আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মননে ও মগজে দ্রোহের বারুদ জমাই

আত্মমাঝে বিশ্বকায়া, জাগাও তাকে ভালোবেসে

‘মেহেরজান’ চলচ্চিত্রটি নিয়ে বেশ বিতর্ক শুরু হয়েছে। দেখবো দেখবো করে ছবিটি দেখা হয়ে ওঠেনি। সাম্প্রতিক এই বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে পুরনো এই পোস্টটি আবারো দিলাম। তখনো আমাদের জন্ম হয়নি যখন মুক্তিযুদ্ধ হল। যেহেতু জন্ম হয়নি তাই প্রত্যক্ষ করার কোনও সুযোগ ছিল না আমাদের, কীভাবে অগণিত মানুষ ডানাখসা পাখিসম ঝড়ে পড়েছিল বাংলার শীতল মৃত্তিকায়, হায়! বাতিল কাগজের মতো ছিঁড়ে ফেলা সহজ খেয়ালের তোড়ে ভেসে গেছে কত-শত জননী ও নারীর সম্ভ্রম, হায়! দর্শনের অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়নি, এটা আপাত সত্য বয়ান মাত্র।

আমাদের পিতাগণ, জননীবৃন্দ, আগুনচোখা বীরযোদ্ধারা শুনিয়েছেন সেইসব রক্তঝরা দিনের গল্প, শকুনচঞ্চুতে কী করে জেগেছিল ভোর। আমাদের কালের কথক কবি-শিল্পী আর শব্দের কিংবা দৃশ্যের কারিগর, বাউল, ভাস্করগণ তাদের পয়ারে, ছন্দে, রঙে-রেখায়, সুরে, সেলুলয়েড আর ইট-কাঠে সেইসব কালের নিদারুণ কিন্তু অর্জনের গৌরবময় চিত্র এঁকেছেন অনিঃশেষ বিশ্বস্ততায়। আর এসব কারণে ইতিহাসের সেইসব দিনগুলো আর দূরাগত আভাসের চিহ্নমাত্র হয়ে থাকেনি আমাদের করোটিতে। কল্পনার প্রবল প্রতাপে মনের মঞ্চে একের পর এক দৃশ্যায়িত হয়েছে খণ্ড খণ্ড নাটকের আবহে। ফলে সেইসময় থেকে খুব বেশি বিছিন্নতা আর জেগে ওঠে না আমাদের মনে।

ইতিহাসের বয়ানে আমরা স্মরণ করতে পারি, আমাদের ভূখণ্ডটি পরাজিত পরে রোষানলে বিপর্যন্ত হয়েছে বারংবার। বিপর্যস্ততার এইসব চিত্র মনে ভেসে উঠলে কিছু কিছু প্রশ্নও খুব নিভৃতে উঁকি দিয়ে গেছে, আমরা বোকা, ওরা বুদ্ধিমান, নাকি আমরা সহনশীল ওরা অমানুষ, নাকি আমাদের অনুভূতির তন্ত্রীতে দেশভূখণ্ডের জন্যে তেমন কোনও অনুরাগ জেগে ওঠে না! আমাদের বিশ্বাসঘাতকতায় ভূপতিত হন আমাদের জনক। আমরা আমাদের দেশকে তুলে দেই ধর্মব্যবসায়ীদের হাতে, আমাদের বিশ্বাস আর মূল্যবোধকে টেনে নামাই মধ্যযুগে। আমরা প্রগতিশীলতার মুখোশে মুখ ঢেকে বিত্ত আর মসনদের মোহে আঁতাতে নামি কিংবা সমঝোতা করি অমানবিক শক্তির সাথে। আমাদের সোনার বাংলাকে অধঃপাতে নিয়ে যাওয়ার টানেল প্রত্য করিনি যদিও কিন্তু সেইসব ইতিহাস আমাদের মনের গহীনে।

এই সময়ে আমাদের একাংশ ও পরবর্তী প্রজন্মের ধারকগণ দূরাগত অতীত কিংবা ইতিহাসের বিষয়গুলো নিয়ে তেমন কোনও আবেগ বোধ করেন না। কর্পোরেট কিংবা অর্থ যোগানের বিষয়গুলোই এখন মুখ্য হয়ে উঠেছে তাদের চৈতন্যে। যতোটা তাদের মোহে তারচেয়ে ঢের বেশি তাদের অভিভাবকগণের আগ্রহে। আজ চোখের ওপর ঠুলি, ইতিহাস আর সংস্কৃতিবিচ্যুত তথাকথিত উন্নত শিক্ষার দোহাই দিয়ে উন্মূল এক ভবিষ্যতের দিকে ধাবমান আমাদের ও পরবর্তী প্রজন্মের প্রতিনিধিগণ। কিন্তু এমন তো কথা ছিল না।

