শনিবার একযোগে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়, যাতে পাসের হার আগের চেয়ে প্রায় সাড়ে ৪ শতাংশ পয়েন্ট কম দেখা যায়। জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও কমেছে ২ হাজার জন।
গত চার বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে এইচএসসিতে পাসের হার বাড়লেও সরকারের শেষ বছরে রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে ফলাফলে অধোগতি দেখা গেল।
সরকারের পক্ষ থেকে এজন্য বিরোধী দলের হরতালকে কারণ দেখানো হলেও এর সঙ্গে সৃজনশীল প্রশ্নে নতুন তিনটি বিষয়ের পরীক্ষাকেও গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক শিক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান।
গত বছর এইচএসসিতে বাংলা প্রথম ও দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষা সৃজনশীল প্রশ্নে হলেও এবার এই বিষয়ের সঙ্গে রসায়ন, পৌরনীতি এবং ব্যবসায় নীতি ও প্রয়োগ যোগ হয়েছে।
হোসেন জিল্লুর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শুরুর বছরে (নতুন তিনটি বিষয়) সৃজনশীল প্রশ্নে পরীক্ষার্থীরা ধাক্কা খেয়েছে। ”
সব বোর্ডের বিষয়ভিত্তিক পাসের হার তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া না গেলেও কুমিল্লা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক কায়ছার আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সৃজনশীল প্রশ্নের সঙ্গে শিক্ষার্থীরা খাপ খাওয়াতে না পারায় ব্যবসায় নীতি ও প্রয়োগ বিষয়ে ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী ফেল করেছে।
অন্য বোর্ডগুলোর কর্মকর্তারাও বলছেন, এবছর রসায়নে শিক্ষার্থীরা বেশি ফেল করেছে, যা সার্বিক ফলাফলে প্রভাব রেখেছে।
ফল প্রকাশের দিন বিষয়ভিত্তিক পাসের পরিসংখ্যান বিস্তারিতভাবে জানাতে পারেননি বোর্ড কর্মকর্তারা।
তবে সব বিভাগেই রসায়নে পাসের হার তুলনামূলক কম স্বীকার করে আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় সাব-কমিটির সভাপতি অধ্যাপক তাসলিমা বেগম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা ছাড়াও অন্য কিছু প্রভাব ফেলেছে কি না, তা যাচাই করা হবে।
তিনি বলেন, “বাধাগ্রস্ত অবস্থায় শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিয়েছে, তাদের মধ্যে মানসিক চাপও ছিল। এসব বিষয় ফলাফলে প্রভাব ফেলেছে। ”
এবারের প্রথম দিনের এইচএসসি পরীক্ষা ছাড়া সবগুলো পরীক্ষাই হরতালের মধ্যে পড়ে। হরতালের ফলে ৩২টি বিষয়ের পরীক্ষাসূচি পরিবর্তন করায় পিছিয়ে যায় ৪১টি পরীক্ষা। চট্টগ্রাম বোর্ডের ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষা চার বার পেছাতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ।
হরতালের কারণেই এবারের এইচএসসির ফল ‘বিপর্যয়’ হয়েছে দাবি করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এজন্য বিরোধী দলগুলোকে দায়ী করেছেন।
এবারে এইচএসসিতে চট্টগ্রাম বোর্ডে পাসের হার কমেছে ১১ দশমিক ০৯ শতাংশ, যা সারাদেশে সর্বনিম্ন। জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যাও এই বোর্ডে কমেছে ৩৮৩ জন।
চট্টগ্রাম বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক পীযূষ দত্ত জানান, এই বোর্ডে ইংরেজি প্রথম পত্রে ৮৯ শতাংশ পাস করলেও দ্বিতীয়পত্রে পাসের হার ৬৬ শতাংশ।
শিক্ষামন্ত্রী ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, “এর জন্য সম্পূর্ণ দায়ী আমাদের দেশের কিছু অবিবেচক, দায়িত্বজ্ঞানহীন, অদূরদর্শী রাজনৈতিক নেতৃত্ব; যারা তাদের সংকীর্ণ স্বার্থ হাসিলের জন্য আমাদের নতুন প্রজন্মকে বিপদের মুখে ফেলে দিয়েছিলেন।
”
রাজনৈতিক অস্থিরতাকে অন্যতম কারণ মনে করছেন গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরীও। তবে পাসের হার কমে যাওয়াকে ‘বিপর্যয়’ বলে মানতে নারাজ তিনি।
রাশেদা চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রাজনৈতিক সহিংসতার মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে পরীক্ষা দেয়ায় পাসের হারে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তবে সার্বিকভাবে পাসের হার ও জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমলেও ফলাফলের ধারা একই রকম আছে। ”
ফলাফলের ক্ষেত্রে শহর-গ্রামের বৈষম্যের একটি চিত্রও তুলে এনেছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক এই উপদেষ্টা।
“শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ক্যাডেট কলেজগুলো বরাবরের মতো এবারো ভালো ফল করেছে। তাদের পাসের হারও আগের বছরের মতোই। গ্রাম ও শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে লাগামহীন বৈষম্য চলছে, এই লাগাম টানতে হবে। ”
ফল পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এবার চট্টগ্রাম মহানগরীতে পাসের হার ৭৪ দশমিক ০৮ শতাংশ। মহানগরী বাদে চট্টগ্রাম জেলার পাসের হার ৫২দশমিক ৭৯ শতাংশ।
ঢাকা মহানগরী এলাকায় ৮৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করলেও ঢাকা বোর্ডে পাসের হার ৭৪ দশমিক ০৪ শতাংশ।
অন্য বোর্ডের অধীনে শহর অঞ্চলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ফল গ্রামাঞ্চলের কলেজের ফলের চেয়ে ভালো বলে দেখা গেছে।
শিক্ষায় রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ কমছে উল্লেখ করে রাশেদা চৌধুরী বলেন, ক্যাডেট কলেজগুলো ভালো ফল করছে। সেখানে সরকারের বিনিয়োগও বেশি। সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য একই ব্যয় রাখা হলে অন্যরাও ভালো ফল করবে।
“এই বৈষম্য ভাঙতে হবে,” বলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রাশেদার সহকর্মী হোসেন জিল্লুরও।
রাশেদা চৌধুরী রাজনৈতিক দলগুলোকে স্মরণ করিয়ে বলেন, “যে কোনো রাজনৈতিক দলেরই মনে রাখা উচিত, যারা এবার পাস করল, তারাও কিন্তু আগামী দিনের ভোটার। ”
এবার ১০ লাখ ২ হাজার ৪৯৬ জন শিক্ষার্থী এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশ নেয়। এর মধ্যে ৩ লাখ ৯৩ হাজার ৮৯৯ জন ছাত্র এবং তিন লাখ ৫০ হাজার ৯৯২ জন ছাত্রী পাস করেছে। ছাত্রীদের থেকে এবার ৪২ হাজার ৯০৭ জন ছাত্র বেশি পাস করেছে।
গত বছর ২৪টি প্রতিষ্ঠানের সবাই ফেল করলেও এবার শতভাগ ফেল করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা একটি বেড়েছে। অন্যদিকে শতাভাগ পাসকরা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১৮৭টি কমেছে, যার বেশিরভাগই গ্রামের কলেজ।
গত বছর এক হাজার ৩৬টি প্রতিষ্ঠান থেকে সব শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হলেও এবার তা কমে দাঁড়িয়েছে ৮৪৯টি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।