আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ক্ষুদ্রঋণের করতলে আমাদের প্রজন্মের পাঁজর



ক্ষুদ্রঋণের করতলে আমাদের প্রজন্মের পাঁজর ফকির ইলিয়াস =============================== বিলাত থেকে কবিতা লিখে ই-মেইলে পাঠিয়েছেন অনুজপ্রতিম কবি আবু মকসুদ। খুবই তীর্যক তার কবিতার ভাষা। কবি শঙ্কিত। বেদনায় ভাঙছে তার পাঁজর। আমাদের নোবেল লরিয়েট ড. মুহাম্মদ ইউনূস অর্থ কেলেঙ্কারির অভিযোগে একটি মিডিয়ায় অভিযুক্ত হয়েছেন।

সংবাদটি এখন বিশ্বব্যাপী আলোচিত। আবু মকসুদ তার কবিতায় লিখেছেন- 'শীতঘুমে আমরা স্বপ্ন দেখি ফুলবাড়িয়ায়/সীমাবদ্ধ দস্তানায় লেগে থাকে কতিপয়/সামাজিক ব্যবসার দাগ/ মধু-মঞ্জরির প্রলোভন, ক্ষুদ্রঋণের জাঁতাকলে/ ধর্ষিত উঠোন কাঁপে বুকে নিয়ে গ্রামীণ ইভটিজিং। ' [কাছে আসে অন্তস্থ আকাশ/ আবু মকসুদ] কবি আবু মকসুদের মতো আমিও শঙ্কিত। হতাশাগ্রস্ত। এসব কী শুনছি? বাংলাদেশের মানুষের গর্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূস সত্যি কী এমন কেলেঙ্কারি করেছেন? না হলে এমন খবর, অনুসন্ধিৎসু প্রতিবেদন মিডিয়া ফলাও করে প্রচার করবে কেন? বিষয়টি এখন আর সাধারণের ভাবনার বলয়ে নয়।

গোটা বাংলাদেশ এ নিয়ে তার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। পুরো জাতি জানিয়ে দিয়েছে- না, এমন কথা আমরা মানতে রাজি না। এ ঘটনা মিথ্যা প্রমাণিত হোক। জাতির শির সমুন্নত থাকুক। যে গ্রামীণ ব্যাংক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু; তারা বলেছেন এ তথ্য মিথ্যা।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়েই তহবিল ট্রান্সফার করেছেন। ঘটনা বিষয়ে অভিমত জানিয়েছেন দেশের মাননীয় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি বলেছেন, উভয় পক্ষের সমঝোতার মাধ্যমে যদি ফান্ড ট্রান্সফার হয়ে থাকে তবে তা দোষের কিছু নয়। এদিকে নরওয়ের যে নির্মাতা 'ক্ষুদ্রঋণের ফাঁদে' তথ্যচিত্রটি নির্মাণ করেছেন তিনি বলেছেন, ড. ইউনূস তার প্রশ্নের জবাব দেননি। তাই তিনি যা তথ্য পেয়েছেন, তা দিয়েই ডকুমেন্টারিটি নির্মাণ করেছেন।

ঘটনা সেখানেই থেমে নেই। এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ পলিটিক্যাল রিয়েকশন জানিয়েছেন এলজিআরডি মন্ত্রী, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। তিনি বলেছেন, এ সংবাদে আওয়ামী লীগ খুবই ব্যথিত ও শঙ্কিত। কারণ, বিশ্ববাসী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে মডেল হিসেবে জানেন। বাংলাদেশের যোগ্যতার প্রতিনিধিত্ব করেন ড. ইউনূস।

এদিকে সিলেটে এক সমাবেশে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ বলেছেন, শেখ হাসিনা ২০০৭ সালেই ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে 'সুদখোর' আখ্যায়িত করেছিলেন। এ অর্থ কেলেঙ্কারির খবরটি সেই সত্যই প্রমাণ করছে। প্রায় একই সময়ে মুখ খুলেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, এ বিষয়ের তদন্ত হবে। এবং বাংলাদেশ ব্যাংক এ ফান্ড ট্রান্সফারের বিষয়টি খতিয়ে দেখছে খুব দ্রুত।

