আমার অধরা বিষয়ক কবিতার তাফসিরঃ আমার অধরা, দায় ও অন্যান্য প্রসঙ্গ
[ সমাপনে কবিতা আছে, পড়ুন যদি ভালো লাগে]
অধরা। যাকে ধরা যায় না। দৃশ্যমান বস্তুজগত আমাদের চোখে ঠুলি পরিয়ে দেয়। চোখ দিয়ে দেখতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে উঠি। চোখের বাইরে যা কিছু তার ব্যাপারেও আমাদের ঈমান আছে।
তা না হলে খোদা মানত না কেউ। কোন অথরিটি বলছে, কীভাবে বলছে, তার উপর নির্ভর করছে বিশ্বাস করা না করার ব্যাপারটি। বিশাল মেদিনীমন্ডল ও গ্রহে –নক্ষত্রে দেদীপ্যমান এই মাখলুকাত বা আলমমন্ডলের বেশিরভাগ বস্তুই গোচরীভূত বা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়। ইন্দিয়গ্রাহ্যতাই শেষ বিচারে সবকিছুর শেষ কিংবা শুরু নয়। তবে ইন্দ্রিয়ের আধার যে জীবে, সে-ই জীবদশা ও জীবদ্দশার মধ্যে ঠাঁই না নিয়ে কোন উপায় নাই।
তার মানে যা কিছু অধরা,তার আলোচনার আগে আলমন্ডল আমাকে টানছে। এই
অধরাকে ‘দরবেশি’ কায়দায় কোন কেরামতি দিয়া ধরা যবে না। অধরার আমল আধ্যাত্মবাদী কোন ব্যাপার নয়।
অধরা আসমানে নাই। এটা গায়েবি কোন ব্যাপার না।
এর আগে একটু অন্য প্রসংগর জের টেনে রাখি। দুইটা দিক। একটা হোল, একটা বিষয়কে আপনি কীভাবে বয়ান করবেন, বোঝানোর জন্য, চেনানোর জন্য; অন্য দিকটা হল, মানুষটা আসলে কী; যেমন, আমাকে বললেন যে, আমি বাঙালি। বর্ণণায় ঠিক আছে। কিন্তু এই বলে যদি আমার ব্যাপারে এটা ঠাহর না করেন যে, আমি বাংলা ভাষায় যা কিছু ভাব, চিন্তা, দর্শন আমার প্রকাশস্বরুপ আপনাদের কাছে পেশ হয়, তাতে আমি বাঙালী হয়ে থাকতে চাই না, বাঙালীর সংকীর্ণ, রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে উঠার মানেগুলোকে ভেঙ্গে চুরমার করে আমি যে আপনাদের ভূ-খন্ডের হয়ে থাকতে চাই না, আপনাদের ঐতিহ্যের স্মারক করে আমাকএ যে অপমান করছেন, সে-ই দিকে খেয়াল করতেও বলি।
লালন সাঁইজি কালাম দিয়েছেন। [তিনি রচনা করেন নাই] তার উপর এসব কোন কিছুই নাজেল হয় নাই। তার কালাম, তার কাছে [ এবং অন্য কালামও, যা তিনি এবং অন্য সাধকগণ জীবন্ত মানুষ হিসেবে সাধন প্রণালির অংশ, একেবারে বাস্তবতা, জীবন-জীয়ন ও ‘সাধকের জন্য’ তা একেবারেই কালাম দেহকলের অংশ। এগুলোর অর্থ তৈরি হয়
শোর-কেরেঙ্গাল, কুতর্কে লিপ্ত হতে চাই না। কুতর্ক করার সময় আমার নাই।
আলম নানা প্রকারের। আমার আগ্রহের জায়গা হল, ইলমের আলম ও হুকুমের আলম। এই হুকুমের আলম মানে প্রকৃতির মধ্য প্রতিনিয়ত স্ব-গুণে,নিজের অস্তিত্বের স্বভাবে যা বিধান আকারে মানুষ অবশ্য পালনীয় আকারে মানুষ ও জীবের জন্য বিধান। এই বিধান পালনে নড়চড় হলে, গাফিলতি বিপদের অন্য কারণ হতে পারে। ল’ ইন কালেকশন – যা ইচ্ছা নিরপেক্ষভাবে পরম [পুরুষ] তার সাথে আমার ইলমের আলম ও হুকুমের আলম জগতের অগুণতি অস্তিত্বের প্রাণসখা হয়।
