আজ শবেকদর। আবার রমজান পাব কি পাব না আল্লাহ মাবুদই জানেন। ১ আগস্ট ময়মনসিংহ জেলা কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের ইফতার মাহফিলে শরিক হয়েছিলাম। যেভাবেই বলি আমরা এখনো ধীরস্থির শান্তভাবে খাবার খেতে শিখিনি। অনেক ভদ্র সমাজেও খাবার নিয়ে কাড়াকাড়ি দেখি।
সে ক্ষেত্রে বরং গ্রামেগঞ্জে কোনো কোনো জায়গায় বড় বড় দাওয়াত বেশ নিষ্ঠার সঙ্গে হয়। তবে অনেকেই যখন বলেন তার বাবার খরচে ৫০-৬০টি গরু খাওয়ায়েছেন, লোক খেয়েছে ২৫-৩০ হাজার। ব্যাপারটা খুব একটা বাস্তবোচিত মনে হয় না। সারা জীবন কতবার কত গাছের নিচে, গরিবের ভাঙা কুটিরে, বড় বড় অতিথিশালায় খাবার খেলাম_ অনেক জায়গায়ই শৃঙ্খলার অভাব দেখেছি। রাষ্ট্রীয় দাওয়াতও তার ব্যতিক্রম নয়।
এবার ঢাকায় বেশ কয়েকটি ইফতার মাহফিলে শরিক হয়েছি। তার মধ্যে বিএনপি, খেলাফত আন্দোলন এবং বিকল্প ধারা। খেলাফত আন্দোলন এবং বিকল্প ধারার ইফতার মাহফিল খুবই সুশৃঙ্খল ছিল। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির ইফতার ছিল বিশৃঙ্খল। দাওয়াত করা সুনির্দিষ্ট ব্যক্তি ও দলকেও তারা বসতে এবং ইফতার দিতে পারেনি।
দলীয় লোকরাই সব আসন দখল করে বসেছিল। পাঁচ সিটি করপোরেশনে বিপুল বিজয় তাদের অমনটা করেছিল কিনা তা বলতে পারব না। অন্যদিকে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের মির্জাপুরের ইফতার মাহফিলে শরিক হতে পারিনি কারণ সেদিন বিকল্প ধারার ইফতার ছিল। কেবলই একসঙ্গে চলার একটা চেষ্টা নিয়েছি, সেখানে তাদের ইফতারে না গিয়ে নিজের দলীয় ইফতারে গেলে জিনিসটা কেমন হয়, তাই মির্জাপুরে যাইনি। টাঙ্গাইল, কালিহাতী, সখিপুর, ময়মনসিংহ, হালুয়াঘাট, মুক্তাগাছা, বাসাইলের দলীয় ইফতারে অংশ নিয়েছিলাম।
তাতে সবচেয়ে শৃঙ্খল দেখেছি সখিপুর, বাসাইল, তারপর ময়মনসিংহ। তবে সাধারণ খাবার খাওয়ার চেয়ে মাহে রমজানের ইফতারি যে সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। ইফতারির রহমত বরকত সম্পূর্ণই আলাদা। অন্য সময় খাবার দিলেই খাওয়া যায় কিন্তু ইফতারিতে সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হয় আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। ভীষণ কষ্ট লাগে, হৃদয় খান খান হয়ে যায় যখন দেখি ইফতারিকেও খাবার হিসেবে বিবেচনা করে আল্লাহর নৈকট্য পেতে রোজাদাররা অনেকে শান্ত থাকে না, ধৈর্য আর সহিষ্ণুতার অভাব ঘটায়।
বয়সের কারণে কত রকম রাজনৈতিক নকশা দেখলাম। নকশার আর যেন শেষ নেই। প্রথম বিএনপি সরকার সরাতে জামায়াতের সঙ্গে গলায় গলা মিলিয়ে জননেত্রী রাস্তায় নেমেছিলেন। আমি তখন আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির এক নম্বর সদস্য। যেদিন নিজামীর সঙ্গে প্রেস কনফারেন্স করেন, সেদিন সবাই আপত্তি করেছিলাম।
