দিল ঠান্ডা তো দুনিয়া ঠান্ডা।
বন্ধুবর আখতারুজ্জামান তার ফেসবুক নোটে একটি লেখা দিয়েছে নতুন মুক্তি পাওয়া মেহেরজান সিনেমাটা নিয়ে। পড়ে মনে হল, এট সবার জানা উচিৎ। তাই তার অনুমতিক্রমে লেখাটি সামুতে।
মেহেরজান : জব্দ হোক সব রিল,গ্রেপ্তার হোক পরিচালক রুবাইয়াত
'যুদ্ধ ও ভালোবাসার ছবি', পোস্টারে এই লেখা দেখে গত ২২শে জানুয়ারি বলাকায় 'মেহেরজান' ছবিটি দেখতে গেলাম এবং ছবির ঝকঝকে প্রিন্ট,ক্যামেরার নিখুঁত কাজ এবং কতিপয় অভিনেতার সুঅভিনয় দেখে ফেসবুকে উচ্চকিত প্রশংসাসমেত স্ট্যাটাসও দিলাম ।
দেখার ২৪ঘণ্টা পরেও ছবিটার গূঢ়ার্থ বুঝিনি । অকস্মাত্ উপলব্ধি করলাম এই ছবি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সাথে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক এবং অবমাননাকর । একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি হয়েও সিনেমা দেখামাত্র বক্তব্যটা ধরতে পারিনি, তাহলে অপ্রাপ্তবয়স্করা কী করবে?
ছবিতে ৩জন মুক্তিযোদ্ধাকে দেখানো হয়েছে, যাদের প্রত্যেককে নারীলিপ্সু হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে । এই ৩জনের কারো হাতে কখনোই কোনো অস্ত্র দেখা যায়নি, কেবল দেখা গেছে অন্ধকারে আড়ালে-আবডালে নারীর গা হাতাতে !
মেহেরের মুক্তিযোদ্ধা-খালাতোভাইকে রীতিমতো গতানুগতিক ঢালিউডি সিনেমার প্রতিহিংসাপরায়ণ ভিলেন হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে এবং মেহেরকে দিয়ে তাকে থাপ্পড় পর্যন্ত মারানো হয়েছে,এই থাপ্পড় ইনজিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে মুক্তিযোদ্ধার পশ্চাদ্দেশে শিবিরপ্রদত্ত লাথির কথা মনে করিয়ে দিল !
যেখানে একাত্তরে পাকসেনারা গোটা দেশকে একটি ধর্ষণালয় বানিয়েছিল, সেখানে পাকসেনা ওয়াসিমকে দেখানো হয়েছে যৌনবিমুখ এবং নিষ্পাপ-মানবতাবাদী হিসেবে ।
পরিচালক ভুলে গেছেন 'ব্যতিক্রম কখনো দৃষ্টান্ত হতে পারে না' ।
আর ধর্ষিতা নীলাকে দেখানো হয়ে একজন nymphomaniac (যৌনতাড়িত) হিসেবে । ধর্ষণের পর কোনো নারী নীলার মতো এভাবে masochistic হয়ে পড়ে তাও এই প্রথম দেখলাম । তাকে বেশ কটি দৃশ্যে আপত্তিকর দেহাবয়বে উপস্থাপন করা হয়েছে,যা গোটা ২লাখ বীরাঙ্গনাকেই অপমানিত করল । মানসিক প্রতিবন্ধী সালমাকেও দেখানো হয়েছে যৌনতাড়িত নারী হিসেবে, যে কেবল দিনরাত কোনো 'লম্বু ছেলে'কে নিয়ে আলমারিতে ঢোকার স্বপ্ন দেখে । এবং সে তার বাবাকে বলে সে 'মুতা ম্যারেজ' করতে চায়, একজন পাগলের মুখে 'মুতা ম্যারেজ' কথাটা কীভাবে উচ্চারিত হয়?