হুকুমের আলম মানে আপনাকে অন্য কোন অস্তিত্ব হুকুম দিচ্ছে না। এটা প্রাকৃতিক বিধানের সমষ্টি। এই বিধানকে সূত্রবদ্ধ করতে পারলে তখন বিজ্ঞান নামক যা কিছু কায়েম হয় তা এই বিধানকে আত্মস্থ করার একটি প্রক্রিয়া মাত্র। এই অধরা ভাবে দাখিল হয়, প্রস্তাবিত হয়।
সাংখ্য ভাবলোকের পুরুষ ও প্রকৃতি আলাদা।
এই দর্শন মতে পুরুষের বৈশিষ্ট্যঃ (বলে রাখা ভালো,পুরুষের সহস্ত্র সংজ্ঞা আছে)
• পুরুষ মানে “অস্তিত্বময় কিন্তু দেখা যায় না” এমন সত্তা, যা অনন্তকাল ধরে, চিরকালই [ সময়ের আগ থেকে, কিন্তু প্রাণ নাই তো পুরুষ নাই] প্রকৃতির বাইরে। পুরুষ মানে রুহানী, [বিশুদ্ধ চৈতন্যের নূরখন্ড,সত্তায় সংগুপ্ত,আকিদা], যা ‘প্রকৃতি’ থেকে আলাদা। এর কোন নাম নাই, ভাবের হাটে চট করে চিনে ফেলার মত কোন বৈশিষ্ট্য বা বস্তু [গুণ] নাই। এটা সূক্ষ্ম, মোহনমিহি,নিরাকার ও সামান্য, বিরাজ করে সর্বত্র। বুদ্ধি, মন কিংবা ইন্দিয়ের ধরাছোঁইয়ার বাইরে।
সময়, দেশকালপাত্র এবং ঘটনা, রূপান্তর, উৎক্রমণ ও উত্তরণ নিরপেক্ষ। [ প্রস্বেদনে শুধু তার আস্বাদন, সে কাঁচা বাঁশের খাচা ছেড়ে যায়, সে আমার নিয়ত সাথী, তবু তার সাথে দেখা হয় না]
• পুরুষ আছে সর্বত্র, প্রাণস্বরুপে, যাকে আমরা আত্মা বলি। কাল, ঘটনমান বর্তমান, অতীত কিংবা অন্যভাবে বলা যায় প্রাণ ও প্রকৃতি নিরপেক্ষ। এটা নিঁখুত, কোন খুঁত নাই, পরম।
• সবচে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, তার কোন সক্রিয়তা নাই, নির্বিকার,কোন ঘটনার কারণ নয়, কোন ঘটনা ঘটায় না।
কিন্তু সাক্ষী আবার সবকিছুর। এই পুরুষ মৌলিক, কোন কিছুর সমাহার এর মধ্যে ঘটে না।
• সাংখ্য মতে পুরুষের নানা প্রকারভেদ আছে। হাজার হাজার অগুণতি পুরুষ আছে। অসীম সংখ্যক পুরুষ আছে।
অমর। এক পুরুষ থাকলে, এক আত্মা উড়িয়া গেলে সকল আত্মার মুক্তি ঘটে যেত।
• আবার কইতাছে সাংখ্যওয়ালারা (বৈদিক-বেদান্তবাদিরা)যে, সব আত্মাই নাকি আদতে প্রায় এক রকম ( প্রকৃতির মধ্যে, আবার বলছে প্রকৃতির মাঝারে পুরুষ পরপুরুষ, প্রকৃতি থেকে আলাদা, আসলে তো প্রকৃতির বাইরে কিছু থাকে না, যেমন, আমরা বলি রুহানি জগত।
• সবচে খাস কথা হলো, পুরুষের যখন মুক্তি, ওনি কোথাও যান না, তার কাল-কলন্দর বা পরিব্রাজক হবার সুযোগ নাই। সে স্থানুবৎ নয়, আবার চলিষ্ণু নয়।
বাইরের দিক দিয়ে দেখলে, এক আত্মা অন্য আত্মা থেকে পৃথক, একটার সাথে আরেকটার দেখাদেখি, মাখামাখি, মেলামেশা নাই। প্রত্যেক আত্মারই নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে, ব্যক্তিত্ব আছে।