কিন্তু খালেদা জিয়াকে হটিয়ে ক্ষমতায় আসতে জননেত্রী শেখ হাসিনা জামায়াতের সঙ্গে আন্দোলন করতে সেদিন পিছপা হননি। যে যাই বলুন, এখন পর্যন্ত তিনিই শ্রেষ্ঠ কৌশলী। যে স্বৈরাচার এরশাদকে আন্দোলন করে আওয়ামী লীগ হটিয়েছিল, তাকে সঙ্গে নিয়ে এবার ক্ষমতায় এসেছিল। আগেরবার স্বৈরাচার-রাজাকার উভয়কে পাশে নিয়ে বেগম খালেদা জিয়াকে সরিয়েছিলেন। এবার ক্ষমতায় এসে স্বৈরাচার সঙ্গে নিয়ে রাজাকার ফাঁসি দেওয়ার নকশা করছেন।
১ আগস্ট হাইকোর্ট রায় দিয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ। সঙ্গে সঙ্গে সুপ্রিমকোর্টে আপিল। চলবে দু'চার বছর। তাই বউকে ভয় দেখাতে গোদা পায়ে লাথির মতো। এক মন্ত্রী বলছেন, জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ, আরেকজন বলছেন তারা রাজনীতি করতে পারবেন কিন্তু ভোটে দাঁড়াতে পারবেন না।
ভাবখানা এই যে, নামাজ পড়তে পারবেন কিন্তু অজু করতে পারবেন না। তারা মনে করে এসব চালাকি জনগণ বোঝে না। দেশের মানুষ এখন সবই বোঝে। রাস্তাঘাটে বলাবলি হচ্ছে এখনই যদি জামায়াত আওয়ামী লীগের সঙ্গে হাত মিলায় মামলা-মোকদ্দমা-নিষেধাজ্ঞা কিছুই থাকবে না। না হলে একাত্তরে পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে থাকা পাকিস্তানি সিএসপি মহীউদ্দীন খান আলমগীর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকেন কি করে? ইয়াহিয়া, টিক্কা বেঁচে থাকলে তাদেরও গদিতে বসাতে দ্বিধা করত না।
এদের কাছে ন্যায়নীতি বড় কথা নয়, এদের কাছে বড় কথা ক্ষমতা। সেদিন প্রকাশ্যে শত শত মানুষের সামনে গুলশান-২ নম্বরে ক্যামেরায় শুটিংয়ের মতো যুবলীগের এক নেতা আরেক নেতাকে হত্যা করেছে। যুবলীগের বর্তমান সভাপতি শেখ পরিবারের সন্তান সেদিন বলেছেন, যুবলীগের এই সদস্যরা যে এত খারাপ তা তিনি জানতেন না। জানবেন কি করে? ডুব দিয়ে পানি খেলে কে জানবে, জেগে ঘুমালে তাকে জাগাবে কে? মহাজোট সরকারের পতনের বারোআনা কারণই যুবলীগ-ছাত্রলীগ। তাও তারা বুঝতে পারেন না।
আস্তে আস্তে বুঝবেন ক্ষমতা হাতছাড়া হলে। আমি মিল্কি হত্যা নিয়ে বলছি না। হত্যাকারীরা হত্যা করবে এটাই তাদের কাজ। কিন্তু জনবহুল এয়ারপোর্ট রোডে আসামি নিয়ে যাওয়ার পথে আক্রান্ত হয়ে যদি আসামি মরে তাহলে বলব র্যাব কোনো আধুনিক বাহিনী নয় অথবা ওটা একটা পাতানো খেলা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে র্যাবের কর্মকাণ্ডে মানুষ যেমন আশান্বিত হয়েছে, দুই হাত তুলে আল্লাহর দরবারে দোয়া করেছে।
এসব অপরিকল্পিত কাজের জন্য তেমনি বাহিনীগতভাবে র্যাব সমালোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে এবং তাদের লিমনের ওপর গুলি চালনায় যে বদনাম হয়েছিল, এয়ারপোর্ট রোডে আক্রান্ত হয়ে আসামি নিহত হওয়ায় তারচেয়ে দশগুণ বেশি বদনাম হয়েছে। সাধারণ সহজ-সরল মানুষ মনে করছে আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ করলে অনেক থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়বে। তাই বড় কিছু চাপা দিতে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে হত্যা কোনো ভালো কাজ নয়। প্রতিটি হত্যায় আল্লাহর আরশ কেঁপে ওঠে।
