আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চারুলতা - প্রথম পর্ব

"আমারে ফিরায়ে লহো অয়ি বসুন্ধরে, কোলের সন্তানে তব কোলের ভিতরে"-শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সকালের ঘুমটা দেরী করেই ভাঙতো রাতুলের। তারপর আধঘন্টা বিছানার এপাশ থেকে ওপাশে গরাগরি আর এক পর্যায়ে মা এসে ধমকের সূরে বলতো,"কি শাহেনশা!!! আজ আপনার ক্লাশ নেই?কোন দিন তো বাজারে পাঠাতে পারলাম না। ববা একা একা বাজার করে, আর গাধার মত একটা ছেলে ১২ টা পর্যন্ত ঘুমায়। কবে যে জ্ঞান বুদ্ধি লাজ লজ্জা হবে। কিছুদিন পর বিয়ের বয়স হবে।

এখনো কিছুই শিখে নাই। " এই চিরন্তন বানীগুলা শুনতে শুনতে মুখস্ত হয়ে গিয়েছিলো রাতুলের। মনে মনে ভাবতো মোবাইলে এলার্ম দেয়ার চেয়ে মায়ের এই অটোমেটিক এলার্মটা খারাপ না। মাকে শুধু বলতো,"এইবার অব যাও, প্লিজ। এইকথাগুলা মুখস্ত হইয়া গেছে।

এইবার নতুন কিছু ব্যাবহার কর। " বিরক্তির ভাব দেখালেও এই কথাগুলো ভালোই লাগতো রাতুলের। আর যখন বাইরে থাকতো মায়ের এই কথা গুলো মনে হলে একা একাই হাসতো। সকালে দেরী করে উঠা,এক রাজ্যের ঘুমে ভরা চোখ মুখ নিয়ে ক্লাসে এটেন্ড করা,টং দোকানে বসে চা আর সিগারেটের ধুয়া,রাতে বাসায় এসে গীটার নিয়ে টুং টাং প্রাকটিস আর ফেসবুকের নটিফিকেশন চেক। এসবেই সীমাবদ্ধ জীবন ভালোই লাগতো রাতুলের কাছে।

বন্ধুদের অনেকেই প্রেম করছে কেউ আবার দুই তিনটা করে। কিন্তু সেদিকে খেয়াল ছিলো না ওর। প্রেম নামক জিনিসটা কিছুটা পাপের শাস্তি বলে মনে হতো তার কাছে। কারন দুনিয়াতে গার্লফ্রেন্ড হচ্ছে এমন এক চিজ যে কিনা কারনে অকারনে, বৈধ অবৈধ,পার্থিব আপার্থিব,কাঙ্খিত অনাকাঙ্খিত,সম্ভব অসম্ভব যতসব আপেক্ষিক আবদার করে বসে। এই যেমন,রিক্সায় দুইজন কোথাও যাচ্ছে বলবে, চলোনা আমরা হেঁটে যাই , আবার হাঁটতে থাকলে বলবে, এত কিপ্টা কেনো তুমি একটা রিক্সা ডাকো, হান্ডব্যাগ থাকলে বলবে এই তুমি এটা হাতে নাও আবার কিছুদূর হাটার পরে বলবে এই শোন ব্যাগ থেকে আমার আয়না আর লিভলোজটা বের করে দাও না।

আবার দেখা যাবে মাঝরাতে ঘুমিয়ে আছেন তখন ফোন করে বলবে,"শোন আমার ঘুম পাচ্ছে না,আমি সারারাত তোমার সাথে কথা বলবো,তুমি কিন্তু ঘুমাবা না। চোখ বন্ধ কর,দেখো আমরা এখন সমুদ্রের পাড়ে,তোমার হাতে আমার হাত,আমরা এখন সাগরের জলে নামবো। " দেখাযাবে মাঝরাতে ঘুম ভাঙিয়ে আপনাকে গলা পর্যন্ত পানিতে নামিয়ে সে দিব্যি ঘুমিয়ে পরেছে। আর সারারাত আপনি এপাশ থেকে ওপাশ করছেন কিন্তু ঘুমাতে পারছেন না। রাত তখন ২ টা।

