আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ক্যান্সারের সঙ্গে বসবাস

এই ব্লগের কোন লেখা আমার অনুমতি ব্যতীত কোথাও ব্যবহার না করার অনুরোধ করছি

ছয় বছর খুব অল্প সময় নয়, লম্বা সময়, বেশ লম্বা সময়। একজন মানুষকে জানার জন্য ছয় বছর যথেষ্টর চেয়েও বেশি। তোমাকে জানতাম, সম্পূর্ণ জানতাম, যতটা জানা একজন মানুষকে সম্ভব ততটার চেয়েও বেশি জানতাম। ছয় বছর ধরে জেনেছিলাম তোমাকে আমি। দীর্ঘ ছয় বছর ধরে প্রতিটি রাত্রিতে আমি তোমাকে একটু একটু করে জেনেছিলাম- কখনও মনে হয়নি তুমি পুরোনো হয়ে গেছ।

তোমার অধর আগের মতোই ছিল, তোমার সুধা বদলায়নি একবিন্দুও, তোমার সুকুমার বৃত্তিগুলোও কখনও বদলায়নি, বদলায়নি তোমার উচ্ছল হাসি, দূর থেকে ভেসে আসা জীয়ন জলের মতো তোমার কন্ঠ বা তোমার অভিমান। দীর্ঘ ছয় বছরে এক বারের জন্যও কখনো মনে হয়নি তুমি বদলে যেতে পার কোনদিন। অথচ তুমি বদলাচ্ছিলে খুব দ্রুত, তোমার শরীরে ছড়িয়ে পড়ছিল সে বদলের হাওয়া, এত দ্রুত খুব সামান্য জিনিসই বদলাতে পারে। ঘুণাক্ষরেও কখনো ভাবিনি তুমি এত দ্রুত বদলে যাবে, বদলে যাওয়ার এই নিরুদ্দেশ যাত্রায় তোমার সহযাত্রী কেউ হবে না। ছয় বছর ধরে চমৎকার কাটছিল আমাদের দিনরাত্রিগুলো- আমরা সুখের অপেক্ষায় ছিলাম।

আমরা বড় আশা নিয়ে ছিলাম সুখের সময়গুলো খুব দ্রুত ফিরে আসবে আমাদের মাঝে, অপেক্ষা ছিল একটি নির্দিষ্ট সময়ের। আমি কখনও ভাবিনি সেই সময় শেষ হওয়ার মূহুর্তে জানতে পারব এমন ভীষণ কোন অসুখ হয়েছে তোমার, যা তোমাকে বদলে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। তুমি যার জন্যে বদলে যাচ্ছ প্রতিমূহুর্তে, যার জন্যে আমাকেও ছেড়ে যেতে হবে তোমার। এমন ভীষণ অসুখ, যা আমাকে অসুখী করে তুলেছে তীব্রভাবে, এমন ভীষণ অসুখ তোমার- ক্যান্সার! কেন বিধাতা শেষ মূহুর্তেও আমাদের জীবনে এতটুকু সুখের ছোঁয়া দেবেন না? তোমাকে সামান্য আলোতেও আমি হয়তো মরতে দিতে পারব না, অই অন্ধকার ঘরে, স্যাঁতস্যাঁতে চারদেয়ালের মাঝে, ঘুণেধরা কড়িকাঠের দিকে চেয়ে থেকে তোমাকে চলে যেতে হবে? কেন? কতটুকু চেয়েছিলাম বলো? আমরা আমাদের দুজনকে ছাড়া তো আর কিছুই চাইনি। লিপ্সা ছিল শুধু আমাদের জন্যেই- জীবনের আরেক প্রান্তে দাঁড়িয়ে।

প্রতীক্ষা বড় ক্লান্তিকর, বড় ভয়াবহ এর যন্ত্রণা; তবু মেনে নিয়েছিলাম একটু স্পর্শের জন্য, একটু উষ্ণতার জন্য, একটু তীব্রভাবে বাঁচার আশা বুকে জিইয়ে রাখার জন্যে। পারব না আর আমরা, পারব না মহাকাল থেকে একটা মূহুর্তকে আমাদের আপন করে নিতে। এই পৃথিবীর আলো আর তোমার জন্যে নয়, এই আলোর স্পর্শ আমি একা কী করে নেব বলো? এই পৃথিবীর বিশুদ্ধ বাতাসে আর কখনও ভাসবে না তোমার এলোচুল থেকে ভেসে আসা উন্মাদনাময় সুঘ্রাণ, আমি কী করে এই বাতাসে একা নিঃশ্বাস নেব? মহাজগতের সবটুকু জোছনা তোমার জন্যে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে, সবটুকু অনুভূতি তোমার জন্যে অস্পৃশ্য হয়ে যাচ্ছে, সবটুকু রঙধনু তোমার জন্যে নিষ্প্রাণ হয়ে যাচ্ছে, সবটুকু উৎসব তোমার জন্যে অর্থহীন হয়ে যাচ্ছে, সবুটুকু স্পর্শ তোমার জন্যে শীতল হয়ে যাচ্ছে, সবটুকু উচ্ছাস তোমার জন্য হারিয়ে যাচ্ছে, সবটুকু আলো তোমার জন্য নিভে যাচ্ছে- কেন? কতটা বিশুদ্ধ বাতাস তুমি গ্রহণ করে ফেলতে এই পৃথিবীর, কতটুকু আলোর ছোঁয়া নিতে? কতটুকু শস্য এই পৃথিবীর তুমি শোষণ করতে, কতটুকু পানীয় পান করতে? কতটা ক্ষতি তুমি করে ফেলেছিলে এই গ্রহের যে তোমাকে এইভাবে রিক্ত করে দিবে পৃথিবী? তুমি চলে যেও না, আমি তোমার স্পর্শ ছাড়া বেঁচে থাকতে পারব না কোনভাবেই। ক্যান্সারের মতো মরণব্যাধি ফেরানোর ক্ষমতা আমার নেই, কিন্তু তোমাকে ভালবাসার যে ভয়াবহ ক্ষমতা নিয়ে আমি জন্মেছি, সেটা দিয়ে তোমাকে আগলে রাখার ক্ষমতাও কি আমার নেই? চলে যেও না, তোমার অভাব আমার সহ্য হবে না কোনভাবেই- আমি ভেঙে পড়ব পুরোপুরি। জীবনের যে শক্তিতে এতটা পথ চলে এসেছি সেটার উৎস ছিলে তুমি; যদি চলে যাও, আমার চারপাশের সময় চলবে নিজস্ব গতিতে অথচ আমি থেমে যাব সম্পূর্ণ- এর চেয়ে ভযাবহ যন্ত্রণা আর কী হতে পারে? আমার পৃথিবী জুড়ে নিকষ কালো আঁধার নেমেছে দীর্ঘ ছয় বছরের নিরবচ্ছিন্ন আলোকছটার পর।

/*ক্যান্সারের সঙ্গে বসবাস নামটি শহীদ জননী জাহানারা ইমামের 'ক্যান্সারের সঙ্গে বসবাস' গ্রন্থ থেকে নেয়া হয়েছে। */

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.