• যে স্বরূপে, যতোবার জন্মান্তর হউক না কেন, আত্মা অপরিবর্তিত থাকে। প্রকৃতি আন্ধা, সে কিছু দেখতে পায় না। তার দৃদৃক্ষা নাই।
তার নিজের রুপ নিজে দেখে না। কিন্তু পুরুষ দেখে। আলাদা আলাদা সৃষ্টির কাজ কারবারের সাক্ষি হেতাইন। সে সব দেখে। সর্বদ্রষ্টা।
দেখে প্রকৃতির মধ্যে মিলে গিয়ে , মিশে গিয়ে, একীভুত হয়ে। প্রকৃতি তার নিজের ফ্যানোম্যানা তো দেখে না। সাক্ষী হয় পুরুষ। আত্মা, বিরাজবিনয়ি, এই উদাসি পুরুষ আবার সত্তা, কর্তাসত্তার কাজের দর্শক। তিনি সাক্ষি, তিনি দ্রষ্টা বা নীরব দর্শক, তিনি মধ্যস্থতাকারী ( না তিনি তা নন, তিনি প্রকৃতির অন্তস্থ ও মধ্যস্থ, তিনি একা, নিরল-নীরব কৈবল্য, তিনি উদাসীন, নির্বিকার [ তা’হলে ইনাকে দিয়া কাম কী]
পুরুষ নামক এই যে মিঞাভাই, মনে হইতাছে, নির্গুণ, কারো সাতে পাঁচে নাই।
মধ্যবিত্ত কবির মত কেবল ঘরে বসিয়া বিপ্লবের কবিতা লেখে আর র্যাাবের ভয়ে ক্রসফায়ার নিয়া একটাও কবিতা লেখনি দিয়া কালি ও কাগজে দাখিল হ্য় না এই সাংঘাতিক সাংখ্য পুরুষ ভাইজানের কোন লিংগ নাই। তবে ইনাকে না বুঝলে ভাবজগতে আপনি আন্ধার পিঠে ল্যাংড়া হইয়া পথ চলবেন।
পুরুষ লইয়া একটি বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনার বুনিয়াদ [ তারপর রুহানী জগতে প্রবেশ]
কিন্ত এইবার সিরায়াস হই। পুরুষ অকর্তা। কিন্তু প্রকৃতি কর্তাগিরি করে, তবে সে জানে না যে ঘটন পটিয়সী।
যে পাত্রে, আধারে (খুলির ভেতর ঘিলু, তার মধ্য হইতে স্নায়ুরজ্জু বাইয়া বাইয়া কোষে আর জিনে, হাড়ে আর মজ্জায় এই রহস্যময় বাসনা, কামনা, কল্পনা- সব ছাপিয়ে আবার সব কিছুকে ব্যাখ্যার ক্ষমতার নাম ‘জ্ঞান”) জ্ঞান থাকে, তা প্রকৃতি। হেতুতে মগজ স্বয়ং জ্যান বা জ্ঞান হয়ে যায় না। অতএব, বুদ্ধি যদি বিছমিল্লায় না থাকে, বুদ্ধি মগজে প্রাকৃতিকভাবে উদ্ভূত নয়। তবে ইন্দ্রিয় ও এর অ্যান্টিনা একেবারে প্রাকৃতিক। আবার জ্ঞান না থাকলেও বুদ্ধি হতে পারে, যদি না একেবারে বুধ্য কেউ না হয়।
দেহের চলন-বলন, নড়ন-চড়ন জ্ঞান না থাকলে চলবে। নিজের মধ্যে কর্তাশক্তির আবির্ভাব তো হবে না। ক্ষমতাবান হয়ে উঠা, ক্ষমতা জন্ম দেয়ার জন্য তো সত্তা স্বয়ং “ পুরুষের’ উপস্থিতির গুণে নিয়ামক নিজ কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠে। সে জন্য পুরুষ হলেন তিনি যিনি আমায় জ্ঞানের সূত্রে হাতে খড়ি দেন। কিন্তু তার সাথে আমার চিন-পরিচয় হয় না।
কিন্তু লগে লগে আছে। আমি মিছিলে যাই, বুঝি আছে। আমি যখন সামান্যকে সত্য করি, বুঝি আছেন। আমি যখন বিশেষ থেকে নির্বিশেষে যাই, বুঝি আছি। আমি যখন বলি, তিনিই পুরুষ, আর সব প্রকৃতি, বুঝি আমার মাঝার তার আনাগোনা।
