উদ্যোগ, গ্রামীণ সামগ্রী, গ্রামীণ নিটওয়্যার, গণস্বাস্থ্য, গ্রামীণ টেক্সটাইল মিলস, গ্রামীণ শিক্ষা, গ্রামীণ ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট, গ্রামীণ ব্যবসা বিকাশ, গ্রামীণ-ট্রাস্ট, গ্রামীণ হেলথকেয়ার ট্রাস্ট, গ্রামীণ হেলথকেয়ার সার্ভিস, গ্রামীণ ডেনন ফুড, গ্রামীণ ডিওলিয়া ওয়াটার, গ্রামীণ মৎস্য, গ্রামীণ কৃষি ফাউন্ডেশন, গ্রামীণ শক্তি প্রভৃতি।
এই প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্ভব ও বিকাশের সঙ্গে গ্রামীণ ব্যাংকের নাম, প্রভাব, অর্থ ও ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতার নেটওয়ার্কের সম্পর্ক প্রত্যক্ষ। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে বিদেশি প্রতিষ্ঠান বা বহুজাতিক পুঁজি যুক্ত। এগুলোর মধ্যে শীর্ষস্থানে আছে গ্রামীণফোন, যার শতকরা ৬০ ভাগেরও বেশি মালিকানা নরওয়ের একটি মোবাইল কোম্পানি টেলিনরের। গ্রামীণফোনের মূল পরিচালনা টেলিনরের হাতে। সর্ববৃহৎ মোবাইল কোম্পানি হিসাবে ২০০৭ সালে এটি মোট আয় করেছিল প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা।
গ্রামীণফোনের সিইও গত ১১ ফেব্রুয়ারি ২০০৯-এ এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, ২০০৭ সালে যেখানে কোম্পানির নিট মুনাফা ছিল ১শ ৩০ কোটি টাকা তা ২০০৮ সালে ৩শ ২০ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। ২০০৮ সালে এর গ্রহীতার সংখ্যা ছিল ২ কোটিরও বেশি।
এই গ্রামীণফোনের যাত্রা শুরু হয় গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতাদের ওপর ভর করেই। প্রথমে সাড়ে তিন লাখ গ্রামীণ ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতাকে গ্রামীণ ব্যাংক ক্ষুদ্রঋণ দেয় এই মোবাইল ফোন কেনার জন্য। গরিব মানুষের হাতে মোবাইল পৌঁছে দেওয়ার প্রকল্পের কথা বলে রাষ্ট্রীয় রেললাইন সংযোগ সুবিধা, কর মওকুফসহ নানা সুবিধাও তারা গ্রহণ করে।
এরপর গ্রামীণফোনের কার্যক্রম দ্রম্নত বিস্তৃতি লাভ করে, যার অধিকাংশ গ্রাহক এখন শহরের। বাংলাদেশে বিনিয়োগের মাধ্যমে টেলিনরের যে মুনাফা তা অন্য সব দেশের তুলনায় অনেক বেশি। আগে গ্রামীণফোনের লোগো ছিল গ্রামীণ কিষাণ-কিষাণী। যে দিন ড. ইউনূস নোবেল পুরস্কার পেলেন তার পরদিনই এই লোগো পাল্টে টেলিনরের লোগো তাতে যুক্ত করা হলো।
স্বাধীনতা-উত্তরকালে ব্র্যাকও খুব স্বল্প পরিসরে তার কাজ শুরু করে।
তাদের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্রঋণই ছিল প্রধান আয় উপার্জনকারী খাত। এই ক্ষুদ্রঋণের ব্যবসায়িক সাফল্য ব্র্যাককেও বিশাল বাণিজ্যিক ‘গ্রুপ অব কোম্পানিজ’-এ পরিণত করেছে। এখানেও বহুজাতিক পুঁজি জায়গা করে নিয়েছে। ব্র্যাক ব্যাংকে উল্লেখযোগ্য অংশীদারিত্ব আছে খোদ বিশ্বব্যাংকের আইএফসির।
