প্রগতিবাদী বুদ্ধিজীবী প্রয়াত ড. আহমদ শরীফের একটি ভাষণ আমার প্রায়ই মনে পড়ে। তিনি বলতেন, আমি শঙ্কিত নই। যা বিশ্বাস করি তাই বলি। আমার কথা এবং কর্মে কোন অমিল নেই। শঙ্কা মানুষের হৃদয়ের প্রকৃত শক্তিকে হরণ করে।
আর যার হৃদয়ে সৎ শক্তি থাকে না সে তো মানুষ নয়। ড. আহমদ শরীফ আড়াই দশক আগে যে কথাটি বলে গেছেন, সেই শঙ্কা নিয়েই ঘুরপাক খাচ্ছে আজকের বাংলাদেশ, বাঙালি জাতি। কারণ এই রাষ্ট্রটিকে এমন এক অবস্থায় পতিত করা হয়েছে, সবকিছু নিয়েই আজ সন্দেহ। সবকিছু নিয়েই আজ শঙ্কার রাজনীতি। সবাই, অর্থাৎ যারা রাষ্ট্রের শাসক-কর্ণধার, তারা নিজেরাই বুঝে উঠতে পারছেন না জনগণ তাদের কতটা বিশ্বাস করে কিংবা চায়।
আর চাওয়া না চাওয়ায় তাদের কিই-বা আসে যায়। তারা চেপে বসেছেন। তাদের টলাতে পারে এমন সাধ্য কার আছে!
চলমান, মননশীল এবং আধুনিক প্রগতির ধারাকে কারা বারবার বাংলাদেশ স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছে তা কারও অজানা থাকার কথা নয়। কিন্তু আশ্চর্যের কথা হচ্ছে, এসব মৌলবাদীরা খুব কৌশলে রাষ্ট্র ক্ষমতা স্পর্শ করতে পেরেছে। যারা গ্রামে-গঞ্জে ফতোয়া দিয়ে গ্রামীণ জনপদের উন্নয়নকে ব্যাহত করে দিতে চেয়েছে তারাই নিজেদের প্রয়োজনে বুলি পাল্টিয়েছে বারবার।
এরা তো সেই হীন মৌলবাদী যারা এক সময় গ্রামের মাঠে ট্রাক্টর দিয়ে চাষাবাদকে ‘নাজায়েজ’ বলে আখ্যায়িত করেছিল। তারা বলেছিল ট্রাক্টর নাকি রাষ্ট্রীয় সুদের টাকায় কেনা হয়। তাই ট্রাক্টরে চাষ করা ধানগুলো হারাম। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে ওইসব পাষণ্ডদের এসব ফতোয়ার কথা আমাদের এখনো মনে আছে। সেই ফতোয়াবাজরাই, সেই আলবদর ঘাতকরাই জাতীয় পতাকা গাড়িতে লাগিয়ে ‘উজির’ হয়েছে বাংলাদেশের মাটিতে।
অথচ তাদের হাত থেকে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পবিত্র রক্তের দাগ শুকায়নি। এই মন:পীড়া নিয়েই যাপিত হচ্ছে বাঙালির জীবন। শোকে মুহ্যমান হচ্ছেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা।
বাংলাদেশের আজ এমন অবস্খা কেন? কেন একটি জাতির ভবিষ্যৎ এতো বেশি শঙ্কাপুর্ণ? আমার কখনো কখনো মনে হয় পরপারে থেকে, নরকের ওপার হতে খুনি আইউব-ইয়াহিয়ারাও বোধ হয় বাংলাদেশের আজকের অবস্খা দেখে হেসে উঠে মাঝে মাঝে। তাদের হাসার প্রধান কারণ হচ্ছে তারা এই বাংলাদেশে তাদের যোগ্য (!) উত্তরাধিকারীদের রেখে যেতে পেরেছে।
যারা আজ বাংলাদেশের জনগণের আশা-আকাপক্ষাকে পদদলিত করে একটি বর্বরতম জঙ্গিবাদের ধারা-উপধারাকে বাঙালির ওপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছে তারা আইউব ইয়াহিয়ার চেয়েও জঘন্য নয় কি? বাঙালি জাতিকে এই বিষয়টি খুব গভীরভাবে অনুধাবন করার সময় বয়ে যাচ্ছে।
দুই.
যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসে ‘এন্টি টেরোরিজম’ কোর্সটি যুক্ত হওয়ার পরপরই উল্লেখযোগ্য হারে বাড়তে থাকে এর ছাত্রছাত্রী সংখ্যা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকেও এ কোর্সে ভর্তি হওয়ার জন্য ট্রান্সফার নিয়ে প্রচুর ছাত্রছাত্রী আসছে যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করার জন্য। বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশিক্ষক-অধ্যাপক হিসেবে যারা দায়িত্ব নিয়েছেন এরা সবাই সামরিক, গোয়েন্দা, স্পেশাল সার্ভিস কিংবা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস আইনে দক্ষ ব্যক্তিত্ব। কেউ কেউ বিভিন্ন সংস্খার সাবেক কর্মকর্তা।
২০০১ সালের আগেও এ কোর্সটির খুব একটা কদর ছিল না যুক্তরাষ্ট্রে। সেপ্টেম্বর ইলেভেনের পর এর কদর বেড়ে গেছে বহু গুণ। অপরাধের ধরন বাড়ছে। পরিসর বাড়ছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সন্ত্রাস দমনের উপায় নিয়েও বিশ্বের রাজনীতিক, সমাজবিজ্ঞানী, সংস্খা ও সংগঠনগুলো উদ্বিগ্ন।
এন্টি টেরোরিজম কোর্সের তিন-চার বছর মেয়াদি প্রশিক্ষণ যুক্তরাষ্ট্রের প্রজন্মের ক্যারিয়ারেও যুক্ত করেছে নতুন মাত্রা। একটা চ্যালেঞ্জিং পেশা হিসেবেই অনেকে নিতে চাচ্ছে এটাকে।
একটি বিষয় খুবই স্পষ্ট, বিশ্ব এগুচ্ছে সমসাময়িক ঘটনাবলি এবং সমস্যা সম্ভাবনার সঙ্গে তাল মিলিয়ে। এ প্রজন্মকেও তাই গড়ে তোলার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে সমসাময়িক অবস্খার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে। এ প্রসঙ্গে কথা হচ্ছিল সিটি ইউনিভার্সিটি অফ নিউইয়র্কের অধ্যাপক রাশেল রোলিনের সঙ্গে।
তিনি এখানে ‘এন্টি টেরোরিজম’ পড়ান। অধ্যাপক রোলিন বলেন, একটি কথা আমাদের মনে রাখতে হবে আজ থেকে বিশ বছর আগে কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তির এমন মুক্ত এবং অবাধ প্রবাহ ছিল না। ইন্টারনেট এখন গোটা বিশ্বকে নিয়ে এসেছে হাতের মুঠোয়। এর সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে সাইবার ক্রাইমও। তাই বাধ্য হয়ে নতুন আঙ্গিকের সেই ক্রাইমকেও রোধ করতে ব্যবস্খা নিতে হচ্ছে সরকারকে।
প্রণীত হচ্ছে বিশ্বব্যাপী নতুন নতুন আইন।
আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস দমনের বেলায়ও প্রফেসর রোলিনের একই কথা। তিনি বললেন, খুব শিগগিরই হয়তো এমন সময় আসবে যে এই এন্টি টেরোরিজম সিলেবাসটি গোটা বিশ্বে একটা অন্যতম প্রধান বিষয় হিসেবে সমাদৃত হবে। যারা উচ্চপদস্খ হবেন তারা সবাই এসব বিষয়ে প্রচুর পড়াশোনা করে দীক্ষিত করে তুলবেন নিজেদের। তার কথার সঙ্গে একমত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।
যদি বাংলাদেশের অতীত শিক্ষা সিলেবাসের প্রতি নজর দেই তবে দেখা যাবে, একসময় ছিল যখন একজন পিতা তার সন্তানকে বিএ, এমএ অথবা এমনি সমপর্যায়ের এডুকেটেড করে গড়ে তুলতেই আগ্রহী ছিলেন। সময়ের আবর্তে এখন তা অধিক ক্ষেত্রেই বদলেছে। নতুন নতুন সিলেবাসের প্রতি, বিষয় ও পেশার প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বেড়েছে। বিশ্ব পরিমণ্ডলের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ফার্মেসি, ফাইন আর্টস, বিজনেস ম্যানেজমেন্ট, মাইক্রোবায়োলজি, এস্ট্রনমি (মহাকাশ বিজ্ঞান) প্রভৃতি চমকপ্রদ বিষয় শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বেছে নিচ্ছে অনেক শিক্ষার্থী। পরিবর্তন কিংবা দিনবদলের এই যে অগ্রযাত্রা তা আমাদের আশার আলো দেখায় অবশ্যই।
আমি বলছি না বাংলাদেশকে রাতারাতি বদলে দেয়া যাবে। তবে শুরুটা তো করতে হবে। স্যাটালাইট টিভির পর্দায় মুঠোফোনের বিপনন প্রাচারণা
দখল করছে আমাদের প্রজন্মের মগজ। এর সাথে পাল্লা দিয়ে দেশ এগুচ্ছে
না আশানুরূপ ভাবে। মাটির মননে চৈতন্যের এই বীজ টি বপনে আর কতো
নেতৃত্বের অপেক্ষা করতে হবে কে জানে !
ছবি - হিরন্ময় চন্দ
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।