উপচে পড়া সবুজে সবুজময় ভাওয়াল শালবনের ভেতর বিশাল অরণ্যভূমিতে তৈরি করা হয়েছে থাইল্যন্ডের সাফারী ওয়ার্ল্ড এবং ইন্দোনিশিয়ার 'বালি সাফারী পার্ক' এর আদলে এশিয়ার সর্ববৃহৎ 'বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাফারী পার্ক'। এক সময় এই অঞ্চল কোহিস্থান ঢাকা বা পাহাড়ী ঢাকা নামে পরিচিত ছিল। মোঘল আমলে ভূ-স্বামীদের অন্যতম ফজল গাজী ছিলেন এই পরগণার অধিপতি। বিশাল আকৃতির এই ভাওয়াল শালবনে এক সময় ৬৩ প্রজাতির গাছপালা আর ২২০ প্রজাতির বন্যপ্রাণীর অবাধ বিচরণ ছিল। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, নগরায়ন, শিল্পায়ন, বন ধ্বংস করে কৃষি জমির বিস্তার, আবাসন, জবর দখল ও ভূমি বিরোধের কারণে যখন দ্রুত গতিতে শালবনের অস্তিত্ব বিলীন হতে শুরু করে, ঠিক তখন জীববৈচিত্র রক্ষা, ইকোটু্রিজমের উন্নয়ন, পর্যটন শিল্পের বিকাশ, গবেষণা ও চিত্তবিনোদনের সুযোগ সৃষ্টির জন্য এশিয়ার সর্ববৃহৎ 'সাফারী পার্ক' প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয় এ সরকার।
এ অঞ্চলটি একসময় ভাওয়াল রাজার জমিদারীর অংশ ছিল। ১৯৫০ সালের দিকে জমিদারী উচ্ছেদ ও প্রজাসত্ত্ব আইন জারির পর শালবনের ব্যবস্থাপনা বন বিভাগের হাতে হসত্মানত্মর করা হয়। তবে অধিকাংশ চালা জমির শালবন সমৃদ্ধ বনভূমি থাকার কারণে বন বিভাগের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও বাইদ (নিচু ভূমি) ব্যক্তি মালিকানাই থেকে যায়।
রাজধানী থেকে ৪০ কিলোমিটার উত্তরে ঢাকা ময়মনসিংহ মহাসড়কের বাঘের বাজারের ৩ কিলোমিটার পশ্চিমে গভীর শালবনের ভিতর ৩ হাজার ৮১০ একর ভূমির ওপর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এ পার্ক। এক সময় এ বনের ভিতর জন্ম নেয়া আমলকী, বহেড়া, হরতকী, কড়ই, শিমুল, পলাশ, চাপালিশ, কুসুম, পিকরাজ, উদালসহ নানা লতাগুল্মের ভিতর বসবাস করতো মায়া হরিণ, চিতাবাঘ, বন বিড়াল, শিয়ালের ঝাক, সজারু, অজগর, বানর, হনুমানসহ অসংখ্য প্রজাতির বন্যপ্রাণি।
সেগুলো অনেকটাই বিলিন হওয়ার পথে। এসব বৃক্ষরাজি ও বন্যপ্রাণী রক্ষার জন্যই মূলত এই উদ্যোগ। সেই সাথে দর্শনীয়স্থান হিসেবে এ অঞ্চলকে আকর্ষণীয় করা।
গভীর শালবনের ভেতর তৈরি করা হয়েছে সুবিশাল ইটের সীমানা প্রাচীর। ভিতর দিয়ে অসংখ্য সরু পিচঢালা সড়ক।
দু'দিকে গজারি গাছসহ নানা প্রজাতির গাছে আচ্ছাদিত। বঙ্গবন্ধু সাফারী পার্কের দৃষ্টিনন্দন প্রধান ফটক পার হয়েই বিশাল মাঠ। সারি সারি ফুল গাছ। তারপরই কচ্ছপের জলধারা। অসংখ্য কচ্ছপ নিরাপদে খেলা করছে জলে এবং ডাঙায়।
পার্কে রয়েছে বাইদ জমিতে পশুচারণভূমি, বিলুপ্ত ও দুলর্ভ প্রজাতির বৃক্ষ, কোর সাফারী, সাফারীকিংডম, বায়োডাইভারসিটি পার্ক, এক্সটেনসিভ এশিয়া সাফারী, বাঘের আসত্মানা, সিংহের আস্তানা, চিত্রা হরিণ, কালো ভাল্লুক, সাম্বার হরিণ ও জলহস্তীর আস্তানা। রয়েছে ডরমিটরি, বন্যপ্রাণী হাসপাতাল, ঝুলন্ত সেতু, ন্যাচারাল হিস্ট্রি, পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র, গুইসাপ পার্ক, ফেন্সি কার্প পার্ক, ক্রাউন ফিজেন্ট পাখিশালা, পেলিকেলপাখির জলাধারা, অতিথি পাখির জলাধারা, বার্ডশো গ্যালারী, অকির্ড হাউজ, ফোয়ারা, প্রজাপতি, পেঁচা ও শকুনের আসত্মানা, ক্যাঙ্গারু গার্ডেন, হাতী গ্যালারী, লেক ও জলাধারা ইত্যাদি।
