আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রসঙ্গ ‘মেহেরজান’-৪



ছবিতে ৩জন মুক্তিযোদ্ধাকে দেখানো হয়েছে, যাদের প্রত্যেককে নারীলিপ্সু হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে । এই ৩জনের কারো হাতে কখনোই কোনো অস্ত্র দেখা যায়নি, কেবল দেখা গেছে অন্ধকারে আড়ালে-আবডালে নারীর গা হাতাতে ! মেহেরের মুক্তিযোদ্ধা-খালাতোভাইকে রীতিমতো গতানুগতিক ঢালিউডি সিনেমার প্রতিহিংসাপরায়ণ ভিলেন হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে এবং মেহেরকে দিয়ে তাকে থাপ্পড় পর্যন্ত মারানো হয়েছে,এই থাপ্পড় ইনজিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে মুক্তিযোদ্ধার পশ্চাদ্দেশে শিবিরপ্রদত্ত লাথির কথা মনে করিয়ে দিল ! ছবির কেন্দ্রীয় নারী অষ্টাদশী মেহেরকে যতভাবে যৌনাবেদনময়ী করে হাজির করা যায়, পরিচালক তাই করেছেন । সত্তরের দশকে একজন বাঙালি যুবতী বুকখোলা বসন পরত কি না, সে বিষয়ে পরিচালকের ধারণা নেই । গোটা ছবিতেই নারীকে যৌনউপকরণ হিসেবে প্রতিপন্ন করা হয়েছে,অন্দরে-চায়ের দোকানে পাকসেনাদের প্রশংসা করানো হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধাদেরকে যৌনান্ধ খলনায়ক বানানো হয়েছে এবং অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়েছে একাত্তরে বাঙালি নারীরা সেধে সেধে পাকসেনাদের সাথে সঙ্গম করেছে !আশা করি, দেশের কোনো সাহসী ব্যক্তি রুবাইয়াত হোসেনের নামে মানহানি মামলা করবেন; আরেকটু আগ বাড়িয়ে আশা করি, রুবাইয়াত হোসেনকে অবিলম্বে গ্রেপ্তার করা হবে । মনে হয় ছবির পরিচালক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ছবি দেখে অনুপ্রেরণা বোধ করেছেন, যেখানে ইহুদি মেয়ের সাথে নাৎসি অফিসারের প্রেম (ব্লাক বুক) কিংবা নাৎসি মেয়ের সাথে মিত্র বাহিনীর অফিসারের প্রেম (ড্রেসডেন)।

৭১ এর ২রা এপ্রিলে জিঞ্জিরায় যে নারকিয় হত্যাযজ্ঞ সংগঠিত হয় সেখানে জনৈক পাঞ্জাবি অফিসারের কারণে ৫০-৬০জন বাঙালি প্রাণে বেচে গিয়েছিল, একথা আমি প্রত্যক্ষদর্শির মুখে শুনেছি। এধরনের ঘটনাও বিরল। পাকিস্তান বাংলাদেশের কাছে আজ অবধি ক্ষমা প্রার্থনা করেনি, আর আমরা এখন পাকি সম্প্রীতির চলচ্চিত্র বানাই, বাহ্‌ বাহ্‌, এই না হলো গোল্ডফিশ মেমোরী বাঙ্গালীর। পাক-ভারত সঙ্ঘাতের সাথে ২৫ মার্চ ও তার পরবর্তী পাকি নির্যাতন-খুন-ধর্ষণ, কোন দিক দিয়ে সমতুল্য? একটু বুঝিয়ে বলবেন, চলচ্চিত্রর পক্ষের লোকেরা? পরিচালক দাবি করেছেন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ছবি করার আগে তিনি মুক্তিযুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণ নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা করেছেন। ঠিক যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ক্যানভাস অনেক বড়, কিন্তু বিনয়ের সঙ্গে প্রশ্ন রাখতে চাই, গবেষণা আর ইতিহাসের কোথায় এমন উপাদান রয়েছে, যেখানে বাংলাদেশে যুদ্ধরত পাকিস্তানি কোনো সেনাসদস্য নিজ দল ত্যাগ করে বাঙালিদের নৈতিক সমর্থন দিয়েছে? বাঙালি কোনো নারীকে ধর্ষণ না করে ধর্ষণের হাত থেকে বাঁচিয়েছে? কিংবা যুদ্ধের ওই সময়ে এর প্রমাণ কোথায়, যেখানে একজন বাঙালি নারী পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে খুন হওয়া তার ভাইয়ের রক্ত আর ধর্ষিতা বোনের পাঁজরের ওপর দাঁড়িয়ে পাকসেনার সঙ্গেই নির্লজ্জ প্রেমে মেতেছে? কোথায় এর দলিলদস্তাবেজ? ছবির পরিচালক ৩০ লাখ শহীদ আর দুই লাখ ধর্ষিত নারীকে অপমানের কী মোক্ষম অস্ত্রই না বেছে নিয়েছেন! মুক্তিযুদ্ধ পুরো জাতির গর্ব আর চেতনার সঙ্গে সম্পর্কিত—সেই মুক্তিযুদ্ধের এই অপমান।

