প্রামাণ্য চিত্র নির্মাতা টম হাইনমান নির্মিত ‘কট ইন দ্য মাইক্রো ডেট’ বা ‘ক্ষুদ্র ঋণের ফাঁদে” ডকুমেন্টারিতে কলমের এক খোচায় ফাঁস হয়ে গিয়েছে কেমন করে নরওয়ে, সুইডেনসহ বিভিন্ন বিদেশী সংস্থা কর্তৃক দরিদ্রদের ঋণ প্রদানের জন্য দেয়া অর্থ ”গ্রামীণ ব্যাংক” থেকে পাচার করা হয়েছে গ্রামীণ কল্যাণ নামের একটা সংস্থায় যার কাজ ক্ষুদ্র ঋণ প্রদান নয়। গ্রামীণ ব্যাংকের সুনাম ক্ষুণ্ন হওয়ার অজুহাতে সুইডেন বিষয়টি নিয়ে ঘাটাঘাটি না করলেও নরওয়ের উন্নয়ন সাহায্য সংস্থা ‘নোরাড’ বিষয়টি নিয়ে সুদখোর ইউনূসকে চেপে ধরলে সুদখোর ইউনূস ও নরওয়ের মধ্যে বেশ কিছু চিঠি চালাচালি হয়, তর্ক বিতর্ক হয় এবং এক পর্যায়ে উভয় পক্ষের মধ্যে একটা সমঝোতাও হয়। এই চিঠি চালাচালি ও তর্ক বিতর্কগুলো যদি আমরা খেয়াল করি তাহলে এর মধ্যে দিয়ে বিদেশী সাহায্যে ক্ষুদ্র ঋণ, ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবসা, ক্ষুদ্র ঋণ দিয়ে দারিদ্র্য বিমোচনের নামে গ্রামীণ ফোনের মতো কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ ইত্যাদির সম্পর্ক আরো পরিষ্কার করে ধরা পড়বে।
৫ নভেম্বর ১৯৯৭: নোরাড এদিন গ্রামীণ ব্যাংককে ৩২.২ মিলিয়ন ক্রোনার প্রদান করে। এই কিস্তির মধ্যে দিয়ে গ্রামীণ ব্যাংক ও নোরাডের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির আওতায় ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৭ সালের মধ্যে সর্বমোট ৪০০ মিলিয় ক্রোনার প্রদান সম্পন্ন করে নোরাড।
কিছু দিন পর ঢাকাস্থ নরওয়ের দূতাবাসের কর্মকর্তা এইনার ল্যান্ডমার্ক এর গ্রামীণ ব্যাংকের আগের বছরের (১৯৯৬) বার্ষিক প্রতিবেদনের এক টিকার দিকে নজর পড়ে যায়। টিকাটিতে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে গ্রামীণ কল্যাণ ফাউন্ডেশন নামের নাম না জানা এক নতুন সংস্থায় ধারাবাহিক ভাবে কয়েকশ’ মিলিয়ন বৈদেশিক সাহায্য ট্রান্সফার কথা উল্লেখ করা হয়েছিল।
৩ ডিসেম্বর ১৯৯৭: অর্থ পাচারের বিষয়টি সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য নরওয়ে দূতাবাস সুদখোর ইউনূসকে ডেকে পাঠায়। পরে নরওয়ের রাষ্ট্রদূত এক গোপন চিঠিতে নোরাড পরিচালককে জানান যে, সুদখোর ইউনূসের ব্যাখ্যা তার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। রাষ্ট্রদূত লিখেছিলো: ইউনূস বলেছে, ‘এই অর্থ পাচারের মূল কারণ সরকারকে ট্যাক্স কম দেয়া এবং সেই বেঁচে যাওয়া অর্থ গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্যদের কল্যাণে ব্যবহার করা।
’
৫ ডিসেম্বর ১৯৯৭: নরওয়ে দূতাবাস গ্রামীণ ব্যাংকের কাছে ”আরও বিস্তারিত তথ্য ও বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা” চেয়ে পাঠায়।