দলছুটের "তোমার বাড়ির রঙের মেলায়" গানটা গীটারে তুলেছে রাতুল। A মাইনর C মাইনর আর D সার্প দিয়ে গানটা শেষ করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে গ্রিলের ফাঁকে আকাশের দিকে তাকিয়ে মহাশূন্যের কক্ষপথ আর বিষুব ও কর্কটরেখার মিলন দেখার বৃথা চেষ্টা করছিলো। এমন সময় মোবাইলের টিউন বেজে উঠলো..... হ্যালো!!!!! ওপাশ থেকে একটি মেয়ের কন্ঠ শোনা গেলো। না মেয়েটি রাতুলের অপরিচিত নয়। ঈনিয়া ফোন করেছে।

ওরা একই ভার্সিটিতে পড়ে। তবে ডিপার্টমেন্ট ভিন্ন। ঈনিয়ার বাবা বেশ বড় ব্যাবসায়ী। ধানমন্ডিতে দুইটা বাড়ি আছে ওদের। মা নেই।

সে জন্যই হয়তো মায়ের অভাবটা ও একটু বেশীই ফিল করে। ব্যবসায় ব্যাস্ত থাকলেও ভদ্রলোক মেয়েকে যথেষ্ঠ সময় দেন। রাতুলের প্রতি ঈনিয়ার অনেকটা দূর্বলতা ছিলো। আকার ঈঙ্গিতে অনেকবার প্রকাশ করলেও সরাসরি বলতে পারতো না। যদি বন্ধুত্ব নষ্ট হয় এই ভয়ে।

রাতুল বুঝতে পারতো না বলে মনে মনে অনেক রাগ হলেও ওর হেয়ালিপনাই ভালো লাগতো মেয়েটির। ঈনিয়া: হ্যালো রাতুল??? রাতুল: না,তোর নানা। ঈনিয়া: ফাজলামি করিস না,জরুরি কথা আছে। রাতুল: বল, ঈনিয়া: খালামনি কাল সকালে ওনাদের বাসায় যেতে বলেছেন। আমি একা গেলে বাসায় টেনশন করবে।

তুই আমাকে একটু নিয়ে যাবি দোস্ত?প্লিজ। রাতুল: একা যেতে কে বলেছে?তোর বাবার গাড়ি নিয়ে যা। আমি তোর জামাই না বয়ফ্রেন্ড যে তোকে নিয়ে যাব। আমি সকালে উঠতে পারবো না। তাছাড়া তোর একটা হাতির মত খালাতো ভাই আছে না?ওকে বল এসে নিয়ে যেতে।

ঈনিয়া: থাক থাক তোর আর বলতে হবে না। আমি একবার সুনজরে তাকালে কত ছেলে পাগল হয়ে যাবে। তাছারা তুই তো একটা কেয়ারলেস গাধা। রাতুল: তুই কি ছেলেদের দিকে কুনজরে দেখস নাকি? ঈনিয়া: ok আর বলতে হবে না। তুই তোর ঘুম নিয়ে থাক।

bye!!! রাগ আর হতাশা মিশ্রিত সূরে ফোনটা রেখে দিলো ঈনিয়া। ততদিনে একমাস পার হয়ে গেছে। রাতুল ফেসবুকে বসে ঈনিয়ার সাথে মারামারি করছিলো। ঘটনার শুরু ঈনিয়ার একটা ছবি নিয়ে। রাতুল ঈনিয়ার একটি ছবি ঈনিয়ার ওয়ালে ট্যাগ করে লিখেছে,"তোরে দেখতে আমাদের এলাকার মরজিনা পাগলনির মত লাগতেছে।

