রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) দেওয়া নিবন্ধন অবৈধ ও বাতিল বলে ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট। একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জারি করা রুল অ্যাবসল্যুট করে তিন সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি বৃহত্তর বেঞ্চের সর্বজ্যেষ্ঠ সদস্য বিচারপতি এম মোয়াজ্জাম হোসেন গতকাল এ রায় ঘোষণা করেন। রায়ের বিরুদ্ধে এদিনই আপিল করেছে জামায়াত। এ রায়ের ফলে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামী আগামী সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না বলে দাবি করেছেন নির্বাচন কমিশনের আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক। তবে জামায়াতের আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাকের দাবি, আপিল বিচারাধীন থাকা অবস্থায় নির্বাচনে অংশ নেওয়া যাবে।
সব পক্ষের শুনানি শেষে ১২ জুন থেকে বিষয়টি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) ছিল হাইকোর্টের ওই বেঞ্চে। একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন কেন আইনগত কর্তৃত্ব বহিভর্ূত এবং গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯০বি(১)(বি)(২) ও ৯০(সি) অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন ঘোষণা করা হবে না_ জানতে চেয়ে ২০০৯ সালে রুল জারি করেন হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ।
বেলা ২টা ৩৩ মিনিটে সুপ্রিমকোর্টের অ্যানেঙ্ ২৪ নম্বর বিচারকক্ষের এজলাসে আসন গ্রহণ করেন হাইকোর্টের বৃহত্তর এই বেঞ্চের তিন সদস্য। বেঞ্চের সর্বজ্যেষ্ঠ সদস্য বিচারপতি এম মোয়াজ্জাম হোসেনের ডান পাশে দ্বিতীয় জ্যেষ্ঠ সদস্য বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম এবং বাম পাশে কনিষ্ঠ সদস্য বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক আসন গ্রহণ করেন। এরপর এ মামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানান আদালত।
পরে সংক্ষিপ্ত আদেশে আদালত বলেন, 'বাই মেজরিটি, রুল ইজ মেইড অ্যাবসল্যুট অ্যান্ড রেজিস্ট্রেশন গিভেন টু জামায়াত বাই ইলেকশন কমিশন ইজ ডিক্লিয়ার্ড ইলিগ্যাল অ্যান্ড ভয়েড। ' সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের ভিত্তিতে আদেশ দিয়ে আদালত জানান, রায়ের বিস্তারিত অংশ পরে প্রকাশিত হবে। এ সময় জামায়াতের অন্যতম আইনজীবী ব্যারিস্টার বেলায়েত হোসেন বলেন, 'মাই লর্ড। যেহেতু বিষয়টিতে সাংবিধানিক ব্যাখ্যা সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ আইনি প্রশ্ন জড়িত, তাই সংবিধানের ১০৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এ বিষয়ে সার্টিফিকেট ইস্যু করার আবেদন জানাচ্ছি। ' পরে সার্টিফিকেট ইস্যু করেন আদালত।
উল্লেখ্য, এ ধরনের সার্টিফিকেট ইস্যু করার ফলে আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল না করে অধিকার হিসেবে সরাসরি আপিল দায়ের করা যায়। রায়ের সময় অন্যদের মধ্যে জামায়াতের পক্ষে ব্যারিস্টার বেলায়েত হোসেন ও অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম, ইসির পক্ষে অ্যাডভোকেট মহসিন রশীদ এবং রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু আদালতে উপস্থিত ছিলেন। রায় ঘোষণা উপলক্ষে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় আদালত প্রাঙ্গণে। রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০০৯ সালে এই রিট আবেদনটি দায়ের করেন বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের তৎকালীন মহাসচিব ও বর্তমান প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরীসহ ২৫ ব্যক্তি। আবেদনে বলা হয়, চারটি কারণে জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন পেতে পারে না।
প্রথমত, জনগণকে সব ক্ষমতার উৎস বলে নীতিগতভাবে মনে করে না জামায়াত। একই সঙ্গে আইন প্রণয়নে জনপ্রতিনিধিদের নিরঙ্কুশ ক্ষমতাকেও স্বীকার করে না দলটি। দ্বিতীয়ত, গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ অনুসারে কোনো সাম্প্রদায়িক দল নিবন্ধন পেতে পারে না। অথচ কার্যক্রম ও বিশ্বাসে দলটি সাম্প্রদায়িক। তৃতীয়ত, নিবন্ধন পাওয়া রাজনৈতিক দল ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গের কোনো বৈষম্য করতে পারে না।
কিন্তু এই দলের শীর্ষপদে কখনও কোনো নারী বা অমুসলিম যেতে পারবে না। চতুর্থত, বিদেশের কোনো সংগঠনের শাখা হিসেবে এ দেশে কোনো রাজনৈতিক দল পরিচালিত হতে পারবে না। অথচ জামায়াত বিদেশের একটি সংগঠনের শাখা। সদস্যরাও স্বীকার করেন দলটির জন্ম ভারতে। দলটির শাখা রয়েছে বিশ্বজুড়ে।
রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি শেষে ওই বছরের ২৭ জানুয়ারি বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক (পরবর্তীতে প্রধান বিচারপতি হয়ে ইতোমধ্যে অবসরে) এবং বিচারপতি আবদুল হাইয়ের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রুল জারি করেন। নির্বাচন কমিশনসহ জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়। পরে রুলটি উত্থাপন করা হয় বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চে। সেখানে আংশিক শুনানির পরেই পরিবর্তন হয় ওই বেঞ্চের এখতিয়ার। এরপর আর রুলের শুনানি করার উদ্যোগ নেয়নি কোনো পক্ষই।