আমরা ঢের স্পষ্ট স্মরণ করতে পারি, কিছুকাল আগেও, এই ধরি ১৩-১৪ কিংবা ১৫ বছর। আমরা যারা তখন স্কুলে পড়তাম, কিছু কিছু বিষয়ে আমাদের প্রতীক্ষা থাকতো বছর ধরে। আমরা আঙুলে গুণে না হোক ক্যালেন্ডারের পাতায় প্রায়শই চোখ বুলাতাম, দেখতাম কয়েকটি বিশেষায়িত তারিখ। আমাদের প্রতীক্ষা কাটতে চাইতো না। আমরা প্রতীক্ষা করতাম ১৬ ডিসেম্বরের জন্য, ২১ ফেব্রুয়া‍ররি জন্য, ২৬ মার্চের জন্য।

কেন করতাম? কেননা ঐ দিনগুলোতে আমরা পূর্ণ স্বাধীন হয়ে যেতাম। ঐ দিনগুলোতে আমাদের মাতা-পিতাগণ আমাদের ওপর থেকে নিষেধ তুলে দিতেন, আমাদের নিজেদের ইচ্ছেমতো কাটাতে দিতেন। আমরা বিভিন্ন শিশু-কিশোর সংগঠনের হয়ে ১৬ ডিসেম্বর আর ২৬ মার্চে মাঠে যেতাম, কুচকাওয়াজ আর ড্রিল করতাম। আমাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ছিল, কোন সংগঠন ভালো করে, কারা প্রথম হবে ইত্যাদি। আজও স্মৃতিগুলো ভীষণ তরতাজা, চিরকাল তাই থাকবে আশা রাখি।

২১ ফেব্রুয়া‍রতিে সারারাত জেগে শহীদ মিনার তৈরি করে তাতে প্রথম ফুল দিতাম নিজে। আর এরপরই ছুটে যেতাম শহরের মূল শহীদ মিনারে। দেয়ালিকা হতো, তাতে থাকতো দেশাত্ববোধের কাব্য, অপটু চিন্তা আর মননে, দুর্বল ভাষা বিন্যাসে সাজানো থাকতো কবিতা। অথচ হাসতো না কেউ, উৎসাহ যোগাতো সবাই। আর এসব কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে আমাদের ইতিহাসের যথাযথ পাঠ নেয়া হতো।

আমরা মুখোমুখি হতাম আমাদের গৌরবময় অতীতের। হ্যাঁ তখনো বিভাজন ছিল। কিন্তু সেই বিভাজন ছিল দলগত, রাজনৈতিক। এতে করে ইতিহাসের শিক্ষাটুকু ব্যহত হয়নি। কিছু ভুল-ভ্রান্তিজনিত কিংবা সচেতন প্রয়াসে চাপিয়ে দেয়া ইতিহাসও হয়তো আত্মস্থ হতো, কিন্তু সে তো সাময়িক।

পরবর্তী সময়ে নিজের সমতায় আমরা যে কেউই তো জেনে নিতে পেরেছি সঠিক ও গ্রহণযোহ্য ইতিহাস। আর সেটা সম্ভব হয়েছে, কেননা আমাদের ভেতর জাতীয় অর্জনের ইতিহাস জানার স্পৃহা তৈরি করে দিয়েছে সেইসব দিবস পালনের ঐতিহ্য। আমরা অর্থাৎ আমাদের প্রজন্মের যারা মফস্বলে কাটিয়েছি শৈশব-কৈশোর তাদের সবার মাঝেই এসব স্মৃতি ভীষণ তরতাজা। প্রায় একই গল্প সবার জীবনে। কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মের জীবনে এসব ঘটনা শুধুমাত্র গল্প হয়েই থাকবে।

তাদের জীবনে এ ধরনের অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়নি। আজ পরবর্তী প্রজন্ম জাতীয় দিবসগুলো ও তার তাৎপর্য জানে কী না এ ব্যাপারে ঘোর সন্দেহ জাগে। কিন্তু এর নেপথ্যের রহস্যটুকু কী? আমাদের জাতীয় জীবনে প্রায় সবকিছুকেই আমরা বিতর্কিত করে ফেলেছি। আসলে আমরা বিতর্কিত করিনি। আমাদের নির্বুদ্ধিতার সুযোগে এসব কিছুর বিরোধিতাকারীরা আমাদের মধ্যে বিভাজনের করাত চালিয়েছে সংগোপনে।