বহুজাতিক পুঁজির নতুন আবিষ্কার
ক্ষুদ্রঋণ বহুদিন পর্যন্ত একটি বিকল্প, অনানুষ্ঠানিক ব্যাংকিং হিসাবেই পরিচিতি পেয়েছে।
একে দেখা হয়েছে গরিবের জন্য একটি সহায়তা কার্যক্রম হিসাবে। ৮০ দশকে এর সাফল্যের গতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিশ্বে লগ্নি পুঁজির মালিক সংগঠকদের। কেননা ততদিনে বিশ্বজুড়ে পুঁজি বিনিয়োগের ভিন্ন গতিমুখ অনেক স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থায় শিল্পপুঁজির চেয়ে বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে অর্থকরী বিনিয়োগ, ফটকা পুঁজি। পুঁজিবাদের রক্ষাকবচ হিসাবেই যে ঋণ অর্থনীতির প্রসার ঘটেছিল তা ততদিনে এক দানবীয় আকার ধারণ করেছে কিন্তু তার বিনিয়োগ ক্ষেত্র হয়ে পড়েছে সঙ্কুচিত।
শিল্পোন্নত দেশের নাগরিকদের আয়ের চেয়ে ঋণ অনেক বেশি। সেই বাজারের অধিক সম্প্রসারণের সম্ভাবনা সঙ্কুচিত হওয়ার মুখে পুঁজি ঝুঁকেছে নানা বিপজ্জনক ফটকাবাজারি তৎপরতায়। এই সময়েই ক্ষুদ্রঋণের সাফল্য এক বিশাল বাজারকে বৃহৎ বিনিয়োগকারীদের সামনে হাজির করে। গরিবরাও ঋণের বাজার হতে পারে এটা ততদিনে প্রমাণিত। কাজেই শুরু হয় নতুন পর্ব।
১৯৯৫ সালে বিশ্বব্যাংক ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে তার তৎপরতা শুরু করে। ১৯৯৬ সালে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ অফিস এ দেশের সব এনজিওকে বাণিজ্যিক অর্থবাজারে যুক্ত করার জন্য চাপ সৃষ্টি করে। সরকারকে ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানায়, যাতে বৃহৎ এনজিওগুলো নিজেরাই ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং ক্ষুদ্র এনজিওগুলোর মাধ্যমে গরিব মানুষের সঞ্চয় এই বৃহৎ বাণিজ্যিক তৎপরতায় যুক্ত করে।
১৯৯৭ সালে ওয়াশিংটনে প্রথম আন্তর্জাতিক ক্ষুদ্রঋণ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এর উদ্যোক্তা এবং সহযোগীদের অন্যতম ছিল বিশ্বব্যাংক, ইউএসএইড, ইন্টার-আমেরিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, ইউএনডিপি এবং সিটি ব্যাংক।
১৯৯৮ সালে ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত ক্ষুদ্রঋণ বিষয়ক সম্মেলনে আংকটাড যে রিপোর্ট প্রকাশ করে সেখানে বলা হয়, ‘ক্ষুদ্রঋণের বিষয়টি এতদিনের অব্যবহৃত এক বিশাল সম্ভাব্য বাজারের সন্ধান দিয়েছে। ১০ হাজার কোটি ডলার বা প্রায় ৭ লাখ কোটি টাকার সম্ভাব্য ঋণবাজার এটি। এগুলোর মধ্য দিয়ে বলিভিয়ার বানকোসল এবং কেনিয়ার কে-রেপ পৃথিবীর বৃহত্তম ও শ্রেষ্ঠ ব্যাংকগুলোর চেয়েও অধিক মুনাফাযোগ্যতা দেখিয়েছে। ২০ বছর আগে যেটি আন্দোলন আকারে শুরু হয়েছিল সেই ক্ষুদ্রঋণ এখন বিশাল শিল্প, এটি এখন মূলধারার অর্থবাণিজ্য তৎপরতার অংশ হয়ে গেছে। ’
অতএব খুবই স্বাভাবিকভাবে জাতিসংঘ ২০০৫ সালকে আন্তর্জাতিক ক্ষুদ্রঋণ বর্ষ হিসাবে ঘোষণা করে।
