হারাতে চাই নিঃষীম আধারে,ডুবে যেতে চাই নিকশ কালোয়....যদি তোমায় না পাই আলোয়.........
বাংলাদেশী সিনেমা নিয়ে প্রত্যাশার জায়গাটা খুব একটা গভীর না আমার। নানান প্রতিকূলতা আর সীমাবদ্ধতার মধ্যেও আমাদের প্রচেষ্টা কিন্তু থেমে থাকে না,এর মাঝে দিয়েই বেরিয়ে আসে কিছু কালজয়ী কাজ,অসামান্য সৃষ্টি। তেমনই কিছু অনুভুতি নিয়ে হল থেকে বের হলাম মেহেরজান দেখার পর।
সত্যি বলতে এই সিনেমাটা নিয়ে বেশি কিছু জানতাম না আমি,আজ কয়দিন ধরে টিভিতে এড আর রাস্তায় বিলবোর্ড দেখার পর আগ্রহ হল জানার। যা জানলাম,সিনেমাটা দেখার প্রতি টানার জন্যে বাংলাদেশী দর্শক হিসেবে আমার কাছে যথেষ্ট ছিল।
সিনেমার পরিচালক একজন মেয়ে,রুবাইয়েত হোসেন যিনি ইউনিভার্সিটি অব পেন্সিল্ভেনিয়ার একজন স্কলার এবং পরবর্তীতে ফিল্ম এর উপর ডিপ্লোমা করা। ফিল্মে প্রথমবারের মত বাংলাদেশী কোন সিনেমায় কাজ করতে যাচ্ছেন জয়া বাচ্চন,ভিক্টর ব্যানার্জী,ওমার রহীম। বাংলাদেশি,ইন্ডিয়ান,পাকিস্তানী,সব মিলিয়ে বাস্তবিক অর্থেই যাকে আন্তর্জাতিক সিনেমা বলা যায়।
সিনেমার শুরুতেই সারা নামের এক ওয়ার চাইল্ড জার্মানী থেকে বাংলাদেশে আসে,যাকে কিনা যুদ্ধের পর এক জার্মান দম্পতি এডাপ্ট করেছিল। সে দেশে এসে উঠে জয়া বাচ্চনের বাসায়,এই জয়া বাচ্চন ই হচ্ছে মেহেরজান।
সিনেমা শুরু হয় সারা আর জয়া বাচ্চনের ইংরেজী কথোপকথনের মধ্য দিয়ে,জানা যায় সারার রেপড হওয়া মা ছিল জয়ার কাজিন। ফিল্ম চলে যায় ফ্ল্যাশব্যাকে,দেখা যায় তরুণী বয়সের মেহেরজান(সায়না আমিন) ঢাকা থেকে পরিবার সহ তার নানার বাড়ী পালিয়ে আসছে। সেই নানা,যে তার গ্রাম কে মুক্তিবাহিনী কিংবা পাকিস্থানী,এদের সবার কাছ থেকে রক্ষা করে আসছে। পর্দায় দেখা যায় ভিক্টর ব্যানার্জ়ীকে,যে নানাজান চরিত্রের রূপদাতা। তিনি কলকাতা থেকে ৪৭ এর দেশ বিভাগের পর এই বাংলায় ঠাই নেন,এবং এলাকার সব চাইতে সম্মানিত ব্যাক্তি,যার প্রভাব পুরো সিনেমাজুড়ে দেখা গেছে।
পর্দায় হাজির হয় নীলা নামক একজন,যাকে পাকিরা তুলে নিয়ে রেপ করে এবং যে কিনা সারার মা। কাহিনী এগোয় মেহের কে নিয়ে,একদিন যখন তাকে পাকিস্থানী সৈন্যরা একা পেয়ে রেপ করার চেষ্টা চালায়,তখন এক স্বত্যাগী বেলুচি সেনা তাকে উদ্ধার করে। এই সেনা বাংলাদেশে হওয়া নির্বিচার হত্যার প্রতিবাদ করায় তাকে পাকিস্থানী সেনার পক্ষ থেকে দন্ড দেয়া হয় এবং সে পালিয়ে বেড়ায় মুক্তিবাহিনী আর পাকি সৈন্য উভয় তরফ থেকে। এমত অবস্থায় মেহের এই সৈন্যকে চুরি করে আশ্রয় দেয় এবং এক পর্যায়ে তার প্রেমে পড়ে। দেশের স্বাধীনতার চরম মুহুর্তে শত্রুপক্ষের প্রেমে কাবু মেহের অনুশোচনায় কাতর হয়,তবু সে ভালবাসার কাছে পরাস্ত।
একদিকে রেপড হওয়া নীলা প্রতিশোধের আগুনে জ্বলে পাকিদের বিরূদ্ধে অস্ত্র ধরতে যোগ দেয় মুক্তি বাহিনীতে,অন্যদিকে মেহের ভাসতে থাকে শত্রুসৈন্যের প্রেমে!