বীরাঙ্গনা নিয়ে যখন আমরা কোনো ভালো ছবি করতে পারিনি, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে যখন সফল কোনো ছবি করতে পারিনি, তখন পাকিস্তানি-বাঙালির এহেন প্রেমজ ছবি আমরা বানিয়ে ফেললাম, যার কোনো বিন্দুমাত্র ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। আসলে মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ বেদনা আর গভীর কষ্ট বোঝার সামর্থ্যই এ ছবির কলাকুশলীদের নেই। হত্যা আর ধর্ষণের জন্য পাকিস্তানিদের যখন ক্ষমা চাওয়ার দাবি তোলা হচ্ছে এবং এখন পর্যন্ত পাকিস্তান রাষ্ট্রীয়ভাবে যা করেনি, ঠিক তখন বাঙালি নারী-পাকসেনার প্রেমের ‘উপরিচালাকি’র এই নির্জলা ইতিহাস বিকৃতির অর্থ আসলে অনেক গভীরে। এটি কেবল মেহেরজান চলচ্চিত্রের সঙ্গে জড়িত কলাকুশলী, যাদের আমরা দেখতে পাচ্ছি, কেবল তাদের দেখে বোঝা যাবে না, এর শেকড় অনেক ভেতরে, আরও কোনো গভীর মতাদর্শিক কূটচাল এর পেছনে রয়েছে। এই সিনেমার মূল আপত্তিকর দিকটা হলো, যে এখানে মুক্তিযোদ্ধা, বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মী (তথা তৎকালিন যুবসমাজের ৯০% এর প্রতিনিধি) এবং বুদ্ধিজীবিদের কে হেয় করে দেখানো হয়েছে।

সিনেমার নির্মাতা এখানে বলতে পারেন, 'আমরা তো বলিনাই যে সব মুক্তিযোদ্ধা খারাপ!' কথা হলো, সিনেমাতে দেখানো সব মোটামুটি সব বাঙালী হয় দুঃশ্চরিত্র নয় পাকিস্তানের চামচা। আর প্রধান চরিত্র পাকিস্তানী; সে মহান চরিত্রবান এক সুপুরুষ সৈনিক। একটা সিনেমা সবসময় একটা সমাজের, একটা দেশের, এবং একটা মূল্যবোধ ও মতবাদের প্রতিনিধিত্ব করে। ফলে, ছবিটা শুধু 'একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা' না হয়ে, পুরো জাতির একটা আইকনে পরিণত হয়। এর উপর নির্ভর করে, আমরা নিজেদেরকে কিভাবে চিহ্নিত করব, আর পুরো বিশ্ব আমাদেরকে কিভাবে চিনবে।

এ কারণেই আমাদের যত আপত্তি। ১% খারাপ মুক্তিযোদ্ধা, ১% ভীরু কাপুরুষ বুদ্ধিজীবি আর .০০১% ভাল পাকিস্তানী সেনাদের প্রতিনিধিত্বকারী সিনেমা 'মেহেরজান' বাংলাদেশ থেকে মুক্তি পেয়ে অবশিষ্ট ৯৯% বীর মুক্তিযোদ্ধা আর শহীদ বুদ্ধিজীবিদের মারাত্মক অপমান করেছে। আর এক বেলুচ সেনার মধ্য দিয়ে পুরো পাক-আর্মির গণহত্যা ও গণধর্ষণকে হালাল ও বৈধকরণের চেষ্টা করেছে। আজকের প্রথম আলোতে রুবাইয়াত নিজেকে ডিফেন্ড করছেন । ব্লগে কিংবা যেকোন আলোচনায় পাকিস্তানপ্রেমীরা যেভাবে ইতিহাস হাতড়ে খুঁজে মরেন মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তেমনিভাবে তিনি হাতড়ে খুঁজেছেন কতজন নারী ধর্ষিত হয়েছেন, আর তার তথ্য প্রমাণ।