একই বছর সিটি ব্যাংক প্রাথমিকভাবে লন্ডন, নিউইয়র্ক, ইন্ডিয়া এবং কলম্বিয়া ‘সিটি মাইক্রোফিন্যান্স’ খুলেছে। ২০০৬ সালে যে ক্ষুদ্রঋণ সম্মেলন হয় যেখানে বৃহৎ বহুজাতিক ব্যাংক ও সংস্থার সমাবেশ ঘটে। এই সম্মেলনের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিল মনসান্টো ও সিটি গ্রম্নপ। এ বছরই ড. মুহাম্মদ ইউনূস ক্ষুদ্রঋণের সাফল্যের জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন।
২০০৭ সালে বিশ্বব্যাংকের অঙ্গসংগঠন বাণিজ্যিকভাবে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান আইএফসি এশিয়া আফ্রিকায় মার্কিন বৃহৎ ব্যাংক স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের মাধ্যমে ক্ষুদ্রঋণ প্রসারের জন্য ৩শ ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে।
একই বছর জেপি মরগান তার বিনিয়োগ ক্ষেত্রের একটি বিশেষ অঙ্গ হিসাবে ক্ষুদ্রঋণ তৎপরতা শুরম্ন করেছে।
এফাসংস্থা থেকে ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে বৃহৎ বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়ার অনেক দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে বিশ্বে। বিভিন্ন পুঁজি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান যেগুলো বর্তমান বিশ্ব অর্থনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টির পেছনে অন্যতম দুর্বৃত্ত ভূমিকা পালনকারী হিসাবে চিহ্নিত তারাও ক্ষুদ্রঋণে বিনিয়োগ শুরু করেছে। মেক্সিকোর কমপার্টোমাস ৬০ লাখ ডলার দিয়ে ক্ষুদ্রঋণ বাণিজ্য শুরু করার পর এখন বিলিয়ন ডলার প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ইউএসএইডও এর সঙ্গে যুক্ত বলে ফিন্যান্সিয়াল টাইমস এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে জানিয়েছে।
এর মুনাফার হার এখন শতকরা প্রায় একশ ভাগ।
উপরের বিশ্লেষণ থেকে এটা স্পষ্ট হওয়ার কথা যে, ক্ষুদ্রঋণ এখন বৃহৎ বাণিজ্যের অন্যতম মাধ্যম হিসাবে স্বীকৃত। গ্রামীণ ব্যাংক ও মুহাম্মদ ইউনূস নিশ্চয়ই পুঁজি বিনিয়োগের উচ্চ মুনাফার এই খরারকালে সেখানে গরিব জনগোষ্ঠীকে বৃহৎ বাজার হিসাবে ব্যবহারের উপায় হিসাবে প্রতিষ্ঠার জন্য কৃতিত্বের দাবিদার।
ক্ষুদ্রঋণের দারিদ্র্য ও ক্ষমতায়ন
কিন্তু যে মূল দাবি নিয়ে ক্ষুদ্রঋণের যাত্রা শুরু, যে মূল দাবির মোড়কে ক্ষুদ্রঋণের বৃহৎ বাণিজ্য ক্রমপ্রসারমাণ, সেই দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্রঋণের সাফল্য কতটুকু? বৃহৎ বাণিজ্যের সাফল্যের আলোকোজ্জ্বল দুনিয়ায় এ ক্ষেত্রে এসে বড় আকারে হোঁচট খেতে হয়।
২০০৬ সালে মুহাম্মদ ইউনূস দাবি করেছেন গ্রামীণ ব্যাংকের নিজস্ব অভ্যন্তরীণ জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশে শতকরা ৭৫ ভাগ দরিদ্র মানুষ ক্ষুদ্রঋণের আওতায় আছে এবং এর ঋণগ্রহীতাদের শতকরা ৫৬ ভাগ দারিদ্র্যসীমার উপরে উঠে এসেছে।
