প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের জনপ্রিয়তার সমীকরণ
ফকির ইলিয়াস
====================================
বাংলাদেশে প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির জনপ্রিয়তার মাপকাঠি কী? এ প্রশ্নের উত্তর বিভিন্নভাবে দেয়া যেতে পারে। একটি দলের জনপ্রিয়তা কমলে যে অন্য দলটির জনপ্রিয়তা বাড়ে তেমনটিও নয়। বরং দেখা যায়, একটি দলের প্রতি মানুষ যখন মুখ ফিরিয়ে নেয় তখন সে দলটিকে তারা ভর্ৎসনা করে। এ ভর্ৎসনার কারণ হচ্ছে, যারা ক্ষমতায় থাকে তাদের সহযোগীদের চরম দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, সন্ত্রাস রোধে ব্যর্থতা। তখন বিরোধীদলে থাকা দলটির প্রতি মানুষ ছুটে যেতে চায়।
ঘৃণা প্রকাশ করে ক্ষমতাসীনদের প্রতি।
বাংলাদেশের মহান মুক্তি সংগ্রামের প্রধানতম লক্ষ্য ছিল, গণমানুষের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করা। সন্দেহ নেই একাত্তরের বাংলাদেশে জনসংখ্যা এখন প্রায় দ্বিগুণেরও বেশি। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, এ মানুষজনকে স্বপ্ন দেখানোর যে অবকাঠামো নির্মাণের কথা ছিল, সেটিই নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। কেন হয়নি? এর অন্যতম কারণ গণতান্ত্রিক সুশাসনের অভাব।
সামরিক জান্তাদের পদছায়ায় ভারী করে তোলে মুক্তিকামী মানুষের মাটি। এ সুযোগে যারা এ দেশ ও জাতির স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল তারা পেয়ে যায় পৃষ্ঠপোষকতা। হয়ে ওঠে সক্রিয়।
জনপ্রিয়তা থেকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নাম-নিশানা মুছে দেয়ার জন্য যারা খুব বেশি সক্রিয় ছিল, বাংলাদেশের রাজনীতিতে তারা ছিল মূলত পরগাছা। ১৫ আগস্টের বর্বরতম হত্যাযজ্ঞের পর তারা নানাভাবে মিথ্যার আশ্রয় নেয়।
অাঁতাত করে ঘাতক-রাজাকারদের সঙ্গে। যাদের নেতৃত্বে এ দেশ স্বাধীনতা পেয়েছিল তাদের ঋণ অস্বীকার করে একটি পরাজিত চক্র রাতারাতি সেজে যায় 'দেশ দরদি'। ক্ষমতায় টিকে থাকার মোহে অন্ধ হয়ে হরেদরে রাজনীতিবিদদের দ্বারা সামরিক ছত্রছায়ায় গঠিত হয় 'জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল' (জাগদল), এরই পরিবর্তিত রূপ লাভ করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল। যার নাম 'বাজাদল' হওয়ার কথা থাকলেও শুনতে খারাপ দেখানোর কারণে ইংরেজিতে 'বিএনপি' নামটিই ধারণ করার প্রয়াসী হন অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান।
শুরু থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপির জনপ্রিয়তা কেমন এবং কিভাবে, তার একটি পর্যালোচনা করা দরকার।
