৭ ফেব্রুয়ারি ২০১১ ছিল প্রসাদ রায়ের ১৫তম মৃত্যু দিবস। খাপড়া ওয়ার্ডের লড়াকু যোদ্ধা, মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, শ্রমিক-মেহনতি মানুষের বন্ধু, আজীবন বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির এই নেতা জন্মেছিলেন ৫ আগস্ট, ১৯২৮ সালে পাবনার প্রতাপ ভবনে। সে সময় পাবনা শহরে এই পরিবারটির পরিচিতি ছিল অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধ ও সাংস্কৃতিক আবহের কারণে। পরবর্তী সময়ে অবশ্য প্রতাপ ভবনকে সর্বস্তরের মানুষ চিনত সে সময়ের মডারেট ও লিবারেল আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল হিসেবে। প্রসাদ রায়সহ তাঁরা পাঁচ ভাই যুক্ত ছিলেন সক্রিয় কমিউনিস্ট রাজনীতির সঙ্গে।
পরিবারে অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধ ও সাম্যবাদী চিন্তার পথিকৃৎ ছিলেন তাঁর মা শবাসনা দেবী।
আমৃত্যু দমন-পীড়নের মধ্যে অবিচলভাবে প্রসাদ রায় নিজেকে শামিল রেখেছেন মেহনতি মানুষের লড়াই-সংগ্রামে। সর্বমোট ১৯ বছর ছয় মাস কেটেছে জেলে তাঁর। প্রথম কারাবরণ ১৯৪৮ সালের আগস্ট মাসে; রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে পোস্টার লাগাতে গিয়ে গ্রেপ্তার হন। ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত টানা জেলে ছিলেন।
তারপর নানা আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় থেকে বারবার জেলে গেছেন। দীর্ঘ জেলজীবনের ফাঁকে ফাঁকে যুক্ত থেকেছেন পার্টি গড়ার কাজে, শ্রমিক আন্দোলনে, বিশেষত হোসিয়ারি ও বিড়ি শ্রমিক ইউনিয়নে।
১৯৪৭-এ দেশ বিভাগের পর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিপুলসংখ্যক মানুষ চলে গেলেন ভারতে। কমিউনিস্ট কর্মীরাও বাদ রইলেন না। যাঁরাও ছিলেন, তাঁদের অনেকেই ১৯৫০-এর দাঙ্গার পর চলে গেলেন।
সে সময় কমিউনিস্ট কর্মীদের বেশির ভাগই ছিলেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থেকে আগত। তাই যাঁদের পরিবার ও আত্মীয়স্বজন ওপারে পাড়ি জমালেন, তাঁরাও বাধ্য হলেন তাঁদের অনুগামী হতে। কেউ কেউ রয়ে গেলেন মাটি কামড়ে, আদর্শ আঁকড়ে। প্রসাদ রায় তাঁদেরই একজন। বিভাগ-পরবর্তী বাংলায় তখন বেশ কিছু এলাকায় কৃষক-জনতার মধ্যে কমিউনিস্টদের ভিত্তি গড়ে উঠেছে।
সদ্য শেষ হয়েছে তেভাগার আন্দোলন, নানকার আন্দোলনের ঢেউ বয়ে গেছে বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও সিলেটজুড়ে। এসব কিছু মিলিয়ে অনেকের ধারণা ছিল, উপমহাদেশের অন্যান্য এলাকার আগে পূর্ব বাংলায় বিপ্লব সংগঠিত হবে। প্রসাদ রায়দের মতো তরুণ কমিউনিস্টদের মধ্যে তখন বিপ্লবের নেশা। সেখানে তত দিনে হার মেনে গেছে সব ব্যক্তিগত বা পারিবারিক স্বার্থ।
কারাজীবনে সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হন তিনি ১৯৫০ সালে, রাজশাহী জেলের খাপড়া ওয়ার্ডে।
বন্দীদের অমানুষিক শাস্তির বিরুদ্ধে রাজশাহী জেলে সোচ্চার হয়েছিলেন কমিউনিস্টরা। দেশ বিভাগের পর এটিই ছিল কমিউনিস্টদের প্রথম প্রকাশ্য বিদ্রোহ। আর এ বিদ্রোহকে দমন করতে রাজশাহী জেলের সব কমিউনিস্ট বন্দীকে খাপড়া ওয়ার্ডে নিয়ে নির্বিচারে গুলি চালানো হয়। হাতের কাছে যা ছিল, তা-ই নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন কমিউনিস্টরা। বেপরোয়া গুলির পর দুই ঘণ্টা ধরে চলেছিল বিরামহীন লাঠিপেটা।