কিন্তু গ্রামীণ ব্যাংকের ওয়েবসাইট (২০০৯) থেকে প্রাপ্ত হিসাব বিশ্লেষণ করে ভিন্ন চিত্র পাওয়া যায়। একদিকে এখানে বলা হচ্ছে ঋণগ্রহীতাদের শতকরা ৬৫ ভাগ দারিদ্র্যসীমা অতিক্রম করেছে। অন্যদিকে বিভিন্ন শাখার কার্যক্রমের তথ্য বিশ্লেষণে গ্রামীণ ব্যাংকের সাফল্যের তালিকায় দেখা যায় মুনাফা অর্জনে সাফল্যের হার সবার ওপরে এবং দারিদ্র্যসীমার ওপরে ঋণগ্রহীতাদের নিয়ে আসার হার সবার নিচে। গ্রামীণ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী এর শতকরা ৮১.৪০ ভাগ শাখা মুনাফা অর্জন করেছে, শতকরা ৭৪.৩৭ ভাগ শাখা শতকরা একশ ভাগ ঋণ আদায় করেছে। এবং ঋণগ্রহীতারা দারিদ্র্যসীমার ওপর উঠে এসেছে এ রকম শাখার শতকরা হার ২ ভাগের সামান্য ওপরে।
২০০৭ সালে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পরিচালিত এক সমীক্ষার মাধ্যমে কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ ও অন্যরা ক্ষুদ্রঋণের বিভিন্ন দিক পরীক্ষা করে দেখেছেন, তাদের সমীক্ষাধীন অঞ্চলগুলোতে শতকরা ৪০ ভাগেরও বেশি উত্তরদাতা কিস্তি শোধ করতে অক্ষম। এদের মধ্যে শতকরা ৭২.৩ ভাগ উচ্চ সুদে মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে কিস্তি শোধ করেছে এবং শতকরা ১০ ভাগ নিজের ছাগল বা অন্যান্য জিনিসপত্র বিক্রি করে কিস্তি শোধ করতে বাধ্য হয়েছে। যদিও নারীর ক্ষমতায়ন ক্ষুদ্রঋণ মডেলের অন্যতম দাবি কিন্তু এই সমীক্ষা থেকে দেখা গেছে গৃহীত ঋণের ওপর শতকরা মাত্র ১০ ভাগ নারী ঋণগ্রহীতার নিয়ন্ত্রণ থাকে, শতকরা ৯০ ভাগ নারীকেই ঋণের টাকা তুলে দিতে হয় স্বামী, ভাই বা অন্যকোনও সদস্যের হাতে। ক্ষুদ্রঋণ এখন অনেক ক্ষেত্রে যৌতুকের বিকল্প। তার ফলে শতকরা ৮২ ভাগ উত্তরদাতা (নারী) জানিয়েছেন, ঋণগ্রহণ শুরম্নর পর থেকে যৌতুকের চাপ আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থীরা ১৯৯৬, ২০০৪ ও ২০০৭ সালে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের একটি গ্রামের ওপর সমীক্ষা চালিয়েছে। এসব সমীক্ষায় দেখা গেছে, শতকরা মাত্র ৫ থেকে ৯ ভাগ ঋণগ্রহীতা এই ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে নিজেদের অবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে পেরেছে। শতকরা প্রায় ৫০ ভাগ ঋণগ্রহীতার অবস্থা একইরকম আছে কিন্তু তাদের অন্যান্য উৎস থেকে ঋণ গ্রহণ করতে হয়েছে। শতকরা ৪০ থেকে ৪২ ভাগের অবস্থার অবনতি ঘটেছে। যাদের অবস্থার উন্নতি হয়েছে তাদের অধিকাংশের অন্যান্য আয়ের উৎস ছিল।
এর আগে বিআইডিএস পরিচালিত এক সমীক্ষাতেও দেখা গেছে, ক্ষুদ্রঋণের কার্যক্রমের মাধ্যমে শতকরা মাত্র ৫ ভাগ ঋণগ্রহীতা নিজেদের অবস্থার উন্নতি করতে পেরেছেন।
