পশ্চিমারা যার বন্ধু তার আর কোনো শত্রু থাকার প্রয়োজন নেই—এই কথা যারা বলেন, তারাই হয়তো ঠিক। পশ্চিমাদের ব্যাপারে সদ্য পতিত মিসরীয় স্বৈরাচারী শাসক হোসনি মোবারকের এমন মূল্যায়ন নিশ্চিতভাবেই তাই ভিন্ন বা নতুন কিছু নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্সসহ পশ্চিমা যে দেশগুলোর আশীর্বাদ নিয়ে ৩ দশক ধরে স্বৈরশাসন চালিয়ে গেলেন হোসনি মোবারক, চরম বিপদের দিনে তাদের কাউকেই কাছে পাওয়া গেল না। উল্টো শুনতে হলো ক্ষমতার মসনদ ছেড়ে দেয়ার উপদেশ। যে পশ্চিমা দেশগুলোই স্বার্থের কারণে টিকিয়ে রেখেছিল হোসনি মোবারককে, তারাই আবার ছুড়ে ফেলে দিল তাকে।
সাধারণ মিসরীয়দের ক্ষোভের আগুনে যেন পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে হোসনি মোবারকের পশ্চিমা তোষণ নীতি। পতনের পর মোবারকের গায়ে এখন স্বৈরশাসকের তকমা লাগিয়ে দিয়েছে স্বয়ং পশ্চিমারাই। অথচ হোসনি মোবারকের শুরুর দিনগুলোতে ছিল এক ভিন্ন চিত্র। ক্ষমতা গ্রহণের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো হোসনি মোবারককে আখ্যা দিয়েছিল পশ্চিমা বিশ্বের বন্ধু, উদার এবং মুক্তচিন্তার এক নেতা, যিনি ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারবেন মিসরের জনগণকে। তার চিন্তা-চেতনার ঢেউ লাগবে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে।
হোসনি মোবারকের জন্ম ১৯২৮ সালের ৪ মে। বিমান বাহিনীতে অফিসার হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু। বোম্বার পাইলট হিসেবে তার ছিল দারুণ খ্যাতি। সফলতার সিঁড়ি বেয়ে তিনি মিসরের বিমান বাহিনীর সর্বোচ্চ পদে আসীন হয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালে প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত হোসনি মোবারককে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেন।
১৯৭৮ সালে তিনি ক্ষমতাসীন দল এনডিপির ভাইস চেয়ারম্যান মনোনীত হন। আনোয়ার সাদাত নিহত হওয়ার পর ১৯৮১ সালের ১৪ অক্টোবর হোসনি মোবারক মিসরের চতুর্থ প্রেসিডেন্ট এবং এনডিপির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দায়িত্ব নেয়ার পর পশ্চিমা নেতারা হোসনি মোবারককে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, তিনি সত্যিকার অর্থেই জনগণের বন্ধু, যার নেতৃত্বের গুণাবলী জন্মগত। তিনি তার অবস্থান তৈরি করেছেন নিজের যোগ্যতা এবং ক্ষমতা দিয়েই।
পশ্চিমাদের দেয়া মুক্তচিন্তা ও আধুনিক নেতার সার্টিফিকেট নিয়ে একদিকে হোসনি মোবারক তত্পর হয়ে উঠেন ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে।
এটা করতে গিয়েই তিনি পরিণত হন এক স্বৈরশাসকে। চরম স্বৈরাচারী হওয়া সত্ত্বেও পশ্চিমারা তাকে দিয়েছে অকুণ্ঠ সমর্থন। পশ্চিমা স্বার্থ রক্ষায় আরব বিশ্বে একজন হোসনি মোবারক প্রয়োজন ছিল পশ্চিমা দেশগুলোর, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। গত ৩ দশক ধরে আরব বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন হোসনি মোবারক। পশ্চিমাদের জন্য তিনি যা করেছেন তার বর্ণনা নিশ্চিতভাবেই অনেক দীর্ঘ হবে।
কয়েকটি বিষয়ের কথা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। ১৯৭৯ সালে ক্যাম্পডেভিট চুক্তি স্বাক্ষরে মিসরের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন হোসনি মোবারক। ওই চুক্তির মাধ্যমেই আরব বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে মিসর ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়।
প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর পরই হোসনি মোবারক পশ্চিমাদের সম্পাদিত ইসরাইল-ফিলিস্তিন শান্তি উদ্যোগের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন ব্যক্ত করেন। অনেকে মনে করেন পশ্চিমাদের সম্পাদিত ইসরাইল-ফিলিস্তিন শান্তি উদ্যোগের প্রতি সমর্থন জানানোর কারণেই আনোয়ার সাদাতকে হত্যা করা হয়।
১৯৯১ সালে প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় ইরাকের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেন হোসনি মোবারক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন যৌথ বাহিনী ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মিসরের ভূমি ব্যবহারের সুযোগ পায়। প্রতিদানে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের অন্যান্য দেশ মিসরের ১৪ বিলিয়ন ডলারের ঋণ মওকুফ করে দেয়।
১৯৯৩ সালে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ও স্থিতিশীলতা আনার লক্ষ্যে ইসরাইল এবং পিএলও’র মধ্যে পশ্চিমাদের উদ্যোগে যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, তার পেছনে অন্যতম মধ্যস্থতাকারী ছিলেন হোসনি মোবারক। নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে হোসনি মোবারক মিসরের ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযান চালান।
এর মাধ্যমে তিনি পশ্চিমাদের অনেক বাহবা পান। পশ্চিমাদের খুশি রাখতে মুসলিম ব্রাদারহুডকে নিষিদ্ধ করে রাখেন তিনি। যদিও এই দলটির প্রতি ব্যাপক জনসমর্থন রয়েছে। এমনই নানা কারণে হোসনি মোবারকের সঙ্গে পশ্চিমারা বন্ধুত্বের অভিনয় করেছে বলা যায়। পশ্চিমারাও খুব ভালোভাবেই জানত হোসনি মোবারক দৃশ্যত একজন সামরিক স্বৈরশাসক।
জরুরি অবস্থার জালে দেশটিকে আটকে রেখে শাসন করেছেন তিনি। ১৯৮১ সালের পর থেকে হোসনি মোবারকের শাসনামলে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শীদের ধরে ধরে জেলে পুরেছেন তিনি। এসবের সঙ্গে যোগ হয়েছে মোবারকের সীমাহীন দুর্নীতি। সব মিলিয়ে যখন জনতা রাস্তায় নেমেছে, ঠিক তখনই এক নাজুক পরিস্থিতিতে আসল চেহারায় আবির্ভূত হয় পশ্চিমারা।
কোথায় তারা মোবারকের পাশে দাঁড়াবে, তা না করে উল্টো ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার উপদেশ দেন পশ্চিমা নেতারা। এ যেন ঠিক পেছনে ছুরি মারার মতো। ৩০টি বছর যাদের জন্য নিজের জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন যিনি, বিপদের মুহূর্তে তাদের কাউকেই পাশে পেলেন না হোসনি মোবারক। হোসনি মোবারকের পতনে এখন মিসরীয় জনতার সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করছেন পশ্চিমা নেতারা। পশ্চিমাদের ব্যাপারে হোসনি মোবারক নিজের মুখে কিছু না বললেও তার দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে পশ্চিমারা প্রতারণা করেছে।
পশ্চিমারা এমনই করে। হোসনি মোবারক এটা বুঝলেন, তবে অনেক দেরিতে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।