আমার জীব- জীবনের দশার ভেতর, আমার সত্তা অর্থাৎ আমার ধড়ের ভেতর, আমুন্ডনখাগ্রে, সন্ধানের, বুদ্ধির একেবারে আলাদা সূত্র নিয়ে আমার সংগে তার বিরাজ-দশা ঘটে আমার সাথে, আমির সাথে এক হয়ে। আমি তার এজেন্ট হয়ে যাই। বেদে যার দেখা নাই- সেই জ্ঞান, চাষে-বাসে, ভাবে- বোধে, তত্ত্ব-তালাশে আমার কর্তাসত্তা তার এজেন্ট হয়ে যায়। আমার নিথর দেহ তার তরঙ্গে বস্তু চিনে নতুন রঙে। প্রাণ প্রকৃতির সাথে আমার লীলাখেলা হয়।
আমার দেহপটে ফটিক স্বচ্ছ জলে আমি নিজে সাঁতার কাটি আসি। আবার তারই লীলায় তারই খেলায় একই জলে গরম সিনান হয়। তাই বুদ্ধি এবং বোধের আধার দেহের ভেতর তাহার উপস্থিতি বা গদিনশীন হলে, ঐক্য আমায় প্রশ্নকত্তা করে, আমি সবকিছুকে প্রশ্ন করি বুঝে নেবার জন্য। আমি নিথর দেহের তরংগ হন তিনি। সহজ হয়ে সবকিছু জাগ্রত হয়।
তিনি সূর্য হয়ে আসেন যেন জলের জন্য, তিনি আগুন হয়ে যান চলে যান কামারশালার লোহা ধন্য। তিনি গুণকে করেন নিজের গুণে গুণান্বিত। মিলনে লৌহ ও আগুন পরষ্পরের মধ্যে গুণের আদান-প্রদান করেন। বিরাজমান পুরুষ, না ডাকলেও আছেন যিনি, আসেন যিনি তা-ই করেন। যেই মাত্র আমার দেহে, আমার ভেতর ( সত্তা) মিলন ঘটে তার, এই মিলনের কারণ কিংবা ফল, আমি ক্ষমতাদানের কর্তা হয়ে উঠি।
সকল আলম মন্ডলে আমার বিচরণ শুরু হয়। আমি সকল দিব্য-দহন শুষে শুষে দহনস্নিগ্ধ হই, আমি সকল নেয়ামতের ভাগিদার হই। পরলোকের অধিষ্ঠান হয় আপন লোকে। প্রকৃতিকে দেখভাল করার জন্য তিনি জীবের মধ্যে হাজির হয়ে প্রাণ প্রকৃতির রাজনীতি শেখান আমাদের। পুরুষ আবার সাক্ষি-কর্তা।
তাই এই শরীর, মন, ইন্দ্রিয় অনুভবে- আস্বাদনের খায়েশ যদি কর্তার তৈরি হয় পুরুষ লাগবে। [ উল্ল্রেখিত প্রসংগ ও আরো কবিতা লিয়া আরেক কিস্তি]
১।
বসে আছেন সাধু একা, আসমানে নিরালার রেখা
ছায়াবতী বৃক্ষ আমায় দিলেন দেখা
প্রস্বেদনের আস্বাদনে জীব সোয়াদে সাধন করি
দহনদীপ্ত মুখের মায়ায় কালভেরি আর স্মৃতির ঘড়ি
কাদায় কাদায় প্রাণ ছড়ানো, আমার দেহ মাটির ঘর
পদ্মজলায় সিনান সেরে আজ উঠেছি পদ্মাবতি
পাক গোসলের জলের ধারা, সাধু ছাড়া জীবন খরা
মনকে আমি যতোই বুঝাই, আমি তোমার
মন আমাকে মুগ্ধ করে, বলে আমায়, রং ছিটাব
একটুখানি জিরাই কোথায়, বারাম ঘিরে ভুজঙ্গনা
সারা জীবন কালের কাটা, ভ্য় পেয়েছি সাপের ফণা
আমার বেণায় আগুন ঘুমায়, পুড়ছি আমি, পোড়াব না
আরশি দিয়ে আরশ দেখি, বিম্বিত হ্য় আমারই মুখ
দহন বড়ো, জ্বালা বড়ো, আমায় ধরে জীবজীবনের অসুখ। ।
২।
ঘোমটা সরাই, দেখি তোমায়, নিদ্রারিক্ত কাল কেটে যায়
