কলম চালাই ,এইগুলো লেখার পর্যায়ে পরে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে :) ব্লগের বয়স বছরের উপরে দেখালেও নিয়মিত লিখছি ১৭ আগস্ট ২০১২ থেকে :)
( যে কারনে জুতা খুলিয়া প্রবেশ করিতে বলিলাম , অনেক খায়েস কইরা লিখছি একখান ভয়ানক ভুতের গপ্প , মাগার সাহসী ভাই-বইনেরা কেউ কেউ আবার ভয় না পাইয়া খেইপা গিয়া উল্টা জুতা ছুড়িয়া মারেন , এই ভয়ে । শত হইলেও আমার মান সম্মান আছে না ! হিহিহিহিহ আমি তো আর বুশ না ! তবে হাতের ঘড়ি কিংবা মোবাইল ছুড়িয়া মারিলে তাহা নাজরানা হিসেবে গণ্য করা হইবে । সবাইকে অনেক অনেক ধইন্না ভাত !!
এক।
সাদা চকের মত উঠানের মাঝখানে দাড়িয়ে আছে জামাল । পায়ে প্লাস্টিকের স্যান্ডেল ।
ধুলোবালি মাখা । পরনে একটা সাদা পায়জামা । কোমরের কাছে কুঁচিয়ে হাঁটু পর্যন্ত তুলে রাখা । গায়ে তেল চিটচিটে একটা রঙ ক্ষয়ে যাওয়া সবুজ শার্ট । হাতে তার কাঁসার পাতিল ।
কতগুলো বড়াপিঠা তার মাঝে । মা বানিয়ে দিয়েছে । শক্ত সমর্থ যুবক পোলা সে । গতরে খেটে খায় । মাথার চুল থেকে তেল বেয়ে তার মুখ তৈলাক্ত করে রেখেছে ।
সন্ধ্যাবেলার এই ম্লান আলতেও তার চেহারা চকচক করছে ।
-কাকীমা ...?
বলে চিৎকার করে ডাকল সে । কোন সাড়াশব্দ নেই । পুরো বাড়িটা যেন খাঁ খাঁ করছে , নিঝুম হয়ে আছে । একটা কুকর বেড়ালও দেখল না সে ।
কোথাও কিছু নড়ছে না । সবকিছু দম বন্ধ হয়ে পড়ে আছে । মাঝে মাঝে বাতাসের জোরে নারকেলের শুকন পাতা নড়ার সড়সড় শব্দ ।
চার গ্রাম পার হয়ে এসেছে সে । পায়ে হেটে ।
ধুলোবালিতে পা সুরসুর করছে । স্যান্ডেল খুলে ফেলে জামাল । আহ ! পায়ে আরাম পাওয়া গেল । উঠোন এখনও কুসুম কুসুম গরম । সারা দিন রোদে পুড়েছে ।
বাড়িটার চারিদিকে আবার ভালো করে তাকাল সে । গৃহস্থলী বাড়ি । একটা বড় ঘর , একটা রান্ধন ঘর আর একটা গরু ঘর নিয়া পুরা বাড়ি । এক কোনে সরু একটা মাটির পথ চলে গেছে পুকুর ঘাটের দিকে । বেল গাছের নিচ দিয়ে সেই পথ – এখনি অন্ধকার করে ফেলেছে গাছের ছায়াগুলি ।
সে দিকে তাকালো জামাল । সন্ধেবেলার ছায়াগুলো যেন জীবন্ত , নড়ছে ।
রান্ধন ঘরে গেল সে । সুন্দর করে পরিপাটি করে রেখেছে তার কাকী । যত্নবান মানুষ ।
লাকড়ি বাকড়ি নেই কোন রান্ধন ঘরে । কাকা ঘরে পড়ার পর নাকি তার ছেলেরা ঢাকা থেকে টাকা পাঠাইছিল । কাকী গঞ্জ থেকে গ্যাসের চুলা কিনছে । বৃষ্টি বাদলে যেন লাকড়ি বাকড়ির কষ্ট না করা লাগে , তাই । কিন্তু রান্নাঘরে গ্যাসের চুলা দেখল না সে ।
বড় ঘরের দরজায় শিকল উঠানো , একটা ছোট তালা ঝুলতেছে । কি বেগতিক ! কই গেলো ? কাকারে দেখতে আসছে সে । কালকেই ফিরতে হবে । হাটবার । মেলা কাজ ।
-কাকীমা ......?
ঘাটলার দিক থেকে কি কোন শব্দ হল ? হুম ! তাইতো !
-কাকীমা কি ঘাটলায় নি ? ও কাকী ?