আমরা তাদের পাতা ফাঁদে পা দিয়েছি মাত্র। আমাদের জাতীয় অর্জনগুলোকে, ইতিহাসের গৌরবময় অধ্যায় গুলোকে বিতর্কিত করে তুল্লেই তো আমাদের মধ্যে চলে আসবে দ্বিধা, বিভক্তি। আমরা হয়ে যাবো দুর্বল। আর তখনই সম্ভব হবে তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন, তাদের মতাদর্শের প্রতিষ্ঠা। তারা এই সুন্দর দেশটিকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যেতে পারবে অন্ধকারে।

আমরা কী বুঝে উঠতে পারছি না, আমাদের গৌরবময় ইতিহাসের বিরোধিতাকারীরা সংঘবদ্ধ, এক, অভেদ। অথচ আমরা ইতিহাস প্রশ্নে দ্বিধান্বিত, খণ্ডিত, টুকরো টুকরো। জাতীয় অর্জনগুলো নিয়ে কথা বলতে, লিখতে যতসব অনীহা এসে ভর করে মন ও মননে। আমাদের ভেতর এই কনসেপ্ট ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে, ঢের হয়েছে ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ, রাজাকার ইত্যাদি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা আর প্রয়োজন নেই। আমাদের কী মনে হয় না, এইসব কথাগুলো সেই পরাজিত শক্তির সুচতুর কৌশলের অংশমাত্র।

এইসব আলোচনা, এইসব কথা থেমে গেলে সহজেই তারা মিশে যেতে পারে আপামর জনগণের সাথে। সহজেই তখন ঢেকে দেয়া যাবে নিজেদের অতীত-বর্তমানের কীর্তি (!) সব। আর তখনই সম্ভব হবে চূড়ান্ত আক্রমণ চালানো, আমাদের সোনার বাংলাকে মিনি পাকিস্তান বানানো। আমরা কী প্রত্যক্ষ করিনি, এই দেশে খোদ রাজধানীতে মুক্তিযোদ্ধার লাথি হজম করার দৃশ্য! প্রত্যক্ষ করিনি নির্বিরোধী বাউল ভাস্কর্যকে টেনে হিঁচড়ে নামানোর চিত্র! প্রাণ পেলে যে শ্বেত বলাকাগুলো লজ্জায়-ঘৃণায় উড়ে যেত অনন্ত আকাশের পথ ধরে তাদের পা ভাঙার খবরও তো মেনে নিয়েছি অসীম নৈঃশব্দে প্রায়। অথচ এর যেকোনও একটি ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় দেশ হয়ে ওঠার কথা ছিল উত্তাল, প্রতিবাদ, প্রতিরোধে ঐসব ভণ্ড-প্রতারক আর আমাদের শিল্প-সংস্কৃতি-স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী মানুষগুলো পালাবার পথ খুঁজে পাওয়ার কথা ছিল না! হায়! তবুও নাকি মুক্তিযুদ্ধ আর আমাদের গৌরবময় দিনগুলোকে নিয়ে আলোচনা বেশি হয়ে গেছে, এগুলো নাকি আজ আর খুব বেশি প্রয়োজনীয় নয়, সেকেলে, কেউ এসব নিয়ে লিখতে বা বলতে তেমন আগ্রহ বোধ করেন না! হায়! আক্ষেপের কথা পাশে রাখি।

একটু আশার কথা বলি। ডিসেম্বর আমাদের বিজয়ের মাস, অর্জনের মাস। বাঙালি জাতির সবচেয়ে গৌরবের মাস। ১৬ ডিসেম্বর সবচেয়ে গৌরবময় দিন, সবচেয়ে আনন্দের দিন। এই দিনেই তো বাঙালি জাতি অর্জন করেছে তার নিজস্ব একটুকরো ভূমি।

ভাষার প্রশ্নে সূচিত ৫২'র যে আন্দোলন ২১ শে ফেব্রুয়ারির ত্যাগের মধ্যদিয়ে এই জাতি অর্জন করেছিল, ইতিহাসের গৌরবময় অগ্রযাত্রায় ৭১'র ২৬ মার্চ বীর বাঙালি মুক্তির চূড়ান্ত লক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়ে যুদ্ধে। ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় বিজয়। আমাদের এই ক্লিশেকালে আসুন সবাই বেশি বেশি করে প্রতিদিন মুক্তিযুদ্ধের কথা বলি, আমাদের অর্জনের দিকে তাকাই। নিজের মধ্যে সেই অতীত সূর্যের দিন টেনে আনি, ইতিহাসের গৌরব আর অনাগত ভিন্নতর যুদ্ধের কথা ভাবি, মননে ও মগজে দ্রোহের বারুদ জমাই।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.