কোর সাফারী পার্ক: ১৩৩৫ একর এলাকায় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে কোর সাফারী। এখানে রয়েছে বাঘ, সিংহ, ভাল্লুক, আফ্রিকান চিতা, চিত্রা হরিণ সাম্বার ও গয়াল, হাতি, জলহসত্মী, নীল গাই ও বারো সিংগা, পাখিদ্বীপ এবং বন্য মোষ এর অবাধ বিচরণের নিরাপদ স্থান। এখানে গাড়ি ছাড়া কোন দর্শনার্থী প্রবেশ করতে পারবেন না।
সাফারী কিংডম: ৫৭৫ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে সাফারী কিংডম। এখানে রয়েছে প্রকৃতি বীক্ষণ কেন্দ্র, জিরাফ ফিডিং স্পট, পেলিকেন আইল্যান্ড, প্যারট এভিয়ারীসহ দেশি বিদেশী পাখির আশ্রম। কুমির পার্ক, অকির্ড হাউজ, প্রজাপতি, পেঁচা ও শকুন কর্নার, এগ ওয়ার্ল্ড, কচ্ছপ ব্রিডিং সেন্টার, ক্যাঙ্গারু বাগান, ময়ূর ওপেন ল্যান্ড, সার্পপার্ক ইত্যাদি।
ন্যাচার হিস্ট্রি মিউজিয়াম: এই মিউজিয়ামে প্রায় ২ হাজার প্রজাতির মেরুদণ্ডী ও অমেরুদণ্ডী প্রাণির দেহাবশেষ, স্পেসিমেন ও স্টাফিং সংগ্রহ করে রাখা হয়েছে।
কৃত্রিম হ্রদ: পার্কের ভেতরে বিচরণরত বন্য পশুপাখির পানীয় জলের উৎস সৃষ্টির জন্য খনন করা হয়েছে ৮টি জলধারা ও ২টি কৃত্রিম হ্রদ।
বায়োডাইভারসিটি পার্ক: বিরল, বিলুপ্তপ্রায় এবং বিপন্ন প্রজাতির গাছের জীনপুল সংরক্ষণের জন্য ৯৬৫ একর জায়গা জুড়ে তৈরি করা হয়েছে এটা।
এক্সটেনসিভ এশিয়া সাফারী: এই পার্কে এশিয় তৃণভোজী এবং ছোট মাংসাশী প্রাণি, পাখি সরীসৃপ ও উভয়চর প্রাণী নিয়ে ৮২৪ একর জমির ওপর এটা প্রতিষ্ঠিত। এছাড়াও বৃক্ষরাজি সমৃদ্ধ প্রায় ১৫০ একর জায়গায় তৈরি করা হয়েছে হাতির আশ্রম।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাফারী পার্কটি এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়নি। তবে আগামী ৩১ জুলাই এটি উদ্বোধন করা হবে বলে জানা গেছে।
মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী সকল প্রকার প্রাণী আনা হয়নি যদিও কিন্তু দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠেছে পুরো পার্ক। পার্কের রেঞ্জ কর্মকর্তা শিবু প্রসাদ ভট্টাচার্য জানান, খুব শীঘ্রই পার্কে সকল প্রকার প্রাণী আনার প্রক্রিয়া চলছে। অসম্ভব সৌন্দর্যমণ্ডিত বঙ্গবন্ধু সাফারী পার্কে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অসংখ্য মানুষ ভিড় করছেন। বিশ্বমানের আদলে ২১৯ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত পার্কটি দেশের অন্যতম প্রধান বিনোদন এবং গবেষণা কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছে।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।