ফলে এটি আদালতের কার্যতালিকায়ও আসেনি। সম্প্রতি মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ও জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধের জোর দাবি ওঠায় ওই রুলের শুনানি শুরুর জন্য প্রধান বিচারপতির কাছে আবেদন করে রিটকারীপক্ষ। পরে প্রধান বিচারপতি ওই বিষয়টি শুনানির জন্য হাইকোর্টের বিচারপতি এম মোয়াজ্জাম হোসেন এবং বিচারপতি কাজী রেজা-উল হকের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ নির্ধারণ করেন। এই বেঞ্চ বিষয়টি শুনানির জন্য বৃহত্তর বেঞ্চ গঠনের প্রয়োজনীয়তা বোধ করলে বিচারপতি এম মোয়াজ্জাম হোসেন, বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম এবং বিচারপতি কাজী রেজা-উল হকের সমন্বয়ে বৃহত্তর বেঞ্চ গঠন করেন প্রধান বিচারপতি। গত ১২ জুন রুলের ওপরে শুনানি শেষ হয় এই বেঞ্চে।
এর আগে ১১ এপ্রিল রুলের চূড়ান্ত শুনানি শুরু হয়। ওই দিন আদালতে হলফনামা আকারে ইসির জবাব দাখিল করা হয়। ১৮ এপ্রিল রিটের পক্ষে শুনানি শেষ করেন ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর। আর ২৫ এপ্রিল শুনানি শেষ করেন ইসির আইনজীবী মহসীন রশীদ। এর পর ২২ মে থেকে জামায়াতের পক্ষে ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক, ব্যারিস্টার বেলায়েত হোসেন এবং অ্যাডভোকেট জসিম উদ্দিন সরকার শুনানি করেন।
২০০৮ সালের ৪ নভেম্বর ৩৮টি দলের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন জামায়াতে ইসলামী। এই দলের দুজন প্রতিনিধি রয়েছেন বর্তমান সংসদে।
এক নজরে জামায়াতে ইসলামী : বিশ্ব রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচিত-সমালোচিত জামায়াতে ইসলামীর জন্ম অবিভক্ত ভারতে। প্রতিষ্ঠাতা সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী। ১৯৪১ সালের ২৬ আগস্ট প্রতিষ্ঠার সময় সংগঠনটির নাম ছিল জামায়াতে ইসলামী হিন্দ।
আইয়ুব খানের মুসলিম পরিবার আইন অধ্যাদেশের বিরোধিতা করার কারণে ১৯৬৪ সালের ৪ জানুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর কর্মকাণ্ড প্রথমবারের মতো নিষিদ্ধ হয়। তখন গ্রেফতার করা হয় মওদুদীসহ ৬০ জন জামায়াত নেতাকে। এর মধ্যে গোলাম আযমসহ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ছিলেন ১৩ জন। নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয় ওই বছরের অক্টোবরেই। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের ছয় দফা এবং মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীরও তীব্র বিরোধিতা করে দলটি।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে পশ্চিম পাকিস্তানে চারটি আসন লাভ করে জামায়াতে ইসলামী। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের বিরোধিতা করে দলটি। ওই বছর ডা. আবদুল মালিককে গভর্নর করে পূর্ব পাকিস্তানে একটি প্রাদেশিক সরকার গঠন করা হয়। ওই সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন জামায়াত নেতা আব্বাস আলী খান। একাত্তরে জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকার কথা উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়েও।
একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় দলটির নেতৃত্বে কিলার বাহিনী হিসেবে গঠিত হয় রাজাকার, আল বদর, আল শামস ও শান্তি কমিটি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ হলে এর আওতায় নিষিদ্ধ হয় জামায়াতও। ১৯৭৬ সালের আগস্টে জিয়াউর রহমান সরকার সব ধরনের রাজনৈতিক দলের রাজনীতি উন্মুক্ত করে রাজনৈতিক দল অধ্যাদেশ জারি করেন। এ সময় ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিল জামায়াতে ইসলামী। পরে গোলাম আযম বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করলে ১৯৭৯ সালের মে মাসে গঠিত হয় জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ।
ভারপ্রাপ্ত আমির হন আব্বাস আলী খান। ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনে ৩০০টির মধ্যে জাতীয় সংসদের ১৮টি আসন লাভ করে দলটি। পরে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় ঐক্যজোটের অন্যতম শরিক হিসেবে সরকার গঠনে ভূমিকা পালন করে। ২০০৮ সালের ৪ নভেম্বর নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পায় দলটি। তবে ওই নিবন্ধনের সময় পরিবর্তন করে নাম রাখে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদে মাত্র দুটি আসন পায় দলটি। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সরকার গঠন করে মহাজোট। একাত্তরের ভূমিকার জন্য মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি হন দলটির প্রথম সারির একাধিক প্রভাবশালী নেতা। ট্রাইব্যুনালের রায়ে ইতোমধ্যে ৯০ বছরের দণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন এই দলের সাবেক আমির গোলাম আযম। মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন বর্তমান নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সহকারী সক্রেটারি মুহাম্মদ কামারুজ্জামান অপর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লা দণ্ডিত হয়েছেন যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে।
বিচারের আওতায় রয়েছেন আমির মতিউর রহমান নিজামীসহ আরও কয়েকজন।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।