যারা এর সঙ্গে জড়িত আখেরাতে নয়, দুনিয়াতেই বেশির ভাগ লোককে শাস্তি ভোগ করতে হয়। বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যা করে মোহাম্মদী বেগ, মিরনরা বাঁচেনি। বিশ্বাসঘাতকতা করে মীরজাফর কুষ্ঠরোগে মরেছে। ভাগীরথীর ভগবান গোলায় নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে সপরিবারে ধরিয়ে দিয়ে মীর কাশেম পুরস্কৃত হয়েছিল। কিন্তু বিহারের উদয়নালার যুদ্ধে পরাজিত হয়ে উত্তর প্রদেশের রহিলাখণ্ডে ফকিরের বেশে ঘুরেফিরে জীবন দিয়েছে।
মহাত্দা গান্ধীকে হত্যা করে নাথুরাম গডসে ভালো থাকেনি। প্রকাশ্য জনসভায় কায়েদে মিল্লাত লিয়াকত আলীকে যারা হত্যা করেছিল তাদের দিন শুভ হয়নি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে যারা দাপট দেখিয়েছিল তাদের পরিণতি সবার জানা। জিয়াউর রহমান বীরউত্তমকে যারা হত্যা করেছে হত্যার সময়ই জেনারেল মঞ্জুরের মতো একজন মেধাবী বীর মুক্তিযোদ্ধাকে প্রাণ হারাতে হয়েছে। ন্যায় হোক, অন্যায় হোক ১২ জন মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হত্যায় ফাঁসিতে ঝুলেছে।
কর্নেল তাহেরের মতো একজন নিবেদিতপ্রাণ স্বাধীনতা সংগ্রামী অন্যায়ভাবে প্রাণ দিয়েছেন। এসবই হত্যার পরিণতি। জানি রক্ত গরম থাকলে কেউ সুবচন শোনে না। এখন যাদের রক্ত গরম তারাও হয়তো শুনবে না।
মহাজোটের নিদারুণ পতন রুখতে বিদেশে ট্রেনিং নিয়ে সেনাপতি হিসেবে ভাগিনা সজীব ওয়াজেদ জয় মাঠে নেমেছে।
বড় ভাগিনাকে দেখি নাই, ছোট ভাগিনাকে দেখেছি যখন চায়না ক্লে নিয়ে খেলত। তখন বড় সরল সোজা ছিল। বর্ধমানের বাড়িতে যখন ছোট্ট জয় ছিল তখন কতই না ভালো ছিল। এখন বড় জয়, বড় চিন্তা, বড় ভাবনা। সেনাপতি হিসেবে যুদ্ধ পরিচালনায় সে কতটা সার্থক হবে তা প্রথম অভিযানেই বোঝা গেছে।
তার কাছে খবর আছে প্রচার করে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হয়েছে। আর ক্ষমতাসীন দলের খবর সব সময় অনুকূলেই থাকে। আতাউর রহমান খানের লেখায় দেখেছি, যুক্তফ্রন্ট সরকারের পূর্ববাংলার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে এক উপনির্বাচনে রংপুরে গিয়েছিলেন। সার্কিট হাউসে ডিআইবি ইন্সপেক্টরকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, নির্বাচনে আমাদের অবস্থা কি? তিনি বলেছিলেন, খুব ভালো। জয় সুনিশ্চিত।
এরপরও ইন্সপেক্টর যাচ্ছিলেন না। এদিক ওদিক ঘুরাফেরা করছিলেন, হাত কচলাচ্ছিলেন। বেশ কিছুক্ষণ পর আতাউর রহমান খান ইন্সপেক্টরকে বলেছিলেন, এই তুমি অমন করছ কেন? আমি তো তোমার কথা বুঝেছি। গতকাল কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা এসেছিলেন, তাদেরও ওই একই কথা বলেছ_ এই তো? ইন্সপেক্টর একটা গোয়ামুড়ি হাসি দিয়ে বলেছিল, হ্যাঁ স্যার, তাদেরও বলেছি, ফিল্ড খুব ভালো। জয়ের সম্ভাবনা ১০০ ভাগ।