বছর দশেক আগে একটি গ্রামে দীর্ঘসময় অবস্থান করে নৃবিজ্ঞানী আমিনুর রহমান ক্ষুদ্রঋণের সঙ্গে সম্পর্কিত পরিচালনা কাঠামো, ঋণগ্রহীতাদের সামাজিক অবস্থান, টানাপড়েন, নারী ঋণগ্রহীতাদের সঙ্গে ব্যাংকের সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা কাজ পরিচালনা করেছেন। গবেষক দেখেছেন, যদিও ঋণগ্রহীতা অধিকাংশ নারী কিন্তু ব্যাংক পরিচালনা বা ঋণ আদায় কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের অধিকাংশ পুরুষ। এর কারণ হিসাবে ব্যাংক কর্মকর্তারাই বলেছেন, কিসিত্ম আদায় করার ক্ষেত্রে মেয়েরা যথেষ্ট শক্ত হতে পারে না বলে পুরম্নষদেরই এ কাজে রাখা হয়।
এই গ্রামে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক ঋণ বরাদ্দ করা হয় ধানভানার কাজে (৩৯ শতাংশ) কিন' এই কাজে কোনও ঋণই ব্যবহার করা হয় না।
সুদী ব্যবসার জন্য কোনও ঋণ দেওয়া না হলেও এ কাজেই সবচেয়ে বেশিসংখ্যক ঋণ ব্যবহার করা হয়। গেরস্থালি কাজ এমনকি যৌতুক মেটানোর জন্য কোনও ঋণ দেওয়া না হলেও সে কাজেও ক্ষুদ্রঋণ ব্যবহার করা হয় উল্লেখযোগ্য মাত্রায়।
নিপীড়ন ও নিরাপত্তাহীনতার জাল
ক্ষুদ্রঋণের সুদ বিভিন্ন হিসাবে এবং সংস্থা ও ক্ষেত্র ভেদে গড়ে শতকরা ২০ থেকে ৪০ ভাগ। ধরে নেওয়া হয় যে, যারা এই ক্ষুদ্রঋণ নেবেন তারা এই টাকা ব্যবহার করে নিয়মিতভাবে এই মাত্রায় আয় করবেন যে, প্রতিসপ্তাহে কিস্তি দিতে সক্ষম হবেন এবং আরও বাড়তি থাকবে। এই ধরে নেওয়া চিত্র ঠিক হলে এতদিনে আমরা আসলেই সুফল পেতাম।
প্রকৃতপক্ষে- সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস গরিব মানুষের জীবন ও চারপাশ অনুকূল থাকবে এ রকম পরিস্থিতি কল্পনা করাও কঠিন। তাই যেকোনও রকম অসুস্থতা, ক্ষুদ্রঋণের টাকায় কেনা রিকশা বা ভ্যান অচল হওয়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অর্থনীতির মন্দা, বাজারের বৈরিতা, জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি যেকোনও একটি ঘটনা ঘটলেই পুরো মডেলটি ভেঙে পড়ে। একবার কিসিত্ম দিতে ব্যর্থ হলে সেটা সামাল দেওয়াই কঠিন হয়ে পড়ে। তারপর একে একে নতুন ঋণ ঘাড়ে চাপে। এখন নতুন ঋণ দিয়ে পুরনো কিস্তি শোধ করার হিসাব বাদ দিলে ক্ষুদ্রঋণ পরিশোধের হার দেখা যাবে শতকরা ৬০ ভাগেরও কম।
একের পর এক ঋণের বোঝা ঘাড়ে চাপায় অসহ্য হয়ে অনেকেই তখন গ্রাম ছাড়ছেন। গ্রামে ক্ষুদ্রঋণসহ দারিদ্র্য বিমোচনের এতসব কর্মসূচি চলবার পরও গ্রাম থেকে শহরে কাজের খোঁজে, বাঁচার চেষ্টায় অবিরাম মানুষের প্রবাহ এমনি এমনি ঘটেনি।
যেকোনও একটি প্রাকৃতিক বিপর্যয় ক্ষুদ্রঋণগ্রহণকারীদের জীবন কীভাবে বিপর্যস্ত করতে পারে তার সাম্প্রতিক উদাহরণ সিডর। উপকূলীয় অঞ্চলে যে রকম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে মানুষ বাস করে সেখানে তাদের পেশাগত নিরাপত্তা, জীবনের নিরাপত্তা, ঘরের নিরাপত্তা এসব বিষয়ে কোনও কার্যকর উদ্যোগ না থাকলেও ক্ষুদ্রঋণের বিস্তার ঘটেছে ব্যাপক।