৮ জানুয়ারি ১৯৯৮: সুদখোর ড. ইউনূস অনেকগুলো সংযুক্তিসহ নরওয়ের দূতাবাসে একটা চিঠি পাঠায়। চিঠিটিতে কি কারণে এবং কেন এই অর্থ পাচার করা হয় তা তুলে ধরেন সুদখোর ইউনূস। চিঠিটিতে সর্বমোট ৬০৮ মিলিয়ন ক্রোনার বা প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার গ্রামীণ ব্যাংক থেকে গ্রামীণ কল্যাণ সংস্থার কাছে সরবরাহ করার কথা স্বীকার করা হয়েছে। এই অর্থ নেয়া হয়েছে গ্রামীণ ব্যাংকের ঘূর্ণায়মান তহবিল বা রিভলবিং ফান্ড থেকে যে তহবিলে নরওয়ে সুইডেনসহ বিভিন্ন দেশ অর্থ প্রদান করেছিল দরিদ্রদেরকে ঋণ দেয়ার কাজে ব্যবহার করার জন্য।
গ্রামীণ ব্যাংক ও গ্রামীণ কল্যাণ সংস্থার মধ্যে ১৯৯৭ সালের ৭ মে তারিখে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তি অনুযায়ী এই অর্থ সরবরাহ করা হয় (যদিও চুক্তিটি এর আগেই, ৩১ ডিসেম্বরই কার্যকর করা হয়েগিয়েছিল)। একই দিনে গরিবের ব্যাংক নামে পরিচিত গ্রামীণ ব্যাংক নিজের দেয়া অর্থই গ্রামীণ কল্যাণ সংস্থা থেকে ঋণ হিসেবে গ্রহণ করে!
১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮: রাষ্ট্রদূত হানস ফ্রেডরিখ লেনে গ্রামীণ কল্যাণ সংস্থার বিষয়ে নোরাডের পরিচালক টোভ স্ট্র্যান্ড গেরহান্ডসনের কাছে একটি গোপন সতর্কতা বার্তা পাঠায়। বার্তায় বলা হয়: “এভাবে গ্রামীণ ব্যাংককে দেয়া দাতাতের অর্থ পাচার করা হয় এবং সেই অর্থ আবার ঋণ হিসেবে গ্রহণ করা হয়। আর এভাবে অর্থের মালিকানা গ্রামীণ ব্যাংক থেকে চলে যায় গ্রামীণ কল্যাণের কাছে। ” গোপন বার্তাটিতে সুস্পষ্ট করা হয় যে, এভাবে নরওয়ের দেয়া ৩০০ মিলিয়ন ক্রোনার গ্রামীণ ব্যাংক থেকে গায়েব করা হয়েছে।
মোট ৬০৮ মিলিয়ন ক্রোনারের অর্ধেক ছিল নরওয়ের দেয়া আর বাকি অর্থ এসেছিল এসআইডিএ, ফোর্ড ফাউন্ডেশন, ইফাড, কেএফডব্লিউ, সিআইডিএ এবং জিটিজেড এর কাছ থেকে। দূতাবাস আরও লক্ষ্য করে যে, গ্রামীণ কল্যাণ যে শুধু গ্রামীণ ব্যাংকের সাথেই লেনদেন করে তা নয়, গ্রামীণ ব্যাংকের বাইরের বিভিন্ন কোম্পানিতেও এর বিনিয়োগ আছে। বার্তাটিতে এ বিষয়ে বলা হয়: “গ্রামীণ কল্যাণ সংস্থা গ্রামীণ ব্যাংকের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নিয়ে দাতাদের উদ্দেশ্যের বাইরে এবং গ্রামীণ ব্যাংকের ঘোষিত লক্ষ্যের চেয়ে ভিন্ন কাজে ব্যবহার করেছে। গ্রামীণ কল্যাণ ইতোমধ্যে গ্রামীণ ফোনে ৩০ কোটি টাকা বা প্রায় ৫ কোটি ক্রোনার বিনিয়োগ করেছে। ” বহুজাতিক টেলিনরে বিনিয়োগ ১৯৯৭ সালে একটি পাদটিকা থেকে অর্থ পাচারের ঘটনা উদঘাটিত হওয়ার আগেই ৫ কোটি ক্রোনার গ্রামীণ ফোনের হাতে চলে গেছে।
