পুরনো আমিটাই ভাল ছিলাম...
থেমে থাকা শীতার্ত প্রহরে গুটিসুটি মেরে বসে থাকি। তুষের আগুনে পোহানো অতীত বুক পকেটে পুরে রাখি সযতনে। যেটুকু উষ্ণতা দেয় তাতেই হয়তো বেঁচে থাকি জীর্ণ লোকাল বাসের অনিচ্ছায় যাপিত জীবনের মতো ধুকতে ধুকতে। শহরের বুকে নড়বড়ে প্রথম পদক্ষেপের সময়টা খুব বেশি দূরের মনে হয় না। তবুও ক্রমশ ঘনিয়ে ওঠা শীতে নিজেকে হাড় জিরজিরে বুড়োদের মতো মনে হতে থাকে।
অনিশ্চয়তা আর হতাশার বলিরেখা দুশ্চিন্তার ছবি আঁকে প্রতিদিন। এ শহরের প্রতিদিনকার পরিবর্তনের ইতিহাস খুটে খুটে আঙ্গুলের নখে ভাঙ্গনের সমারোহ। প্রথম পদক্ষেপের সেই কিশোর হৃদয় অন্ধকারের ছোবলে ক্ষতবিক্ষত বিকৃত হয়ে উঠেছে দিনে দিনে। সবুজখেকো দৃষ্টিতে শহুরে জড়াগ্রস্ত প্রতিফলনের আঘাত। চোখের সাদায়, ঝুলে থাকা তারের জঞ্জালের মতো পোড়ামাটির রেখাচিত্র।
একদিন যে চোখ ছিল আলোক বিচ্ছুরণি স্বপ্ন-কারখানা, যে চোখের দৃষ্টি, ক্যানভাসে মুগ্ধতার তুলি দিয়ে এঁকে যেত ক্লান্তিহীন চিত্রকরের তৃষিত দৃশ্যকাব্য, সেখানে এখন দৃষ্টিখেকো নৈরাজ্যের আস্ফালন। টলটলে ভেজা চোখে রাসায়নিক ধূম্রকনা তীরন্দাজের আগুনমুখো তীরের মতো বিঁধে চলে প্রতিদিন। ভাজা চোখের নিউরণ স্নায়ুতন্ত্রের জঠরে নিষ্প্রাণ সেঁটে থাকে। ফেরারি নম্র আলো উদ্দীপনার অনুঘটক যোগাবে হয়তো একদিন। খুব কাছেই বাধা পেয়ে ফিরে আসে দৃষ্টি।
পোড়া মাটি আর ইস্পাতের দানবের আড়ালে চেনা শৈশবের আলো এসে ঘুরে যায় প্রতিদিন। দরজায় কড়া নেড়ে সাড়া পায় না, ধূসর অতীতের গল্প। উপরের আকাশটা ছোট হতে হতে কুয়োর ছাদ হয়ে গেছে। তলায় বসে যেটুকু আলো আজলা করে ধরি তারও অনেক খানি কেটে নিয়েছে প্রহরখেকো ইঁদুর। এখন স্বপ্ন-হরিণ ছোটে মরিচীকার পিছু।
আর আমি ছুটি অন্ধকারের চোখে ঠুলি পড়াব বলে। ঘণীভূত কুয়াশার সাথে অন্ধকারের সখ্যতা বাড়ছে দিনে দিনে। জড়া আর ক্ষুধার আক্রমণে বিধ্বস্ত পথিক অন্ধকারের কাছে জমা রেখেছি নৈতিকতা। কুয়াশার ছাতা ফুটিয়ে আড়ালে বুনে চলেছি অন্ধকারের বীজ। ভ্রুণের জ্বীনে প্রচ্ছন্ন আলো ঘুমিয়ে থাকে বিস্ফোরণ সময়ের অপেক্ষায়।
শহরের অশরীরি ধূসর আলোয় নেয়ে নেয়ে জোৎস্নার রং ভুলে গেছি। ল্যাম্পোস্টের ভিনদেশি আলোয় ফুটপাতের ফ্যাকাসে ঘাসফুল, মুখ গোমরা করে বসে থাকে। ফিঙ্গেরা ওভার টাইম খাটে একদিন স্বপ্ন জমিয়ে এক কৌটো সোনালী আলো কিনবে বলে। শীতের সকালে জবুথবু কাক আড়মোড়া ভাঙ্গে, কুয়াশা ছিদ্র করে ডাস্টবিনের ডাবের খোসার জলে চক্ষু ভেজাবে বলে। উঁচু ছাদের আকাশমুখী লোহায় ছেঁড়া ঘুরি স্বাধীনতার কঙ্কাল হয়ে ঝুলে থাকে।