সিডরের ভয়ঙ্কর আঘাতে যে লাখ লাখ মানুষ সর্বস্ব হারিয়েছে তাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল ক্ষুদ্রঋণগ্রহীতা।
সম্প্রতি দক্ষিণ-দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে একশনএইড পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৪২টি ক্ষুদ্রঋণদানকারী সংস্থা সেসব অঞ্চলে কাজ করছে এবং ১৫ লাখ মানুষের কাছে প্রায় ১ হাজার ২শ কোটি টাকা ঋণ আছে। এসব সংস্থার মধ্যে ব্র্যাক, আশা ও গ্রামীণ ব্যাংকও আছে। একই গবেষণায় দেখা গেছে, ঋণের কিস্তি পরিশোধের চাপ এতই প্রবল ছিল যে, অনেকেই প্রাপ্ত রিলিফ সামগ্রী, সরকার প্রদত্ত গৃহনির্মাণ সুবিধা বিক্রি করে কিস্তি শোধ করেছেন। অনেকে নতুন ঋণ নিয়ে পুরনো কিস্তি শোধ করেছেন। এই চিত্র অস্বাভাবিক বা বিচ্ছিন্ন নয়।
গত বছরে প্রকাশিত আরেকটি গবেষণাপত্রে লামিয়া করিম নাকছাবি গরম্ন, মুরগি, ঘরের টিন, আসবাবপত্র বিক্রি করে ঋণের কিস্তি পরিশোধের একাধিক উদাহরণ দিয়েছেন। এ ধরনের বহু ঘটনার সাক্ষী বহু গবেষক ও সাংবাদিক যার অল্পই প্রকাশিত।
ক্ষুদ্রঋণের সাফল্য ও সীমা এতদিনে অনেক স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ ক্ষুদ্রঋণের গবেষণাগার হিসাবে এখন স্বীকৃত। প্রায় তিন দশকে ক্ষুদ্রঋণের চাষ ও বিকাশের অভিজ্ঞতায় এর ফলাফলও এখন অনুধাবন করা সম্ভব।
যা এখন স্পষ্ট
প্রথমত, ক্ষুদ্রঋণ প্রক্রিয়া ব্যাংকিং খাতে এক নতুন সংযোজন। অর্থকরী খাতে এক বিপুল সম্ভাবনা হাজির করেছে এই মডেল। ইতিমধ্যে যা বৃহৎ পুঁজি বিনিয়োগকারীদের যুক্ত করেছে এবং বৃহৎ বাণিজ্যের মধ্য দিয়ে বিপুল মূলধন সংবর্ধন করতে সম্ভব হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, ক্ষুদ্রঋণ প্রক্রিয়া বৃহৎ বাণিজ্যিক সংস্থা এমনকি বহুজাতিক পুঁজির বিনিয়োগ ও বাজার সঙ্কট মোকাবেলায় একটি কার্যকর মাধ্যম হয়েছে।
তৃতীয়ত, গ্রামীণ অর্থনীতি অনেক বেশি বাজারমুখী হয়েছে।
ক্ষুদ্রঋণ প্রক্রিয়া গ্রামীণ নারীদের আরও বেশি বেশি বাজারের সঙ্গে যুক্ত করেছে।
চতুর্থত, এই ঋণ প্রক্রিয়া অসংখ্য মানুষকে নতুন করে ঋণগ্রস্ত করেছে, অনেককে সুদের মহাজন বানিয়েছে।
পঞ্চমত, খুব ক্ষুদ্র অংশ তারাই ক্ষুদ্রঋণ ব্যবহার করে কিছু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে পেরেছে, যাদের আয়ের অন্যান্য উৎস আছে।
অতএব বৃহৎ বাণিজ্যের একটি সফল মাধ্যম হিসেবে ক্ষুদ্রঋণ মডেল অবশ্যই স্বীকৃতি পেতে পারে। কিন্তু দারিদ্র্য বিমোচন কিংবা নারীর ক্ষমতায়নে এর সাফল্যের দাবি ভ্রান্ত ও প্রতারণামূলক।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।