জনাব আতাউর রহমান খান ছিলেন একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ। কেউ হাঁ করলে হামিদপুর বুঝতে পারতেন। কিন্তু এখন মামা-ভাগিনারা বুঝবেন কেন? যেভাবে প্রিয় ভাগিনা খেতে-বসতে-উঠতে নানার মতো আঙ্গুল তোলেন ব্যাপারটা বেশি ভালো না। নানা আঙ্গুল তুলেছেন বহু বছর, বহু কষ্ট করে। ঝড়-বৃষ্টি-রোদ উপেক্ষা করে।
তেঁতুলিয়া থেকে একবার হেঁটে টেকনাফ আরেকবার সিলেটের করিমগঞ্জ থেকে যশোর-খুলনা-বেনাপোল, সেখান থেকে আমার বাড়ি এসে আঙ্গুল তুললেও না হয় কিছু একটা মনে করা যেত। ওভাবে এ্যাঙ উদে ব্যাঙ উদে, খলিসা কয় আমিও উদি-জিনিসটা খুব একটা ভালো না। শুধু আঙ্গুল তুললেই মানুষ আঙ্গুলের ইশারায় চলে না। ওই আঙ্গুলে দরদ থাকতে হয়, থাকতে হয় ভালোবাসা, দৃঢ়তা ও বিশ্বাস। ভাগিনা আমেরিকায় থাকে, তার মন পড়ে থাকে রংপুরে।
বাপের দেশ, পাঁচজন মানুষকে চিনে না, সেই মানুষকে এমন প্রতিশ্রুতি দিলে শুনবে কেন? আমরা তো যেখানে জন্মেছি সেখানে ৫০ হাত নিচে কেমন মাটি, বালি না পাথর, কালো না লাল_ তার খবর জানি এবং রাখার চেষ্টা করি। শুধু মন পড়ে থাকলেই দুঃখী মানুষের কোনো কাজ হয় না। মঙ্গা রংপুর থেকে চলে গেছে এটা সত্য নয়। দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়ে এবার যে বন্যা হয়েছে ওই অঞ্চলের মানুষ কোনো দিন এমন বিপর্যয়ে পড়েনি। সেখানে সরকার কি সাহায্য করেছে? তাই নতুন সেনাপতির ভোঁতা অস্ত্র বীর বাঙালির ওপর তেমন প্রভাব ফেলবে না।
৩ আগস্ট শরীয়তপুর যাওয়ার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন হেমায়েত উল্যাহ আওরঙ্গ। দোষে-গুণে মানুষের মধ্যেও সে একজন। আমার বিপক্ষে কত নেতা-নেত্রী আওরঙ্গকে দিয়ে কত কিছু করিয়েছে কিন্তু ওয়ান-ইলেভেনের সময় ওকে যখন গ্রেফতার করে আমি ছুটে গিয়েছিলাম বেগম খালেদা জিয়ার কাছে। তিনি যথেষ্ট সম্মান দেখিয়েছিলেন। একজন জাতীয় সংসদ সদস্যকে যে ওভাবে গ্রেফতার করা যায় না, অপমান-অপদস্থ করলে সেটা তারই অপমান হয় তা তিনি সেদিন উপলব্ধি করেছিলেন।
মানুষ মরণশীল, সবাই মরবে। কিন্তু এভাবে আকস্মিক দুর্ঘটনায় কেউ হারিয়ে গেলে বুকে বড় বাধে। তাই তার আকস্মিক চলে যাওয়ায় খুবই মর্মাহত হয়েছি। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন ওকে ক্ষমা করে বেহেশতবাসী করেন। আর তার পরিবার-পরিজনের এই শোক সইবার শক্তি দান করেন।
পবিত্র মাহে রমজানের শেষ। আসছে ঈদ। সবাইকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে ঈদ মোবারক জানাচ্ছি। আবার রমজান পাব কি পাব না, আবার ঈদুল ফিতরে শরিক হতে পারব কিনা কেউ জানি না। তাই পরম দয়াময় প্রভুর কাছে প্রার্থনা, তিনি যেন দেশবাসীকে হেফাজত করেন_ আমিন।
লেখক : রাজনীতিক।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।