আমি কলাম লিখি। প্রায় পঁচিশ বছর যাবৎ লিখি এই কলাম।
লেখালেখির তিরিশ বছরেরও বেশী সময়ে এই কলাম আমাকে দিয়েছে
অনেককিছু।
দৈনিক কালের কন্ঠ - তে একটা কলাম শুরু করেছি । আজই প্রথম লেখাটা
ছাপা হয়েছে উপসম্পাদকীয়তে।
বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক এই কলামের নাম - প্রবাহের প্রান্তমেরু ।
-----------------------------------------------------------------------
প্রবাহের প্রান্তমেরু
যে স্বপ্ন অভিবাসী বাঙালি প্রজন্মের মননে
ফকির ইলিয়াস
=========================================
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিরোধী দলের কাজ কী তা কারোরই অজানা নয়। এর আগে যে প্রশ্নটি আসে, তা হচ্ছে কার রাজনীতি? কিসের রাজনীতি? রাজনীতি যদি গণমানুষের জন্য হয়, তবে তাতে সাধারণ মানুষের স্বার্থ রক্ষা হবে না কেন? দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সহনশীলতার রাজনীতির স্বরূপ কী, তার সংজ্ঞা বিভিন্নভাবে নিরূপণ করা যায়। তবে শেষ কথা হচ্ছে, জনগণের মতামতকে সম্মান করলে তাদের রাজনৈতিক ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রতিফলনকেও সম্মান জানাতে হয়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি ভারত সফর করে এসেছেন।
তাঁর এই সফরের আগে ও পরে সংবাদ সম্মেলন করেছেন বিএনপির শীর্ষ নেতারা। তাঁরা বিভিন্ন ইচ্ছা-আশা ব্যক্ত করেছিলেন। সফরের পরে তাঁরা স্পষ্টই বলছেন, এ সফরে বাংলাদেশের কোনো স্বার্থ রক্ষা হয়নি। বুলিটা সেই পুরনো। সব স্বার্থ নাকি ভারতেরই হয়েছে।
শতভাগ ব্যর্থ হয়েছে বলছে বিএনপি।
এবার দেখা যাক, প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী বাণিজ্যদলের প্রতিনিধিরা কী বলছেন। তাঁদের ভাষ্যমতে, সফর বহুলাংশেই সফল হয়েছে। চুক্তি এবং সমঝোতাগুলো কার্যকর হলেই সফরের প্রকৃত ফল পাবে দুই দেশের মানুষ। কথা হচ্ছে, বন্দিবিনিময় চুক্তি, বাণিজ্য, পানিবণ্টন, সীমান্ত সমস্যা নিয়ে যেসব চুক্তি হয়েছে তাতে কি বাংলাদেশ মোটেই লাভবান হবে না? অবশ্যই হবে।
মনে রাখা দরকার, দুই পক্ষের স্বার্থ রক্ষা না হলে কোনো বেকুবও চুক্তি স্বাক্ষর করে না_করবে না। অথচ বাংলাদেশ একটি দেশ। একটি সার্বভৌম জাতিসত্তা। একটি স্বাধীন ভূখণ্ড। এ দেশের মানুষ ও সরকারপক্ষ তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় কোনো অংশেই কম বোঝে না।
তাহলে জামায়াত-বিএনপি জোট এভাবে মিথ্যার ফুলঝুরি ছড়াচ্ছে কেন? কেন তারা ইস্যু তৈরি করে আন্দোলনে নামার হুমকি দিচ্ছে? তাদের নেপথ্য উদ্দেশ্য অন্যখানে। তারা চাইছে সব উন্নয়নের ধারাকে স্থবির করে দিতে, রাষ্ট্র যাতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে না পারে_সেই পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখতে। এ ছাড়া জাতির জনকের হত্যাকারীদের রায় কার্যকরে এবং পিলখানা হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচারে বিঘ্ন ঘটানো, মৌলবাদী জঙ্গিচক্রকে উসকানি দেওয়া প্রভৃতি ইস্যু সৃষ্টি করার চেষ্টা তো রয়েছেই।
মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী সম্প্রতি বলেছেন, দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করলে নাকি গোপন জঙ্গি সংগঠনের সংখ্যা বেড়ে যাবে। তাঁর এ বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে মাওলানা নিজামীকে একটি প্রশ্ন করতে চাই।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে কি ধর্মর্ভিত্তিক কোনো রাজনৈতিক দল রয়েছে? সেসব দেশে কি ধর্মের নামে রাজনীতি করা যায়? না, যায় না। বরং সেসব দেশে চলছে রাজতন্ত্রের নামে পারিবারিক স্বৈরতন্ত্র। ওসব দেশের বাদশাহ-আমির-খলিফারা বাংলাদেশে ধর্ম প্রচারের নামে এমন কট্টরবাদিতাকে পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছেন কেন? উদ্দেশ্যটি হচ্ছে, নিজস্ব 'কলোনিয়াল টেরিটরি' তৈরি। বাংলাদেশের মানুষ তা ক্রমেই অনুধাবন করছে।
এরপর আসি বাংলাদেশে জঙ্গিবাদী সন্ত্রাসীদের যাত্রা শুরু প্রসঙ্গে।
পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর সামরিক শাসকদের ছত্রছায়ায় ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়িয়ে যারা মাঠে নামে, মূলত তারা ছিল একাত্তরের পরাজিত শক্তি। ক্রমেই এরা তাদের শেকড় বিস্তৃত করতে থাকে। একদিকে ধর্মের নামে রাজনীতি, অন্যদিকে সশস্ত্র জঙ্গিবাদের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল_এ দুটি ধারা ছিল তাদের দুটি অভিন্ন প্রশাখা। যার ফলে গেল জোট সরকারের সময় একাত্তরের ঘাতক নেতাদ্বয় মুজাহিদ-নিজামী ক্ষমতায় আসার পর 'শায়খ রহমান', 'বাংলাভাই'-এর মতো জঙ্গিরা প্রকাশ্যে মাঠে নামার সুযোগ পায়। এবং জোট সরকার প্রকাশ্যে বলতে থাকে 'বাংলাদেশে কোনো জঙ্গি নেই', 'বাংলাভাই মিডিয়ার সৃষ্টি' ইত্যাদি কথাবার্তা।
দেশ গঠনে সহনশীল রাজনীতির ঐক্যের কথা অনেকেই বলেন। তা কিভাবে হতে পারে? কারা হতে পারেন এর কাণ্ডারি? এ বিষয়ে সাম্প্রতিক একটি ঘটনার উল্লেখ করা দরকার। চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে বাংলাদেশ সফরে আসেন পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক জান্তা পারভেজ মোশাররফ। সে সময় পারভেজ মোশাররফ ও অনুপ চেটিয়ার মধ্যে নাকি ঢাকা শেরাটনে একটি বৈঠক হয়েছিল। এমন একটি কথা অতিসম্প্রতি বলেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, এলজিআরডিমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম।
এর পাল্টা জবাব দিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার। বিএনপি মহাসচিব বলেছেন, এমন প্রমাণ কেউ দিতে পারবে না। এরপর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, এই দেড় ঘণ্টা বৈঠকের প্রমাণ তাঁদের কাছে আছে। যদি অভিযোগ সত্য হয় তবে অবশ্যই তা খুব গুরুতর এবং এর প্রতিকার জরুরি।
বাংলাদেশে জাতীয় ঐক্যের রাজনীতির কথা এলেই সামনে চলে আসে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।
দেশের ডানপন্থী একটি পক্ষ তরুণ প্রজন্মকে নানাভাবে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। তারা প্রয়োজনে 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলে কিছু নেই'_এমন তত্ত্বও শোনাচ্ছে যত্রতত্র। যারা একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যার নায়ক ছিল, যারা একাত্তরে এ দেশের মা-বোনদের সম্ভ্রম লুণ্ঠন করেছিল, আজ তাদেরই মুক্তিত্রাতা হিসেবে সাজানোর আলোচনা চলছে! জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস দমনে বাংলাদেশ-ভারত একযোগে কাজ করবে_এ ঘোষণা অনেকের গাত্রদাহের কারণ হতেই পারে। শীর্ষ সন্ত্রাসী বিনিময় চুক্তি কারো কারো তীব্র ক্ষোভের কারণ হতে পারে। কারণ শীর্ষ বন্দী সন্ত্রাসী এবং তাদের গ্রুপকে কাজে লাগিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে অশান্ত করার দীর্ঘতর চেষ্টা কাদের, তা বিভিন্ন ঘটনায় ইতিমধ্যেই বেরিয়ে পড়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সহনশীলতার রাজনীতি প্রতিষ্ঠা বাংলাদেশে খুব সহজ কাজ নয়। অথচ জাতীয় উন্নয়নে সেটাই প্রধান রক্ষাকবচ। যাঁরা মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, তাঁদের এখনো মনে আছে কী চেতনা বুকে নিয়ে তাঁরা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। সেই শানিত শক্তির আজ খুব বেশি প্রয়োজন। মহাজোট সরকার নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সেটাই প্রমাণ করেছে, এ প্রজন্ম ৩০ লাখ শহীদকে ভুলে যায়নি।
এ প্রজন্ম বাঙালি জাতিসত্তাকে বলীয়ান করেই বিশ্বে দাঁড়াতে চায়। একই স্বপ্ন অভিবাসী বাঙালি প্রজন্মের মননেও। এ সুযোগের দরজা অবারিত করে দিতে হবে। কারা এর প্রতিপক্ষ, তাদেরও চিহ্নিত করতে হবে। কারণ সত্যের প্রতিপক্ষ যে মিথ্যা, তা তো সবারই জানা।
--------------------------------------------------------------------
দৈনিক কালের কন্ঠ । ঢাকা। ২৬ জানুয়ারী ২০১০ মংগলবার প্রকাশিত
ছবি - জেমি প্যাকার্ড
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।