বাংলাদেশে এন্টি আওয়ামী লীগ সেন্টিমেন্টের সঙ্গে যে তবকটি প্রধানত কাজে লাগানো হয়, তা হচ্ছে_ এন্টি ইন্ডিয়া সেন্টিমেন্ট। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু হত্যার পরই যে চরম মিথ্যাচার তার বিরুদ্ধে করা হয়, তা হচ্ছে তিনি বাংলাদেশকে ভারতের কাছে ইজারা দিয়েছেন। 'গোলামি চুক্তি', 'সেবাদাস চুক্তি' প্রভৃতি সেস্নাগানের প্রবক্তারা ছিল সেসব রাজাকারই, যারা একাত্তরের নিজ পরিচয় ভুলতে পারেনি। অথচ শেখ মুজিবের হুকুমেই ভারতীয় সেনাবাহিনী খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে ১৯৭২ সালের প্রথম দিকেই বাংলাদেশের মাটি থেকে তাদের স্থাপনা সরিয়ে নিয়েছিল।
এন্টি ভারতীয় সেন্টিমেন্টের দোহাই দিয়ে স্বৈরশাসক জিয়া যতটা ভূমিকা রেখেছিলেন তার চেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছিলেন পরবর্তীতে জিয়া পত্নী খালেদা জিয়া।
খুবই পরিতাপের কথা হচ্ছে, তিনি মৌলবাদী শক্তিকে রাষ্ট্রের অন্যতম নিয়ামক বানাতে তৎপর ছিলেন। যার ফলে তার শাসনামলে জঙ্গিবাদী শক্তিরা আসকারা পেয়ে রাষ্ট্রের শীর্ষ চূড়ায় স্থান পাওয়ার স্বপ্নে বিভোর ছিল। একাত্তরের নরহত্যায় সম্পৃক্ত রাজাকার-আলবদর কমান্ডারদের মন্ত্রিত্ব দিয়ে একাত্তরের জঙ্গিবাদী শক্তিকে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠা করতে ব্রত ছিলেন খালেদা জিয়া। অন্যদিকে তার পুত্রদ্বয় 'হাওয়া ভবন' তৈরি করে নির্মাণ করেছিল সরকারের ভিতরে ছায়া সরকারের চরম ত্রাসের রাজত্ব।
জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে আওয়ামী লীগ একাত্তরে যে ভূমিকা রেখেছিল তা ছিল অবিস্মরণীয়।
চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে '৭২-৭৫ সময়ে আওয়ামী লীগকে তটস্থ রাখতে ব্যস্ত ছিল দেশি-বিদেশি শক্তি। যে এন্টি ইন্ডিয়ার দোহাই দিয়ে মার্কিন-সৌদি লবি '৭২-৭৫ সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজনীতির চরম বিরোধিতা করেছিল, দেখা গেল ক্রমেই সে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সৌদি আরবই হয়ে উঠেছিল ভারতের প্রধান বন্ধু। নির্মাণ কাজের জন্য '৭২-পরবর্তীতে ভারত থেকে সৌদি আরবে হাজার হাজার নির্মাণ শ্রমিককে চাকরি প্রদান, বাণিজ্য নীতির সম্প্রসারণ তাই প্রমাণ করেছিল। একইভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও দক্ষ শ্রমিক আমদানি, ব্যবসা-বাণিজ্যে ক্রমেই প্রসার ঘটাতে থাকে ভারতের সঙ্গে। আর এখন তো ভারত মার্কিনিদের প্রধান বাণিজ্য লক্ষ্য।
পঁচাত্তরের নৃশংস হত্যাকা-ের পরপরই নবরূপে মার্কিন-সৌদি আধিপত্যবাদ নতুনভাবে সম্পর্ক স্থাপন করতে উদ্যোগী হয় বাংলাদেশের সঙ্গে। সামরিক শাসক জিয়া এটিকে নিজের কৃতিত্ব বলে দাবি করতে থাকেন। ভারত বিরোধিতার এই যে তথাকথিত জাতীয়তাবাদী হিড়িক, তা ক্রমেই ধরা পড়তে থাকে নতুন প্রজন্মের চোখে। হালে পাল্টাতে থাকে দৃশ্যপট। স্বীকার করতেই হবে, দেখা গেছে বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তায় ধস নেমেছে।