" হঠাৎ মাউসের পাশে রাহাতের মোবাইটা ভাইব্রাশন করলো। আননোন একটা নম্বর থেকে মিসকল। রাতুল মোবাইলটা হাতে নিয়ে নম্বরটা দেখতে লাগলো। কমপ্লেক্স নম্বর। শুরুতে একটা শূন্য আর বাকীগুলো হযবরল।

আবার রাতুলের হাত কাঁপলো,হ্যাঁ এইবার কল করেছে। কলটা রিসিভ করলো রাতুল........ হ্যালো!!! ওপাশ থেকে কোন ভয়েস আসছে না। ২৬ সেকেন্ডের মাথায় কলটা কেটে গেলো। কিছুটা খটকা লাগলো রাতুলের কাছে। কে কল করলো এতোরাতে।

আবার রহস্যজনকভাবে চুপ হয়ে আছে। মলম পার্টি নাকি?নাহ ওরা তো কাওকে ফোন করে মলম লাগায় না। বর্তমানে জিনের বাদশাহরা নাকি একই প্রসেসে টাকা পয়সা হাতিয়ে নিচ্ছে। তো আমার কাছে কি চায় ওরা? এইরকম হাজার চিন্তা ঘুরপাক খেতে লাগলো রাতুলের আশেপাশে। ৩টা নটিফিকেশন, তিনটাই ঈনিয়ার।

রিপ্লে করতে ইচ্ছে করছিলো না রাতুলের। চাঁদ যেমন পৃথিবী প্রদক্ষিন করে সেই বিষয়টা ঠিক তেমনি রাতুলকে প্রদক্ষিন করছিলো। বাতি নিভিয়ে শুয়ে পরলো রাতুল। কম্পিউটার বন্ধ করেনি,২টা মুভি ডাউনলোড হচ্ছে। আধাঘন্টা পার হয়ে গেছে।

পৃথিবীর চারপাশে চন্দের প্রদক্ষিন তখনো থামেনি। ঠিক তখনি মোবাইলটায় আবার কল আসলো। রাতুল: হ্যালো...কে বলছেন প্লিজ?....হ্যালো!.....কথা বলেন না কেনো.....কথা বলবেন নাকি ফোন রেখে দেবো? ওপাশ থেকে: হ্যালো...। হ্যা একটি মেয়ের ভয়েস। মেয়েটার হ্যালো শব্দটা কিছুটা আজিব ধরনের মনে হলো রাতুলের কাছে।

কেউ যেন তার আবেগ আর ভালোবাসার সবটাই ঢেলে দিয়েছে "হ্যালো" নামক ছোট শব্দটার মাঝে। কয়েক সেকন্ডের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলো ও। আবার যখন ওপাশ থেকে মেয়েটা হ্যালো বললো তখন ঘোর ভাঙলো রাতুলের। ওপাশ থেকে: হ্যালো ফোনটা রাখবেন না প্লিজ। রাতুল: ও হ্যাঁ ...জি....জি....মানে....আপনি কে?আমি কি আপনাকে চিনি? ওপাশ থেকে: হয়তো না....আবার হয়তো হ্যাঁ রাতুল: এর মানে....আপনি আসলে কি বুঝাতে চাচ্ছেন? ওপাশ থেকে: এর অর্থটা খুবই সহজ রাতুল: দেখুন আমি খুব সাদামাটা মানুষ।

সাহিত্যিকদের জটিল ভাষা আমি বুঝিনা। আপনি দয়াকরে সরাসরি বলবেন আপনি কে? ওপাশ থেকে: বইমেলায় গিয়েছেন কখনো? রাতুল: হ্যাঁ ওপাশ থেকে: তাহলে তো সাহিত্যের কিছুটা জানেন নিশ্চই? রাতুল: দেখুন আমি বইমেলায় গিয়েছি অনেকবার। কিন্তু জীবনে একটা বইও কিনিনাই। আপনি দয়াকরে বলবেন আপনি কে? ওপাশ থেকে: একটা মেয়ে। এরচেয়ে বড় পরিচয় কি হতে পারে? রাতুল: সেটাতো বুঝতেই পারছি।