আমার দেখা পেলে তুমি এমন করে সূর্য শিখায়
রসুইঘরে পাকের নেশায়, পাচন পুরাণ লাবরার গুণ
লবণ আমার রূপ রসায়নম, আগের বেলায় সময় দ্বিগুণ
কার তরফে নিষিদ্ধ গুণ পাই, সহ্য সীমার তা-ই
আমার বেলা, আমার হায়াত, আমার বায়ুর সীমা নাই । ।
আমি হায়াত বিলাই, হাতেম তাঈ …
৩।
চার কলেমা পাঠ করেছি এক কলেমা মনে, রূপ-নিরুপম, আমার আখ্যানে
একাত্তরে এক কলেমা ভনে, আমি গোর থেকে যাই কূল শ্মশানে, নিজের বিধানে
শাহাদতের শর্তস্বরুপ, আমি অরুপ, করি বিরাজ, আপন বিধান আপনি টুটি,
তালের টুপি শিরোস্ত্রাণে, আমার মেঘা একটু ঝরে, সব ভিজে যায়, আজ স্কুলছুটি । ।
একাত্তরে যুদ্ধ ছিলো, বায়ান্নতে ভাষা, নব্বইতে ছলচাতুরি, স্বৈরতন্ত্রের মরণ দশা
আজকে নিয়ম মেনে আমি যার এবাদত করি একা, শান্তি শ্রী এক ঘরের কথা
কথা যেন বৃষ্টিমুখর, বাচাল-ভেঙ্গুল আমি, আগুনমুখা বংশলতা । ।
৪।
বীরের মত বৃষ্টি এলো, বিরান ভূমির বিস্ময়ে, স্বামী স্বরূপ আমার যে সাঁই বাতাস এলো মুক্ত খেলো
নিজের স্মৃতির আশ্রযে। ঘরকে আমি জড়িয়ে ধরি মরণ-বাঁশের আশ্রয়ে, বাতাস যে আজ এলোমেলো
নিজর মাঠে নিজেই খেল, খিল বিরান এই মাঠে বাতাস আমার স্মৃতির শৈশব, লালন শাহের দেহে জানি জন্ম নিল বৈষ্ণব
তা-ই বলে কী স্বপ্ন আমার, লালন আমার অন্য কেঊ, তার ভেতরে মানূষ ছিলো, মানূষ ছিল, জানা শোনা ছিল তাহার
আদম গুণের বৈভব।
কম বিদ্যায় ঠাকুর ভাবেন, কী শিখিলাম তাল ঠুকিয়া, মত্রা আর অক্ষরের মাজে বিষন্ন –বিপন্ন ভবে
নয়া বৃষ্টির নয়া জলে কৈ মাছ তো নই আমি, কানকো দিয়ে ঠেলে ঠেলে জলজীবনের স্বাদ পেয়ে যাই
তখন বুঝি কে যে আমি, কে যে গুরু, কে যে সাঁই। ।
৫।
ওলান-ঝরা বৃষ্টি এলো, মাতাল যে তার সুর, নয়ননদে শ্রাবণ এলে, দূরে কোহিতুর
কী পোড়ালো তোমার জ্যোতি, পাহাড় নাকি আমি, আমিদগ্ধ সময় কাঁদে, এখন মহাভোর
আকাশ যখন জলে ঝড়ে, আমার তখন ঝড়-ঝম্পেশ ঝড়ের জীবন
আলেকলতায় ফুটে আছে আমার আশার ফুল। ।
এখন ভয়ে আর কাঁদি, বিলাপ-গহিন মনমাঝারে, ধনুক বাঁকা পথের মাঝে সমান্তরাল শুয়ে থাকি
কানন অধ্যুষিত প্রথম বোল, অস্থির মৌ, আলো গায়েব, গোধূলি-গুঞ্জনে তোতা
শেষ উড়াল, সন্ধ্যার সারস্বত একা পড়ে আছে। সুসজ্জিত জমিন কোরক-মুকুলে-ফসলে
এত সেজেগুজে পাখিও বিহারিণী, অভিসার আকাংখা আমার তোতা-তোতির ঠোঁটে
আমি সে-ই ঠোঁট বাঁকিয়ে তোমারই অপেক্ষায় থাকি। ।
যদি কবি আসেন আমারই ঘরে, তাকে দেবো লীলার আনন্দ
আজ এই রাধারিক্ত সময়ে, আপনি আমাকেই করে দিন রাধা
কবি লিঙ্গ-রৈখিক পাঠে আমি যেন হই আপনারই অপর। ।
৬।
মরণ দেখে দেখে আমি মুগ্ধ, কবে চলে যাবো, আমি তো পালকপুত্র, সাদা আত্মা উড়ে উড়ে যায়