পাখি হৃদয়ে একটু একটু করে বুনে চলেছি নির্লিপ্ততার বাবুই নীড়। হাসির আলোতে কুয়াশার মুখোশ পড়িয়ে দিয়েছে অন্ধকার। স্নেহ, মায়া, মমতা, দুঃখ, কষ্ট, মান অভিমান কিছুই আর টানে না আগের মতো। অনুভূতিগুলো রুক্ষ হয়ে গেছে শীতার্ত সময়কে কান্নার বাষ্প ধার দিয়ে দিয়ে।
এখন আর রাতের আকাশে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে থাকা হয় না।
জানালার ফাঁক গলে জোৎস্নার গাল ছুঁয়ে দেয়া হয় না। এলসিডি জানালায় চেয়ে থাকি ফাইবার আলোয় ভেসে আসা বাইনারি স্বপ্ন-কথার অপেক্ষায়। মানবিক দুঃখ, কষ্ট, ক্লেদ চাপা দিয়ে রাখি পাঁজরের আলিঙ্গনে। কিবোর্ডে আঙ্গুলের স্পর্শ, দৃষ্টি আর ভাবনার খেলাধুলা। অচেনা বন্ধুত্ব, স্নেহ আর বিশ্বাসের ঝুলন্ত সম্পর্কের দোলাচাল; মান-অভিমান, ভুল বোঝাবুঝি।
জানালার দুই পাশে দুইজন অথবা আরো অনেকেই। কখনো কথার দোকানদারি। আবার কখনো নিদারুণ অনাবৃষ্টি। নির্লিপ্ত মৌনতার বিপরীতে নতুন সময়ের জানালায় প্রতিদিন জমা হয় নতুন নতুন ক্যানভাস। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে কথার লেনদেন।
কখনো মন ভাল করা বর্ষামাদল। কদম ফুলের মতো খুলে খুলে ঝরে পড়ে কবিতার ছন্দের মতো কথামালা। সময় ভুলে চলতে থাকে অনুভূতির বিকিকিনি। অনেক কঠিন কথাও হালকা হয়ে যায় ভাল লাগার মুহূর্তগুলোতে। আবার কখনো একটা শব্দ সহসা অনেক শব্দের পথ আগলে দাঁড়ায়; রাগ অথবা ভুল বোঝাবোঝি।
বুঝতে না চাওয়া অথবা বুঝতে না দেওয়া। ইচ্ছে করেই রাগিয়ে দেওয়া। অথবা ইচ্ছে করেই দেয়াল তুলে রাখা। কখনো সময়ের ব্যবধানে রাত হয়ে যায় দিন আবার দিন হয়ে যায় রাত। জেগে জেগে হেসে কেঁদে কথায় কথায় ভরে ওঠে সাদা যান্ত্রিক ক্যানভাস।
আবার কখনো অপেক্ষার প্রহরগুলো খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করে দেয় অচেনা উদ্বেগে অস্থির হয়ে থাকা নির্বোধ হৃদয়কে। কোথাও কেটে রক্ত ঝরছে নিঃশব্দে প্রতিদিন। অন্যপাশে জানালায় ভেসে ওঠা নির্লিপ্ত খেয়ালি কথাগুলো বিঁধে থাকে কন্ঠনালীতে। চাইলেও বলা যায় না অনেক কিছুই। আবার না চাইতেই শোনা হয়ে যায় যা কখনো অন্য কাউকে বলা হয়নি কোন দিন।