১৯৯৬-এর নির্বাচনে জিতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে অতিরিক্ত মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছিল। তারা রাষ্ট্রপতি পদে বসিয়েছিল বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদকে। দলীয় রাষ্ট্রপতি না থাকলে যে বিভিন্ন ইস্যুতে হোঁচট খেতে হয় তা প্রায় ভুলে গিয়েছিলেন ১৯৯৬-২০০০-এর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার ফলশ্রুতিতে ভেঙে পড়েছিল শেখ হাসিনার হাতের চেইন অফ কমান্ড। ১৯৯৬-২০০০ সালের মন্ত্রীদের কারও কারও দাপট, দুর্নীতি, অকর্মণ্যতা, সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি অতিষ্ঠ করে তুলেছিল মানুষকে।
২০০১-এর নির্বাচনে বিএনপির বিজয় এবং আওয়ামী লীগের ভরাডুবি ছিল সেসব অপশাসনেরই ফসল।
এ পরাজয় থেকে আওয়ামী লীগ কিছুটা হলেও শিক্ষা নিতে পেরেছিল। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম বলেছিলেন, বাংলার মানুষ চাইলেই এ মাটিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে পারবে। ২০০৮-এর নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোতে এ ইস্যুটি যুক্ত করতে বাধ্য হয়েছিল আওয়ামী লীগ, নতুন প্রজন্মের ভোট পাওয়ার জন্যই।
যে প্রশ্নটি বারবার এ সময়ে আসছে তা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ তথা মহাজোটের জনপ্রিয়তায় কি ক্রমে ধস নামছে? পৌর মেয়র নির্বাচন তো তেমনটিই সাক্ষ্য দিল।
কেন এমনটি হচ্ছে? এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণে কঠোর হতে পারছে না। যদি পারত তাতে শেয়ারবাজারটি এমন একটি বেনিয়া-লুটেরা শ্রেণী দখল করে নিতে পারত না। সরকার যদি মনে করে একটি দুষ্টচক্র সরকারকে কাবু করার জন্য এমনটি করছে, তাহলে এসব রাঘব জুয়াড়িদের টুঁটি চেপে ধরছে না কেন?
মনে রাখতে হবে, এখনো জামায়াত-বিএনপি জোটের হাতে প্রধান হাতিয়ারটি হচ্ছে 'এন্টি ইন্ডিয়া' ইস্যু। ফেলানী নামের এক কিশোরী বিএসএফের গুলিতে নির্মমভাবে নিহত হয়েছে। তার লাশ সীমান্তের কাঁটাতারে ঝুলেছিল।
এটি অত্যন্ত অমানবিক, নীতি গর্হিত কাজ। যা কোনমতেই মেনে নেয়ার নয়। কিন্তু জামায়াত-বিএনপি জোট এটিকে নিয়ে মতলবি রাজনীতি করার অপপ্রয়াস চালাচ্ছে। কেন বিএনপির শাসনামলে বিএসএফের হাতে বাংলাদেশি নাগরিক নিহত হয়নি? হয়েছে। তখন পতাকা বৈঠক ছাড়া আর কি তারা করতে পেরেছিল?
শত শত ফেলানী জীবিকার তাড়নায় প্রতিদিন কেন ভারতমুখী হচ্ছে, সে বিষয়টি গোটা দেশের মানুষের ভাবা দরকার।
যে কোন রাষ্ট্রেই চরম দারিদ্র্যকে বিতাড়ন করতে না পারলে সীমান্ত অতিক্রম বন্ধ করা সম্ভব নয়। আর তাই এমন গোলাগুলি, নৃশংস হত্যাকা- চলতেই থাকবে। রাজনৈতিক জনপ্রিয়তা পেতে চাইলে মাটিবর্তী রাজনীতির বীজ বুনতে হবে। কেতাবি সবক গণমানুষের কোন কাজে আসেনি, আসবেও না।
নিউইয়র্ক , ২৪ জানুয়ারি ২০১১
-----------------------------------------------------------------------
দৈনিক সংবাদ / ঢাকা/ ২৮ জানুয়ারি ২০১১ শুক্রবার প্রকাশিত
ছবি- স্টিভেন মন্টগর্নি
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।