সে বিদ্রোহে সাতজন কমরেড শহীদ হন। মারাত্মক জখমের তালিকার প্রথমজন প্রসাদ রায়। তাঁর বাঁ ঊরুতে গুলি লেগেছিল সাতটি, লাঠিপেটায় উপড়ে গিয়েছিল সামনের পাটির দাঁত, মাথা ফেটে অস্বাভাবিক রক্তপাত হয়েছিল। গভীর রাতে ঘটে যাওয়া হত্যাযজ্ঞের পর আহত কমরেডদের হাসপাতালে নেওয়া হয় পরদিন দুপুরের পর। সময়মতো নেওয়া হলে শহীদের তালিকা হয়তো কিছু সংক্ষিপ্ত হতো।
আশ্চর্যজনকভাবে সেদিন বেঁচে যান প্রসাদ রায়। যতবার তাঁর কাছে খাপড়া ওয়াডের্র গল্প শুনেছি, প্রতিবারই বলতেন, ‘বেঁচে আছি এটাই তো বোনাস। ’ ২২ বছর বয়সে যেমন বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন গুলির মুখে, আমৃত্যু দেখেছি তেমনই বিরুদ্ধ বাতাসে রুখে দাঁড়াতে।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনীর অন্যতম সংগঠক ছিলেন। করিমপুর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন।
প্রতিনিয়ত মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে স্থির ও অবিচলভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন। ‘না’ বলতে পারতেন খুব স্পষ্টভাবে। যখনই অন্যায়, তখনই প্রতিরোধ ছিল তাঁর বৈশিষ্ট্য। একবার পাবনা জেলা প্রশাসনের ডাকা এক সভায় স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রতিনিধিদের দেখামাত্র প্রতিবাদ করেছিলেন। বিপাকে পড়ে শেষ পর্যন্ত প্রশাসন বাধ্য হয়েছিল জামায়াতে ইসলামীর প্রতিনিধিদের বের করে দিয়ে সভা চালাতে।
নিজস্ব স্বভাবসুলভ দৃঢ়তার কারণেই তিনি পরিণত হয়েছিলেন পাবনার রাজনৈতিক অভিভাবকে। সব রাজনৈতিক সংকটে তাঁর বাড়িই ছিল সভাস্থল। শেষ সিদ্ধান্তের জন্য তাঁর দিকেই দৃষ্টি সবার। সকল স্তরের মানুষ তাঁকে বন্ধু ভাবতে পারত অনায়াসে, ভালোবাসত প্রাণ দিয়ে। সাহসের মতোই আরেক অনন্য হাতিয়ার ছিল তাঁর, তা হলো কণ্ঠ।
ভরাট উদাত্ত কণ্ঠ ছিল তাঁর। কোনো অনুষঙ্গ দরকার হতো না, খালি গলায়ই গাইতেন। জেলখানায় প্রসাদ রায়ের উদাত্ত গণসংগীতই ছিল প্রতিবাদের হাতিয়ার। নবীন কমরেডরা প্রাণে উদ্দীপনা পেতেন তাঁর গানে।
প্রাণ থেকে প্রাণে স্বপ্ন ছড়িয়ে দিতে জানতেন তিনি, জানতেন প্রাণে প্রাণ মেলাতে।
দোতারা বাজাতে পারতেন নিপুণ হাতে। শাস্ত্রীয় সংগীতে ছিল অনায়াস দখল। দিনব্যাপী পার্টির জটিল তাত্ত্বিক সভার পর মধ্যরাতে তাঁর ঘর থেকে ভেসে আসত ভরাট কণ্ঠে মিঁয়াকি মল্লার বা মালকোষের তান। ডুবে আছেন সুরে, একাকী। বিস্ময় জাগত।
আদর্শের সঙ্গে জীবনাচরণকে মেলানোর আশ্চর্য শক্তি ছিল তাঁর। যা বলছেন তা বিশ্বাস করেছেন এবং জীবনে তার চর্চা করেছেন। বাড়িতে যখন দিনব্যাপী মিটিং চলত, তখন দেখেছি, শুনতেন খুব মনোযোগ দিয়ে, যেন প্রথমবার শুনছেন। বোঝাতেন আরও মনোযোগ দিয়ে, আরও সরল করে। বহুমত ধারণ করতে পারতেন।
প্রভাবিত করতে পারতেন আরও বেশি। শ্রমিক থেকে শুরু করে বিদগ্ধ বুদ্ধিজীবী, প্রসাদ রায় সবার বোধগম্য করে বলতে পারতেন।
পাহাড়ের গায়ে জন্ম নেওয়া গুল্ম যেমন বুঝতে পারে না পাহাড়ের বিশালতা, তেমনই এই বিশাল মানুষটির খুব কাছে থেকেও তাঁকে জানা হয়নি ভালো করে। সেই না জানার বেদনা আজ বড় বেশি আচ্ছন্ন করে।
বৃত্বা রায় দীপা : কমরেড প্রসাদ রায়ের কন্যা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।