কখনো খুব বেশি বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে। আবার একটুতেই বিশ্বাসে ফাঁটল ধরে। নিজের মতো করে ভেবে নিয়ে ঘৃণার চাষবাস করে কেউ কেউ। একসময় ভুল বুঝতে পেরে মুছে দিতে চায় পুরনো গল্প। মুছে দেওয়ার পরেও কিছু কিছু দাগ জেগে থাকে অদৃশ্য হয়ে।
মনে করতে না চাইলেও হয়তো মনে পড়ে যায় কখনো কখনো। আমি, তুমি, তুই সিঁড়ির ধাপে ধাপে ছড়ানো ছিটানো স্নেহ, মায়া, আগ্রহ, উদ্বেগ, শুভকামনা, ভালবাসা অথবা বিরক্তি, ঘৃণা, এড়িয়ে চলা। কখনো অভিমানে রাগ হয় খুব। নিজেকে বোঝানো যায় না অথবা বোঝে না অন্য কেউ। ইচ্ছে করেই দূরে সরে থাকা, ইচ্ছে করেই কষ্ট বাড়িয়ে তোলা।
তবুও এক সময় নির্মোহ শিরোনামহীন টানে কাছে আসে অভিমানী হৃদয়। অচেনা নাদেখা কারোর একটু আড়াল হওয়ায় উদ্বেগে আর্দ্রতা জমে চোখের কোণে। ডুবে থাকতে ইচ্ছে করে কখনো কখনো। পারা যায় না শেষাবধি। বার বার ফিরে ফিরে আসি কোন এক অজানা টানে।
অচেনার মাঝে খুঁজে ফিরি কোন এক খুব চেনা হৃদয়ের উষ্ণতা। কৃত্রিম ভাল লাগায় ভরে থাকে চারপাশ। দূরে তবু কাছেই হয়তো। হাত বাড়ালেই ছুঁয়ে দিতে পারি ইমোটিকন অনুভূতি। তবুও বার বার থেমে যেতে হয়।
বার বারই মনে পড়ে একটা খুব চেনা আচলের উষ্ণতা। খুব চেনা বকুনি। খুব চেনা আদর মাখামাখি। খুব চেনা সবুজের হাতছানি।
প্রতিদিন জেগে উঠি যন্ত্রের সাথে যান্ত্রিক শহরে।
কড়া নেড়ে ফিরে যাওয়া অতীত, অবহেলা পেয়ে অভিমানে দূরে সরে যায় প্রতিদিন একটু একটু করে। আধো ঘুমে বসে থাকি কৃত্রিম জানালার পাশে। কিসের অপেক্ষায় জানি না। অনন্তকাল হয়তো বসেই থাকবো এইভাবে এই জানালায়। জানালার ফাঁক গলে চাঁদ আর কোনদিন আলো ছড়াবে না।
কোন দিন আর দেখব না মেঠোপথে উচ্ছ্বল কিশোরীর ভেংচি কাটা হাসি। জানালার ফাঁকে কেউ ছুঁড়ে দেবে না সকালের স্নিগ্ধ বকুল। দগ্ধ চোখ আর কোন দিন হয়তো ভিজে উঠবে না ভাল লাগার মুহূর্তে। তবুও বেঁচে থাকি, জেগে থাকি। খুব সঙ্গোপনে কোথাও মিটমিট করে জ্বলে একটা স্বপ্ন-পিলসুজ।
ধূসর শহরের যান্ত্রিক ভাবনার ভীরে ঘুরে বেড়ায় হারিয়ে যাওয়া ছেলেবেলার স্মৃতি। নির্লিপ্ত নাগরিক জীবনের অবসরে প্রতিদিন লালন করে চলেছি বোবা শৈশব। সেই চাঁদ, সেই আলো, সেই খেয়া, সেই নদী, কাদা, মাটি, জল, সবুজের হাসি ভালবাসি ভালবাসি।
উৎসর্গ: ভুল বুঝে রেগে যাওয়া একজন মানুষ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।