আপনার নামটা বলবেন কি? ওপাশ থেকে: নামটাই কি মানুষের বড় পরিচয়?আমিতো মনে করি মানুষ নিজেই তার পরিচয় এবং পরিচিতি। রাতুল: বলেন কি? তাহলে তো জন্মের পরে আকিকা দিয়ে কারও নাম রাখা হতো না। প্রতিটা মানুষেরই আলাদা একটা নাম থাকে। এমনকি কেমেষ্টি্রতে প্রতিটি মৌলের নাম আছে এই যেমন সোডিয়াম,টাইটেনিয়াম,ইউরোনিয়াম,আয়রন। আবার ধরুন ফিজিক্স এ লোহা,পারদ,সিলভার।

তাছারা কম্পিউটারেও আলাদা নাম রয়েছে প্রগ্রামিং,সফটওয়্যারিং,হার্ডওয়্যারিং। এমনকি শিল্পি তার ছবির নামকরন করেন যেমন লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চির মোনালিসা। বুঝতেই পারছেন নামেই মানুষের পরিচিতি। এবার আপনার নামটা বলবেন কি? ওপাশ থেকে: আমি কি আপনার নাম একবারও জানতে চেয়েছি? রাতুল: না কিন্তু আমার কিওরিসিটি একটু বেশিই। তাছারা অজানা ওচেনা একজনের সাথে কথা বলছি...ব্যাপারটা অস্বাভাবিক না? ওপাশ থেকে: আপনার সাথে কি আমি অস্বাভাবিক কোন আচরন করেছি? রাতুল: ঠিক তা নয়।

এই ধরুন আপনি যখন প্রথমবার কল করলেন আমি ভেবেছিলাম জ্বীনের বাদশাহদের কেউ। ওপাশ থেকে একটি হাশির শব্দ শুনতে পায় রাতুল। মায়াবী এক হাসি। যার বিশ্লেষন করা ব্যাকরনবিদদের পক্ষেও দুষ্কর। এটাকি অট্রহাসি নাকি মৃদু হাসি?না একটিও না।

এই হাসির নামটা কি দেয়া যায়?ভাবতে হবে। মেয়েটির সাথে কথা বলতে ভালোই লাগছিলো রাতুলের। হোক না সে নামহীনা। তার কথার মাঝে একটা নেশার জাল তৌরী হয়। সেই জালে কি জরিয়ে পরছে রাতুল?মেয়েটি আবার ঘোর ভাঙিয়ে দিলো রাতুলের।

ওপাশ থেকে: কি ঘুমিয়ে পরলেন নাকি?কিছু বলছেন না যে? রাতুল: না...ইয়ে আরকি...আপনার নামটা কিন্তু বললেন না? ওপাশ থেকে: এত অস্থিরতার কি আছে? সেটা না হয় আরেকদিন জানলেন। রাতুল: এর মানে আপনি আমাকে আবার ফোন করবেন? ওপাশ থেকে: আপনিকি ডিষ্টার্ব ফিল করবেন? রাতুল: না আসলে আমি সেটা বুঝাতে চাইনি। ওপাশ থেকে: তাহলে আজ থাক। শুভরাত্রি। রাতুল: হ্যালো,হ্যালো!!! ততক্ষনে কলটা কেটে গেছে।

ফোনের স্পিকারে টুট টুট আওয়াজ হচ্ছে। মোবাইলের ডিজিটাল ক্লকটার দিকে তাকিয়া দেখলো রাতুল। রাত ৪টা ১০। চোখের পাতায় ঘুম চলে এসেছে। নির্ঘুম রাত কাটানোর অভ্যাস নেই ওর।

কখন যে ঘুমিয়ে পরলো নিজেও জানে না। .........[চলবে]
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।