যেতে যেতে কিছুটা রঙ সে দেখেও ফেলে গোধূলির খেলায়;
মরণ দেখে দেখে আমি আয়না-পাগল, নিজের মানুষ নিজে চিনে নিতে চাই, অনাবাদি আমি
যেতে যেতে কিছুটা ফসল যদি দিয়ে যেতে পারি;
মারমুখি মরণ নগর, উপাদেয় সব, এইবার আমি আস্বাদনের আহ্লাদ খুঁজি, বিলাপেও পাই না গো তারে
যদি যাই, আমন্ত্রণ রইল, স্বর্গীয় সম্ভাবনায়, আপনিও নাচবেন;
৭।
বেলা পড়ে যায়, হায়াতের দরখাস্ত লিখে কুল পাই না, এই তো জীবিকা আমার
আমার শরীর এখন পোকায় খাওয়া নষ্ট পাতাবাহার
আশাসিন্ধু শুকিয়ে গেলে, তরীখানা কিছুটা জলে, কিছুটা কাদায়, পড়ে থাকে জলকান্নায়
আমার শরীর এখন শুধু চায় মাতৃমঙ্গলা উপাদেয় আস্বাদন, তাই আমি ব্যস্ত রসুইক্ষেত্রে রান্নাবান্নায়
ধারাতৃপ্ত নদী নিজের অনাদি ভুলে আমাকেই জড়ায়
আমার খেয়াল শুধু রজোবীজে, জলকাদায়, ঝড়-জম্পেশ জীবন । ।
৮।
বাসনা রাখি, অন্তর্গত আজুদা রাখি, একদিন নাচতে নাচতে আপনার সাধের দোযখের নায়িকাদের সাথে মিলনমূহুর্ত
জানি মরণে যা পাইনি, মরণে তা পাবো
বাসনাবিরল যদি কিছু পেয়ে যাই, তবে আমি আপনাকে জানাব
কিছু যদি আজুদা-অলিক, তবে আমি সম্পূর্ণ মৌলিক
তবে আমি বস্তুময় জগতের শেষ অবস্থা
বাসনা রাখি, কড়া লাল সার্ট গায়ে বেহেস্তের বাগানে যাবো, নন্দন জ্বলন্ত নাগিনি আগুন অই যে দোজখে
সেখানেও নাচি, আনন্দময় এই সব আত্মনিবেদন, স্বকীয় এবাদত, আমারই অশেষ আনন্দে দোজখ-বেহেস্ত নিরপেক্ষ যুক্ত বর্ণের মানুষ, আমারই কনসার্টে সঙ্গীতসম্পর্কে মাতোয়ারা, যুক্তির ফরমায়েশ তারা খাটে না।
নাচনে-কুদনে আমি কৌলিন কালধারা, আমারই শরীরে আছে মৃত নদীদের হাহাকার
সিক্ত ও রিক্ত মুহুর্ত সম্পূর্ণ আলাদা, ভরা নদীর বাঁক দেখেছি বালুকাময়
৯।
মেদিনীমন্ডল মাঝে আদম উদয়, তার কাছে সব কিছু ভাবে মূর্ত হয়
আকণ্ঠ আমরা যারা সুধাসিন্ধু পানে, মরমি মহিমায় ভাবি উত্তরণ অপেক্ষায়
আছে বুঝি কোন নভনৌকা, কোন এক ত্বরণ মাঝি, কোথাও আছেন
অতএব, আপনারা থাকুন, আমি নিজের জন্য নিজেই লড়ি, যতোই জমকালো হোক এই মরণ, আমি তার পরোয়া করি না
লহুজলে মাখামাখি, নোনাজলে ভিজিয়ে রাখি নিজেরই শরীর, ইলিশের সাথে সিরাতুল মোস্তাকিন, সরাসরি সাঁতরে আসি ইলিশের সাথে পদ্মাপ্রখর স্রোত, কোন এক জোয়ার-জৌলুষে, আপনার জালে এসে বিরাম;
সুতরাং, আপনারা যান, আইন ও বিধির ফাঁকে যতো আসে ফরমান, অস্বীকার করি তারে, আমি যে রচনা করি আমার বিধান, বহুকাল দেখি না দরবেশ, আউলিয়া, দেওয়ানা মাস্তানা, কল্লোল মুখরিত আখড়ার খোঁজ পেলে জানান আমায়; চলে যাবো মাস্তানার সাথে শহর কুতুব হয়ে, রজোবীজে নক্ষত্রের বৈশিষ্ট্যও জানি;
আমাদের জন্য আছে ছায়ার শরীর, উৎক্রমণ উন্নাসিক আমি,