গ্রামীণ ফোন ওই বছরেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চ এ বিশাল আড়ম্বরের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। সুদখোর ড. ইউনূস ও টেলিনরের যৌথ মালিকানাধীন এই গ্রামীণ ব্যাংক কোম্পানিটি এরপর ব্যাপক সফল একটি কোম্পানি হিসেবে বিকাশ লাভ করে এবং টেলিনরের মানি মেশিন বা পয়সা বানানোর যন্ত্র বলে পরিচিতি পায়।
সুদখোর ইউনুস ৮ জানুয়ারি চিঠিতে জানিয়েছিলেন, ১৯৯৮ সাল থেকে গ্রামীণ ব্যাংক আর ট্যাক্স মওকুফের সুবিধা পাবেনা এবং গ্রামীণ কল্যাণের সাথে চুক্তি করে যদি এই বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করা না হতো তাহলে গ্রামীণ ব্যাংককে লাভের অর্থের উপর ৪০% হারে ট্যাক্স দিতে হতো। এই অজুহাতটির বিষয়ে রাষ্ট্রদূত নোরাডের পরিচালকের কাছে লিখে: “নরওয়ের পক্ষে থেকে গ্রামীণ ব্যাংককে বিপুল সাহায্য করার সময় গ্রামীণ ট্যাক্স ফাঁকি দেয়ার জন্য আলাদা প্রতিষ্ঠান তৈরি করবে এরকম কোন বিবেচনা নরওয়ের ছিল না। বরং প্রতিষ্ঠানটি লাভজনক হয়ে উঠলে এর থেকে পাওয়া বাড়তি ট্যাক্স থেকে সরকারি কল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড ও সামাজিক সেবার সুযোগ সুবিধা গড়ে তোলা যাবে এরকমটাই নরওয়ের উদ্দেশ্য ছিল।
”
দূতাবাস আরো মনে করে সুদখোর ইউনূসের যুক্তির মধ্যে দিয়ে ‘খোদ গ্রামীণ ব্যাংকের ম্যানেজমেন্টের এক বিভ্রান্তিকর ভাবমূর্তি’ ফুটে উঠেছে। কারণ “গ্রামীণ ব্যাংকের ম্যানেজমেন্ট মনে করে এ বিপুল অর্থ তাদের নিজেদের মালিকানায় থাকলে, এই অর্থ থেকে ঋণ দিয়ে পরে মাঠ পর্যায় থেকে ঋণ আদায়ের ব্যাপারে তাদের বেশি গরজ নাও থাকতে পারে। এ কারণে তারা তাদেরই নিয়ন্ত্রিত আরেকটি কোম্পানি গ্রামীণ কল্যাণকে সেই অর্থ দিয়ে দিয়েছে এবং গ্রামীণ কল্যাণের কাছ থেকে সেই অর্থ আবার ধার হিসেবে নিয়েছে। প্রত্যাশা এই যে, গ্রামীণ কল্যাণের কাছ থেকে নেয়া ঋণের অর্থে ফেরত দেয়ার চাপ মাথায় থাকলে গ্রামীণ ব্যাংকের ম্যানেজমেন্টের মাঠ পর্যায়ের ঋণ আদায়ের গরজ থাকবে। এই যুক্তি থেকে স্বাভাবিক ভাবেই একটা প্রশ্ন উঠতে পারে, ঋণ আদায় কি তাহলে গ্রামীণের ম্যানেজমেন্টের জন্য ক্রমশ সমস্যায় পরিণত হচ্ছে? যদি ঋণ আদায়ই মূল সমস্যা হয় তাহলে ম্যানেজমেন্ট বা ব্যবস্থাপনা পুনর্গঠন করে এই সমস্যার সমাধান অনেক সহজ হতো না? তা না করে কেন গ্রামীণ কল্যাণের মতো একেবারে নতুন একটি সংস্থার ইন্দ্রজাল তৈরির মতো পরিশ্রম সাধ্য একটা কাজ করতে গেল গ্রামীণ? ” সবশেষে দূতাবাসের চিঠিটিতে গ্রামীণ ব্যাংক ও গ্রামীণ কল্যাণের মধ্যকার চুক্তিটি বাতিল করে গ্রামীণ কল্যাণ থেকে শত মিলিয়ন ডলার গ্রামীণ ব্যাংকে ফিরিয়ে এনে ঘূর্ণায়মান তহবিল তৈরির মূল পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।