প্রশ্ন জাগে আর কতজন নারী ধর্ষিত হলে তিনি সঠিক ইতিহাস খুঁজে পেতেন ?? নিজেকে ডিফেন্ড করতে তিনি তথ্য প্রমাণ খুঁজেন অথচ তিনি তার সিনেমা নির্মান করেছেন ঐতিহাসিক পটভূমিতে কিন্তু কল্পনার ভিত্তিতে। নাকি তিনি খুঁজছিলেন পাকিস্তানীদের মহান বানানো দলিল-দস্তাবেজ ? না পেয়ে তিনি আশাহত হয়েই এমন কাল্পনিক আখ্যানের আশ্রয়ে মুক্তিযুদ্ধকে হেয় করে বীরঙ্গনাদের যাতনাকে নিয়ে এমন রঙ্গলীলায় মেতে উঠেছেন !?! আর পাকিস্থানী মেজরকে বানিয়েছেন তার হিরো । নৃশংস পাকিস্তানী হয়েছে মহান !! এমন পাকিস্তানপ্রেম এর জন্য তাকে বাহবা পেতেই পারেন !!!!!! তবে মজার বিষয় হচ্ছে তিনি নাকি স্নাতকোত্তর পর্যায়ে থিসিস করেছেন বীরঙ্গনাদের নিয়ে !! আর নির্মাণ করেছেন ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর একটি উক্তি থেকে অথচ উনি প্রিয়ভাষিণীর উপর যে অন্যায় অত্যাচার আর নির্যাতন করা হয়েছে তা গৌণ্য করে ফেললেন। আর মেহেরজান নিয়ে তর্কের মাধ্যমে আমাদের সমাজের একটা দিক খুলে গেল। কাল্পনিক কাহিনী হলেও আমাদের সিনেমায় একটা বড় বাঁকের মুখে আমরা এসে দাঁড়ালাম।

এখন থেকে সব ইতিহাস এক চোখে দেখা হবে না। মাঝামাঝি দেখার জন্যও তো একটা উইন্ডো দরকার ছিল, সেটা পাওয়া গেল এখন। গল্পের শাখা-প্রশাখা বাদ দিলে ছবির মূল থিম বেশ চমকপ্রদ, সাহসীও বলতে হবে। ক্যামেরার কাজও ভালো। এডিটিং-এ একটা ছন্দ আছে।

পুরো ছবিতে একটা বিশেষ কালার [গোলাপী] ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন পরিচালক। দোলনা, কবুতর, প্রকৃতি কাব্যিকভাবে ধরা পড়েছে ক্যামেরায়। ঝকঝকে পর্দা। অভিনয়ে ভিক্টর ব্যানার্জি অপ্রতিদ্বন্দী। পরিচালকের সবচাইতে বাধ্য অভিনেতা মনে হয়েছে তাকেই।

তার অভিনয়ে ঢাকা পড়ে গেছেন জয়া বচ্চন। ভালো অভিনয় করেছেন ঋতু সাত্তার, শায়না আমিন, আজাদ আবুল কালাম, স্বল্প চরিত্রের শতাব্দী ওয়াদুদ এমনকি পরিচালক নিজেও। অভিনয়ে ভালো করেননি পাকিস্তানি অভিনেতা ওমর রহীম। এত গুরুত্বহীন একটি চরিত্রে হুমায়ুন ফরীদি অভিনয় না করলেও পারতেন। তবে গল্প বলায় পরিচালক মুন্সিয়ানা দেখাতে পারেননি।

অসঙ্গতি প্রচুর। বড় অসঙ্গতি চরিত্রগুলোর মুখের ভাষা। এ সময়ের ‘ডিজুস’ উচ্চারণ একাত্তরে, এও সম্ভব! একই এলাকার মানুষ, তবুও একেকজনের মুখে একেক রকম ভাষা। বেশি কানে লেগেছে ‘খাইছি, করছি’। এর পরেই আসে পোশাক।

বলিউডি নায়িকাদের মতো শায়নার আটসাট সালোয়ার কামিজ সময়ের প্রেক্ষাপটে পুরোপুরি বেমানান। ঋতু যে বোরকাটি পরেছেন সেটি এ সময়ের আধুনিক মেয়েদের। ওয়াসিম খানকে পাকিস্তানি সেনারা খুঁজছেন, মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ার ভয়ও আছে। এমন অবস্থায় মেহেরজানের হাতে হাত রেখে নির্ভয়ে ঘুরে বেড়ানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই। এত বিতর্ক আর অসঙ্গতির পর এ ছবিটি যদি অস্কারেও চলে যায়, তাতে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না।

কারণ, কারো ‘হাহাকার’, অন্য কারো ‘বিশেষ উদ্দেশ্য’ থাকে যে ছবিটিকে ঘিরেÑ তৃতীয় বিশ্বের সে ছবিগুলোরই ডাক পড়ে অস্কারে। আফসোস!

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।