তিনি যে কোন অবৈধ ভোগবাদিতার নিন্দাও জানিয়েছেন। দুই. বলার অপেক্ষা রাখে না, প্রায় ১৬ কোটি মানুষকে এ মহান বিজয়ের মাসে একটি কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছেন দেশের নোবেল লরিয়েট, খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস। চ্যালেঞ্জটি হচ্ছে এই, ইউনূসকেই প্রমাণ করতে হবে তিনি এমন কেলেঙ্কারি করেননি। এমন পুকুর চুরির কোন হোতার সতীর্থ নন বাংলাদেশের খেটে খাওয়া ১৬ কোটি মজলুম মানুষ। খুবই সবিনয়ে বলি, আমি অর্থনীতি 'অ', 'আ' মোটেই বুঝি না।

তবে বেড়ে উঠেছি শোষক আর শোষিতের মুখোমুখি অবস্থান নেয়া একটি বদ্বীপ থেকে। দেখেছি খুব কাছে থেকে শ্রেণী বৈষম্যের জাঁতাকল। আমি সেই মাটির সন্তান, যে মাটির পূর্বপুরুষরা কাবুলিওয়ালাখ্যাত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে ভিটে আঁকড়ে থেকেছেন আমৃত্যু পর্যন্ত। আমি আমার লব্ধ অভিজ্ঞতার আলোকে মনে করি বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণ প্রথা সেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রেতাত্মা মাত্র। গ্রামীণ ব্যাংকের নামে সুদ ব্যবসা করে কারা প্রকৃত মুনাফাবাজি করছে, তা এখন প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের খুব অজানা নয়।

তারপরও কথা হচ্ছে মানুষ এই ক্ষুদ্রঋণের করতলে নিজ বুকের পাঁজর তুলে দিচ্ছে কেন? দেয়ার কারণটি হচ্ছে মানুষের সামনে খুব বেশি পছন্দ খোলা নেই। মানুষের অন্য কোন চয়েজ না থাকার কারণে, অনন্য উপায় হয়ে গ্রামীণ ব্যাংকের চড়া সুদকেই কবুল করতে হচ্ছে। হজম করতে হচ্ছে সামাজিক নিপীড়ন। এটা কে না জানে বাংলাদেশে আমলাতান্ত্রিক আধিপত্যবাদ দানবীয় কায়দায় মানুষের বুকের ওপর চেপে বসে আছে। কৃষি ব্যাংক কিংবা শিল্প ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার ধকলের কথা গ্রামের মানুষ স্মরণ করতেও ভয় পান।

হালে তা কিছুটা সচল হলেও এখনো কাঁটা মুক্ত নয়। দেশের মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে ওঠে আসা বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সেসব বিষয় অজানা নয়। অজানা নয়, বর্তমান কৃষিমন্ত্রী অগি্নকন্যা মতিয়া চৌধুরীরও। আমার বিনীত আরজটি হচ্ছে এই, তারা কি এই পথ সুগম করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টার সব ধাপ অতিক্রম করতে পেরেছেন? না পারেননি। যদি পারতেন তবে বাংলাদেশের কৃষক-শ্রমিকের জীবনচিত্র অন্যরকম হতে বাধ্য হতো।

বাংলাদেশে ডিজিটাল বিপ্লবের একটি ধাপ হিসেবে মোবাইল ফোনের সয়লাভতন্ত্র কায়েম হয়েছে। এখন অনেকে দুই-তিনটি মোবাইল ফোনও রাখেন। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এসব নিম্নবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্তরা এভাবে দুই-তিনটি মোবাইল ফোন হাতে রাখার খরচ জোগান কীভাবে? আমি একজন মধ্যবিত্ত অভিবাসী হিসেবে খুব সত্য কথাই বলি, স্ত্রী-কন্যাদ্বয় ও নিজের চারটি মোবাইল ফোনের মাসিক প্যাকেজ বিল দিতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়। অথচ দিব্যি দেখি বাংলাদেশে থাকা অনেক বেকার ও দুই-তিনটি মোবাইল নম্বর দিয়ে বলে, 'আমাকে গ্রামীণের নম্বরে না পেলে একটেলের নম্বরে পাবেন'। এই হচ্ছে ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পের জোয়ালের তলে প্রজন্মের বসবাস চিত্রের খ-নামচা।

ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার চিত্র দেখিয়ে যারা সাপুড়ের তালিয়া বাজাচ্ছেন, তারা মূলত চক্রবৃদ্ধি হারের প্রজন্মকে বন্দী করতে চাইছেন সীমাবদ্ধতায়। কিন্তু খুব অবাক লাগে দেশের সুশীল সমাজ নামে পরিচিত শ্রেণীটি এই দীর্ঘমেয়াদি শোষণতন্ত্রের বিরুদ্ধে খুব একটা সোচ্চার নয়। দেশে তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ রক্ষা কমিটি গঠিত হয়েছে। এটা খুবই ভালো সংবাদ। কিন্তু মুক্তবাজার অর্থনীতির দোহাই দিয়ে গ্রামে গ্রামে শোষণের যে বীজ বোনা হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে এই সুশীল বুদ্ধিজীবীরা সত্য উদঘাটনে ব্রতী হতে ভয় পাচ্ছেন কেন? টিভিতে একটি বিজ্ঞাপন দেখি বিভিন্ন চ্যানেলে।

সেই বিজ্ঞাপনের মডেল স্বয়ং ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি একটি 'সামাজিক ব্যবসা'র পক্ষে প্রচার করে বেড়াচ্ছেন। তার ভাষায় এই 'মুনাফাবিহীন' ব্যবসার নেপথ্য শানে-নজুল কী? বাংলাদেশের অনেক সমাজ বিশ্লেষকদের মতে, দেশে এনজিও সংস্থাগুলো বেশ ভালোই কল্যাণকর্ম করছে। কেউ কেউ এনজিওগুলোর কার্যকলাপকে মন্দের ভালোও বলে থাকেন। কিন্তু এ কথা তো অস্বীকার করার উপায় নেই এই মন্দের ভালোর কাঁধে ভর করে দেশে মৌলবাদী লুটেরা শ্রেণীর একটি পক্ষও জঙ্গিবাদ প্রতিষ্ঠায় ফান্ড চালাচালি করছে।

তারা মৌলবাদী রাজনীতির বীজ বপনে মোটা অঙ্কের ডোনেশনও বিতরণ করছে গ্রামে-গ্রামান্তরে। গ্রামীণ ব্যাংক, গ্রামীণফোন, ব্র্যাক প্রভৃতি ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পের জনকরা জনগণের বৃহত্তর কল্যাণে কতটা কাজ করছেন তার পূর্ণ বিবরণ জনগণের জানার অধিকার নিশ্চয়ই রয়েছে। তাদের পজিটিভ অর্জন নিয়ে রাষ্ট্রের মানুষ যেমন গর্বিত, তাদের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, স্বেচ্ছাচারিতার খতিয়ান চিত্র দেখে-জেনে জনগণের ঠিক তেমনি ভয়ের কারণও আছে। আমরা জানি দেশের ভোগবাদী রাজনীতিকরা শক্তির রক্তচক্ষু দেখিয়ে গণমানুষকে কোণঠাসা করে রাখার চেষ্টা করছেন। এখন সামাজিক বিবর্তনের নামে, দারিদ্র্য বিমোচনের নামে অর্থনীতিবিদরাও যদি রাষ্ট্রের মানুষের সঙ্গে প্রতারণা শুরু করেন তবে মানুষের শেষ আশ্রয় কোথায়? আবু মকসুদ তার কবিতায় চমৎকারভাবে লিখেছেন 'গ্রামীণ ইভটিজিং'।

হ্যাঁ, ইভটিজারদের বিরুদ্ধে দেশে ভ্রাম্যমাণ আদালত হয়েছে। কিন্তু এসব রাখববোয়াল মুখোশধারীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্র কী দাঁড়াতে পারে না। আবারও বলি, ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হোক, প্রতিটি বাঙালি আপাতত সেটাই চাচ্ছেন। নিউইয়র্ক ৭ ডিসেম্বর ২০১০ ======================================== দৈনিক সংবাদ / ঢাকা/ ১০ ডিসেম্বর ২০১০ শুক্রবার ছবি- মায়া পেটারসন

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.