সিনেমা এভাবেই পরিনতির দিকে এগোয়।
কাহিনীর পর যদি সিনেমা নিয়ে বলা লাগে,প্রথমেই বলতে হবে এর এপ্রোচের কথা। যুদ্ধ নিয়ে আমাদের প্রচলিত সিনেমাগুলোর লাগামহীন আবেগের পাশাপাশি এখানে বাস্তবতা এসে ঠাই নিয়েছে স্পষ্টভাবে। "যুদ্ধ করতে করতে আমি ক্লান্ত,এখন আমি বিয়ে করে স্যাটাল্ড হতে চাই" কিংবা "আমি আমার গ্রামে কোন রক্ত চাই না" জাতীয় সংলাপ এর আগের কোন মুক্তিযুধ বিষয়ক সিনেমায় ছিল কিনা,আমার জানা নেই।
ভিক্টর ব্যানার্জ়ীর অভিনয় নিয়ে কিছু বলার সাহস পাচ্ছি না,উনার অভিনয়ের তুলনা বোধ করি উনার সাথেই দিতে হবে।
নানাজান চরিত্রের একজন সম্ভ্রান্ত মুসলিম হিসেবে তার অভিনয়ে প্রশংসার বন্যা বয়ে যাওয়ার মত কাজ তিনি করেছেন। অসাধারণ উচ্চাভিলাষী অথচ পরিমার্জিত,উচ্চ শিক্ষিত এবং সুফী ধ্যানে বিশ্বাসী তিনি। উনার শক্তিশালী অভিনয়ের কল্যাণে অনেকের অভিনয় এই ছবিতে বোধ হয় চাপা পড়ে গেছে।
তবে আমার কাছে সিনেমার সব চাইতে বিস্ময়ের চরিত্রটি করেছেন নীলা নামধারী রীতু আব্দুস সাত্তার। রেপড হবার পরেও যার মনোবল বিন্দু পরিমান ভেঙ্গে যায়নি,যে সমান তালে সাহসী,প্রতিবাদী এবং কেয়ারলেস।
পাকিস্থানী ক্যাম্প থেকে ছাড়া পাবার পর সবাই তার ক্যাম্পে নির্যাতনের কথা মানুষের কাছে চেপে যেতে বল্লেও সে একেবারেই নির্ভীক এ ব্যাপারে। তার এ দৃড় চেতনা দেখে মুক্তিযোদ্ধা আজাদ আবুল কালাম তাকে বিয়ের প্রস্তাব ও দেয়। এই চরিত্রের অসাধারণ অভিনয় বোধ করি আমাকে এই সিনেমার অন্য যে কোন নারী চরিত্র থেকে বেশি আকর্ষণ করেছে।
মেহের চরিত্রে আছে দুই নারী,জয়া বাচ্চন এবং সায়ান আমীন। দুই জনের অভিনয় ই অসাধারণ ছিল।
জয়া বাঙ্গালী এক প্রেমময় প্রতীক্ষারত নারীর চরিত্রে অসাধারন ছিলেন,অসাধারন ছিলেন সায়ান আমীনও দ্বিধান্বিত কিন্তু ভালবাসা আর প্রেমে দৃঢচেতা নারীর ভুমিকায়।
পুরো সিনেমাজুড়ে অসাধারন সিনেমেটোগ্রাফী মন ভরিয়ে দিয়েছে। মিউজিক ডিরেকশন ভাল ছিল,তবে ব্যাকগ্রাউন্ডে কাজ আরেকটু ভালভাবে হতে পারতো। কস্টিঊম ডিজাইন গোছানো ছিল,তবে যে গ্রামে কারেন্টের বালাই নেই,সেখানে বারবার আজানের শব্দ শোনাটা একটু দৃষ্টিকটু লেগেছে আমার কাছে।
সব মিলিয়ে বলা যায়,এই প্রথম সত্যিকার অর্থে মাটির ময়নার পর আন্তর্জাতিক একটা বাংলাদেশী সিনেমা দেখলাম,যেটায় যুদ্ধের চাইতে প্রেম ই ছিল মূখ্য বিষয়।
ডেব্যু ডিরেক্টর হিসেবে রূবাইয়েত যে নিখুত কাজ দেখিয়েছেন,তাতে বলতে বাধ্য হচ্ছি,শিখে কাজ করাটা বরাবর ই মান বজায়ে এগিয়ে রাখে যে কাউকে। আশা করি আপনারা সবাই হলে গিয়ে সিনেমাটা দেখবেন এবং দয়া করে পোস্টের শেষে সিনেমার লিঙ্ক কই জাতীয় কমেন্ট এড করবেন না ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।