এবারে আরও একটু জোরাল শব্দ হল । যেন পানিতে কেউ ছলাৎ ছলাৎ করছে । উঠোনের কোনে সরু পথটা দিয়ে জামাল পুকুরের দিকে হাটতে লাগল । চারপাশে গা থমথমে পরিবেশ । আশেপাশের বাড়িগুলো থেকে এ বাড়িটা একটু ছিন্নছাড়া , একলা ।
সরু সরু শত শত সুপারি গাছ , আর তার মাঝে কাকার এই বাড়ি । সেই গাছের ফাকে অন্ধকারগুলো যেন জমাট বেধে আছে । সুপারি গাছের মাথাগুলো বাতাসে হেলছে দুলছে । যেন না না করছে নিঃশব্দে ।
বেল গাছের তল দিয়ে যাওয়ার সময়ই নাকে একটা ঘ্রাণ পেল জামাল ।
বেলফুল ? সুন্দর একটা ঘ্রাণ । ঘাটলার দিকে যেতেই সে ঘ্রাণ আরও প্রকট হল ।
- কাকীমা ঘাটলায় নি ?
- হ । বাজান এইত্ত ।
অস্পষ্ট স্বরে জবাব দিল কাকীমা ।
- কৈ ? দেহি না তো !
- ঘাটলার নিচে বাজান ।
ঘাটলার উপরে দাড়িয়ে কিছুই দেখল না জামাল । গাছের গুড়ির ঘাতলা বেয়ে কিছুদুর নামতেই মনে হল , সে যেন কিছু দেখতে পাচ্ছে । আরে হ্যাঁ ! ঐতো । কাকীমা ঘাটলার একেবারে শেষ মাথায় অর্ধেক পানিতে বসে আছে ।
দ্রুত অন্ধকার হয়ে আসছে চারিদিক । গন্ধটা আরও প্রবল হল । যেন জামাল কোন ফুল বাগানে দাড়িয়ে আছে । গন্ধটা চিনতে পেরেছে সে । হাসনাহেনা !
- কাকীমা কি গোসল দিতাছ নি ?
- না গ বাজান ।
এইবার স্পষ্ট স্বরে বললেন কাকীমা ।
-হাতপাও ধুইতে আইছিলাম ।
- বাতি লইয়া আইবা না ? রাইত বিরাইত । সাপ কোপ আছে না !
- বাতি রাহনের জাগা নাই তো বাজান ।
-তরতরি উইট্টা আহ ।
ঠাণ্ডা লাগছে নি ? খন খন করতাছ যে !
- হ । বাজান । এত্তু ঠাণ্ডা লাগছে । শেষ রাইতে শিত করে ।
ঘাটলা থেকে উঠে এলেন কাকীমা ।
মাথায় ঘোমটা টানা । পাড়াগাঁয়ে সব মায়েমানুষই ঘোমটা টানে । আশি বছরের বুড়িও । মনে মনে হাসে জামাল । কাকিমা নাক দিয়ে ঘর ঘর শব্দ করছে ।
ঠাণ্ডা ভালই লাগছে বুড়ির ।
-অশুদ পত্তর খাইছ নি ?
- না বাজান । এম্নিতেই সাইরা জাইব নি ।
- ও কাকী ...
-হুম ?
- কাকা কি আছানক জুয়ান হইয়া গেল নি ?
জামালের গলায় পরিহাস ।
- ক্যান ? এই কতা কইলা ক্যান ?
- না মানে তোমার গতর তনে সুবাস আইতাছে ।
কাকা কি সুবাস কিনা আনছে নি তোমার লেইগা ? গঞ্জে তনে ?
কাকীমা কিছুক্ষন চুপ করে রইল । হাটতে হাটতে বেল গাছের নিচে চলে এসেছে ওরা । হঠাৎই মনে হল এক ঝাপটা বাতাস বয়ে গেল । না , জামালের গায়ে কোন বাতাস লাগে নি । পেছনে তাকাল জামাল ।
আবছা আলোতে পুকুর পাঁড়ের গাছপালাগুলো বাতাসে দুলছে – হালকা হালকা । যেন দম ফেলছে । একটু আগেও না থমথমে ছিল ? জামাল ভাবে ।
- কইলা না ?
- কি?
- কাকায় কি সুবাস কিনছে নি তোমার লেইগা ?
- সুবাস না বাজান । একটা সাবান কিনছে ।
মৌ মৌ গ্রান বাইরায় ।
কাকীমার হাতে কোন সাবান দেখল না জামাল । বলল ,
- সাবান কি ঘাটে রাইক্ষা আইছ ?
- হু ।
- চোরে নিব না ?
কাকীমা খনখন করে হাসেন । ঠাণ্ডায় গলা বসে গেছে ,
- চোর পাইবা কৈ বাজান ? সাবান চুরি করব না কেউ ।
ঘরের দিকে যেতে যেতেই হঠাৎ কাকীমা কি মনে করে রান্ধন ঘরের দিকে ঘুরে গেলেন ।
- আহ । বাজান । রান্ধন ঘরে বহি । খিদা লাগছে না তোমার ?