ছবির কেন্দ্রীয় নারী অষ্টাদশী মেহেরকে যতভাবে যৌনাবেদনময়ী করে হাজির করা যায়, পরিচালক তাই করেছেন ।
সত্তরের দশকে একজন বাঙালি যুবতী বুকখোলা বসন পরত কি না, সে বিষয়ে পরিচালকের ধারণা নেই । গোটা ছবিতেই নারীকে যৌনউপকরণ হিসেবে প্রতিপন্ন করা হয়েছে,অন্দরে-চায়ের দোকানে পাকসেনাদের প্রশংসা করানো হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধাদেরকে যৌনান্ধ খলনায়ক বানানো হয়েছে এবং অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়েছে একাত্তরে বাঙালি নারীরা সেধে সেধে পাকসেনাদের সাথে সঙ্গম করেছে !
পুরো ছবিতে কোথাও কোনো যুদ্ধের চিত্র দেখানো হয়নি,মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব,রাজাকারদের নৃশংসতা,পাকসেনাদের বীভত্সতার কিছুই দেখানো হয়নি । মনে হয়েছে একাত্তরে যুদ্ধটুদ্ধ কিছু হয়নি,কেবল কয়েকটি লোক খাজাবাড়ির চেয়ারে বসে গালে হাত দিয়ে চোখে সুরমা লাগিয়ে গমগম গলায় বেহুদা টেনশন করেছে!
তাহলে যেসব শিশু বা কিশোর এর আগে কোনো যুদ্ধের সিনেমা দেখেনি, তারা কি ধরে নেবে না যে, আসলে একাত্তরে দেশে কোনো হত্যাকাণ্ডই ঘটেনি?
যদি গল্পটা সত্যি হতো তবে নাহয় মেনে নিতাম । প্রথম আলোতে পরিচালক লিখেছেন সব চরিত্র 'কাল্পনিক' । কাদের মোল্লা বা সাকা চৌধুরীরা যখন বলে যে, মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেছিল 'নারীর লোভে', তখন আমি অবাক হই না, কেননা তারা স্বীকৃত স্বাধীনতাবিরোধী ।
কিন্তু আমি বাকরুদ্ধ হলাম তখনই, যখন জানলাম ছবির মূল অর্থযোগানদাতা খোদ লীগের মন্ত্রী এবং পরিচালক রুবাইয়াত হোসেন ওনারই কন্যা । 'স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি'র কোনো মন্ত্রীর মেয়ে যখন মুক্তিযোদ্ধাদেরকে নারীলিপ্সু হিসেবে উপস্থাপন করেন,তখন পরিচিত যুদ্ধাপরাধীরা বগল বাজালে তা থামাবে কে!?
একাত্তরে যখন গোটা জাতিকে কচুকাটা করা হয়, গোটা বাংলাদেশে ধর্ষণের রাজত্ব কায়েম করা হয়, তখন রুবাইয়াত একটা উদ্ভট কাল্পনিক গল্প ফেঁদে গোটা মুক্তিযুদ্ধকে অপমানিত করলেন সেরেফ ছবির ব্যবসাসাফল্যের স্বার্থে !!
দেশে যখন যুদ্ধাপরাধের বিচারের সাজসাজ রব চলছে,তখন লীগের মন্ত্রীর কন্যার এই চলচ্চিত্র কী ইঙ্গিত বহন করে???
আমি মনে করি, একজন সাকাচৌ বা কাদের মোল্লা সারাজীবনে তাবত্ মুক্তিযোদ্ধাবিদ্বেষী বক্তব্য দিয়ে যত অপরাধ করেছে,একা রুবাইয়াত হোসেন এই সিনেমা বানিয়ে তার চেয়ে বেশি অপরাধ করেছে ।
এ অপরাধের ক্ষমা নেই !
এখন সবার আগে প্রয়োজন মেহেরজান ছবির সব কটি রিল জব্দ করা এবং ধ্বজভঙ্গ সেন্সর বোর্ডকে বরখাস্ত করা ।
আশা করি, দেশের কোনো সাহসী ব্যক্তি রুবাইয়াত হোসেনের নামে মানহানি মামলা করবেন; আরেকটু আগ বাড়িয়ে আশা করি, রুবাইয়াত হোসেনকে অবিলম্বে গ্রেপ্তার করা হবে ।
আখতারুজ্জামান আজাদ ,
২৭ জানুয়ারি ২০১১
আখতারুজ্জামান আজাদের মুল লেখাটি এখানে।
Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।