আলম মন্ডলে যতো জগৎ, আমি তো আশ্রিত নই, তার নিয়ামৎ
তা-ই জপনাম, ডাক নাম, কত নামে ডাকি তারে, তবুও ভুলি না আসল
নামের বরকতে আমি শুধু পথ চলি, আর পরম ও প্রকৃতি মিলে
আমারে শিখান তিনি, মনীষার সাথে প্রেম হবে কী প্রকারে
তখনই ভাবের চিহ্ন, ভাবভোলা হয়ে, আসেন বসেন আমার আদৃত অধরা
অতএব, আমার পৈথানের জম, সিথানে প্রহরারত স্রষ্টার সৈনিক, অপেক্ষায় থাকে, আমি শুধু গান শেষ হলে চলে যাবো, আপনাদের গায়েবী জমানায়, ঘর ও বাহির আমি দু’ই রেখে যাই, জহির! আপনারই জিম্মায়, আমি কিছু ফেলে যাই না, সব অনাদি আত্মস্থকৃত অবিনাশী ধারাবাহিকতায়, এবার অধরা এলে, বলে দিন তারে, সহস্র বারাম আছে দুনিয়ার দুখি মানুষের কাছে।
১০।
এতো কাঁদি, ক্রন্দন উতরোল এই তো সময়, জাহেরি-বাতেনি স্রোতে যতো জল নদী হয়
ওজু ও গোসলের ভিড়ে, পূণ্যস্নানে সমাগত সলিল-প্রার্থনার স্রোতস্বিনী ক্রন্দনের এই কল্লোলে
আমি টুপ করে ডুব দিয়ে আসি, মা আমার বসে আছেন মাখানো ভাতের থালা হাতে, রসুইক্ষেত্রে
তা-ই, আশাসিন্ধু পাড়ে মাতা, বেদনার সুরলতা গাঁথেন নিরলে, তার অশ্রু অবিরল, ভেতরে কতোটা জল আমি তো জানি না, প্রস্রবণে জলভান্ডার প্রকরণে ঝরে, তা-ই বলি ঝর্ণা, লিখেছি যতোটা কালাম ঝর্ণা কলমে, তার দ্যুতি গোটা গোটা অক্ষরের বিভূতির মাঝে নাই, সে-ও জল, জমজ দিগন্তের শ্যাম নিবেদিত রঙ, আমাকে বেগানা করে, আমি যদি রাধা খুঁজি, আমি তার শ্যাম সপ্তবর্ণ।
এতো জল, তবু তার অতল আমারই, চিরচেনা চিহ্নসকল, শরীরে খচিত ধ্যান
এই জলে বিদ্যাসাগরীয় সাঁতার, এই জল মধুসূদন পান, এই খানে মাতাল
ভাগ ও বিভাজন খানখান, এইখানে সহজ আমি, জানি বীজ ফসল উন্মুখ
জানি তার সহজাত রুকু ও সেজদার শেষে একমাত্রে বীজ়ে আছে প্রাণ
সে-কারণে, যদি বলি প্রত্যাবর্তনের আকাঙ্খা কেবল বীজেই নিহিত, যদি বল, ফসলের শুশ্রূষায় কেটে যাক জীবন, তবে আমি রবুবিয়াতের রাজনীতি করি। আকাশে কী রঙ দেখি না, রঙিলা মনের মাঝে রঙ্গনের বিভূতি খুঁজি, আমি রক্তে রঙ দেখেছি, দেখেছেন একাত্তরে যেমন করে রঙ ফরহাদ মজহার।
এতো রঙ, এতো পিছকি, রঙ খেলা চলছে অবিরাম
১১।
সজল প্রার্থনায় আমি এক কাঙাল, বস্তুর ধরম আমার আদরের অধরার দেহধামে
আমি আছি লীলাব্রতে, ঘরের ছাউনি দেবো আকাশের অন্য কোন উদ্যানে এই শণ
জন্মায় না। কোদাল কোদাল মাটি, আমি যতো খাটি, মেহনতে মরুবুকে কুমড়ার জনম
অতএব, সোয়াদে-স্বাদে, প্রস্বেদন আর আস্বাদনে, আমার জিহ্বার মত লকলকে লাউয়ের ডগায় মাথা তুলে বসে আছে মাধবী সরীসৃপ।
আমি তার রুপে মুগ্ধ। সে আমার রুপে পাগল, একটিও দেয় নাই ছোবল; তবে আমি তারে বলেছি, চোখের মুগ্ধতার বিষে ভীষণ সবুজ আমি। এই তো অধরা জ্ঞান, স্মৃতির সবল মেধায় এখনও তো চাষবাস করি। কিছুটা শরম পেলে ছোবল দিও।