- হ গোঁ কাকী ।
পেট জলতাছে ।
রান্নাঘরের এক কোনে পিঠার পাতিল রাখল জামাল – মায় পিডা পাডাইছে । বরা পিডা ।
কাকীমা একটা হোগলা পাটি বিছিয়ে দিল । বসল তাতে জামাল ।
- আরাম কইরা বহ বাজান । বেড়ার লগে হালাম দেয়া বহ ।
বেড়ার সাথে হেলান দিয়ে বসল জামাল । চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে তার । ক্লান্ত ।
রান্নাঘরের চারিদিকে যেন কালিগোলা অন্ধকার । কিন্তু উঠোনটা এখনও মোমের মত সাদা , আলো ছড়াচ্ছে । শরীর জুরিয়ে এল জামালের । ঠাণ্ডায় । নাহ , বাতাস বইছে না ।
চোখ বুজল সে ।
চোখে ঘুম নিয়েই উঠে বসল জামাল । কাকীমা ডাকছে । খাবার বানিয়েছে তার জন্য । চারিদিকে এত্ত অন্ধকার ? কৈ না তো ! পাটির উপরে খাবার তো সে ঠিকই দেখতে পাচ্ছে ।
ঘুম চোখে কতকিছু দেখে ! মনে মনে আবার হাসল জামাল । খেতে খেতে শ্লেষ্মা জরানো কণ্ঠে জামাল কাকীমাকে জিজ্ঞেস করল – কি রানছো এইডা কাকীমা ?
কাকীমা হাসি হাসি কণ্ঠে বললেন – ঘুন্ডি বাজান । বাজার সদায় করা হয় নাই ত । কাইল্কা বালা কিছু রান্দুমনে ।
ভর্তার মত ঘুন্ডি খেতে লাগল জামাল ।
ঠাণ্ডা কেন ? এতো ভাবার সময় নেই । এতদূর হেটে এসে খিদে লেগেছে তার । কেমন যেন একটা বুনো স্বাদ ঘুন্ডিতে । বেতফলের ঘ্রাণ পেল জামাল । আরও কি কি যেন – খেয়াল করতে পারল না সে
দুই।
বড় ঘরের বারান্দায় একটা চৌকিতে শুয়ে আছে জামাল । উঠে বসল সে । গায়ে পুরানো একটা কাথা । তেলের গন্ধ আসছে তা থেকে । মাথাটা ওর যেন ঝিম মেরে আছে ।
অনেক ভারী ।
কাকীমা চিন্তিত মুখে চৌকির এক কোনে বসে আছেন । পাশে দাড়িয়ে আছে রেশমা । কাকাদের বাড়িতে পেটে ভাতে খায় ।
- বাজান কহন আইছ ?
- কাইলকা ।
- কাইলকা ? কও কি ? একটা খবর পত্তর দিয়া আইবা না ?
- কাকারে দ্যাখতে আইছিলাম ।
- ও । তোমার কাকার কাইলকা শরিলডা বেশি খারাপ হইয়া গেছিল । গঞ্জে আহাশপাতাল নিছিলাম । রাইতে থাহন লাগছে ।
মাথা ঝেরে ভালো করে কাকীমার দিকে তাকাল । পঞ্চাশঊর্ধ্ব গৃহস্থ মহিলা । জামাল বলল – ঠাণ্ডা লাগে নাই তোমার ?
- ঠাণ্ডা লাগব ক্যান বাজান ? অহন কি বাদলার দিন নি !
- কাইলকা বাড়িতে আছিলা না তোমরা ?
- কইত্তন ! আহাশপাতাল আছিলাম তোমার কাহার লগে । ক্যান বাজান ?
কথা বলে না জামাল । হঠাৎই পেট মুচড়ে ওঠে তার ।
অসম্ভব ব্যথা । যেন পেটের নাড়িভুঁড়ি পেটের মধ্যে মুচড়ে মুচড়ে ঘুরপাক খাচ্ছে ।
- বাজান কি শইলে বেদনা ? পানি খাইবা ?
জামাল মাথা নাড়ে । হ্যাঁ । কাকীমা পানি আনতে যান ।
রেশমা বলল – বাইজান ?
- হু?
- একখান কতা জিগামু ?
- ক ।
-বাইজান কি গোন্ধয়ালা সাবান মাহেন ? গতর তনে সুবাস আইতাছে । বেডি মাইনশের লেহান ।
ফিক করে হেসেই দৌড় দিল রেশমা । লজ্জা পেয়েছে ।
।
...........................................................x.......................................................... ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।