১২ (আমার নাম সাকিনের আগে, আমার গেরাম চেনার আগে, আমায় চিনে নিও)
হাওয়ার ভেতর হারাই আমি, কোন বিরানে হারাই
গরীব গুর্মা, গজায় পাখা, লাগাই আমি জ্ঞানের নাড়াই
আমি আন্ধা কানা, জ্যোতিহীনা- তবুও ভাবে ভূবন চিনি
আমিই আমার, আমায় নিয়ে যতোই খেলেন ছিনিমিনি
দরশন দিলে, কোথায় লুকাইলে, আমি ভাবে জারা জারা
আরামে ছিলাম আমি অধরার সনে, বারাম বসিলে আধ্মরা
সাধুসঙ্গে সগৌরবে কালাম খুলে তুলকালাম সে খুলে দেখি
ন’ আমি ন’ মানি কালাম বেহেশ্তের লাগি
না গো, নই আমি অস্তিত্ব বিবাগি ।
।
১৩।
ঢুলু চোখের ভোলা মনতো নই আমি, ফুসফুসে নেই ভরা মেঘের চৈতি বায়ূ
সাধুসঙ্গ সালংকরা, বয়ানে বিধৃত ধারা, নামের গুণে নাচন-কুদন আর করি না
সকল নামের দিল সুষমা, ফোটাই আমি নিজের ভেতর, অপর জগত এই জগতে বচন দিয়ে রচন করি
গুরু আমার নন বাতেনি, জাহের তিনি আমার সাথে
না ফুটিলে তেমন ফুলের বাগান বিলাস আমার তো নাই
ঢুলু চোখের ভোলা মনতো নই আমি, আমি কঠোর মেহনতি চাষী
যা ফলাই এই জমিন পরে, জমির ফসল রাশি রাশি
১৪।
চোখে যখন জলপ্রপাত হয় এবাদতে; কালাম কী আর থাকে আমার বাইরে ওগো বাদশা আলামিন;
দহনস্নিগ্ধ খইয়ের মতো ফুটে আছি, কিংবা জুঁই-জোছনায়, আমি মহাজনের মহাযোগে পাগল
ওগো চাঁদনি প্রেমে পাগল আমি, সুরুজ চিনি না, আমি সকল গন্ডগোল- দেহের ভেতর দিনরজনী ভেংগুলের বাসা
কামড়ায় আর ভনভনায়। আগুন দিলে ছড়িয়ে পড়ে, পরম মরম দৌড় পাড়ে ঐ, ফের ফিরে যায় জীবজীবনের কাছে
নাচেন যখন গৌরাঙ্গ, আমি কোন ছার করে বঙ্গীয় কেবল করি সব ছারখার;
লেপিয়া-পুছিয়া উঠান, যেন উদাস উদ্যান আমার
আপনার ভাবের বাহার, আহা! কী তার রূপ, আপনি পড়িয়া আছেন দ্যুতিহার, নক্ষত্র বিফল এই আলোক কান্নায়
ভাঙিয়া পড়ে।
জপে যখন হৃদয় –রোদন, আমার নদী থাকে গোপন
ইচ্ছাপত্রে লিখে রাখি, আমি তোমায় ভালোবাসি
ফুটলে আমি ফুল হয়ে যাই
মেঘের রক্তে সিক্ত আমি, খুন রঙে আজ রঙিন জীবন
পাতায় পাতায় পত্র লিখি, আপনি যদি আসেন জীবন। ।
১৫।
বাঁশের বাঁশি বানাই আমি, পাতার বাঁশি হাওয়া
আমার ঘর যে শণে ছাওয়া, নোনা জলে শরীর খাওয়া
তবুও আমি ঘর ছাড়ি না, নিজের তরী নিজে চালাই
মাঝি আমি রক্তমাংসে, রজোবীজে কাদায়-জলে মাখামাখি আমার শরীর
যেমন আমি আতুর ঘরে নিজের জন্মে নিজেই খুশি, লহু জলে মাখামাখি
এতো কষ্টের পরেও আমার মায়ের মুখে আভা অরুণ
সাধন যখন করি আমি, করি জগত ক্যোরিওগ্রাফি, ক্যাটয়াকে
সাধক যখন হই যে আমি, জ্ঞানের সাথে খেলি আমি
পরম ও প্রকৃতি মিলে কী প্রক্রিয়ায় দাস্যভাবে দাস স্বভাব যে ঝেড়ে ফেলি
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।