আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আলেয়ার সংসার



এক· জলিল ভূঁইয়ার গল্প করি। নামে ভূঁইয়া, কামে শুইয়া। মানে বংশপদবি ভূঁইয়া হলেও টাকা-পয়সাহীন! অথচ তাঁরই ঘরে, বোধ করি স্রেফ ভূঁইয়া বংশ-পদবির কারণেই একখান ঘর-আলো-করা বউ জুটে গিয়েছিলো- নাম আলেয়া। আলেয়ার আলোয় মোটামুটি ভালোয় ভালোয় কাটছিলো ‘নামে ভূঁইয়া, কামে শুইয়া’ জলিলের জীবন। আর কিছু না থাকুক, রূপসী বউয়ের মুখ, রাজা-বাদশাহর শাহী সুখ এনে দিয়েছিল তাঁর জীবনে।

মনে-প্রাণে কেউ সুখী হতে চাইলে খুব বেশি কিছুর দরকারও নেই। আর এরকম পরীর-লাহান বউ পেলে তো কোনো কথাই নেই! পৈত্রিক কৃষি-জমিগুলোর আইল একবারের জন্যও মাড়ায় না, তবুও ভূতে জোগায় অন্তত ছ’মাসের রিজিক। আর ঘরের আশপাশের মাটিও এমন উর্বর যে ভাত পড়লে ধান হয়! ফল-মূল লতা-পাতা তরি-তরকারির এঁটো-কাঁটা উচ্ছিষ্টাংশ পড়ে সেখানে কোনো না কোনো শাক-সবজি পুঁই-লাউ-শিম উচ্ছে-টুচ্ছে ইচ্ছেমতো হয়ে থাকে। ওরা নিজেরাই নিজেদের খাইয়ে-পড়িয়ে লক লক করে বেড়ে ওঠে। বাড়তে বাড়তে নিজেরাই উঁকি মেরে ঘরের বেড়ার ফাঁকে এসে গলা বাড়িয়ে ডাকে- এসো ভূঁইয়া, আমাকে খাবে, শুধু হাত বাড়াও, আমাকে পাবে।

জলিলের ছিল চন্ডিদাসী স্বভাব- না, প্রেমের নয়, বড়শিতে মাছ ধরা, ‘বড়ই বাওনের’ স্বভাব। এ স্বভাব তাঁর সুদূর শৈশবের। শিশুকালেই নাকি কইয়া বড়ই দিয়ে (কই মাছ ধরার বড়শি) বিশাল বোয়াল ধরে পাড়া-পড়শি সবার চোখ কপালে তুলে দিয়েছিল! যেখানে চক্কুনি মাছও পাওয়ার সম্ভাবনা নেই, সেখানেও জলিল ‘ঘইট্টা পুরাইয়া’ (ঘটি-ভর্তি) মাছ নিয়া ট্যা-ড্যাং ট্যা-ড্যাং করে বাড়ি ফিরে আসতো। ফলে মাছ বিষয়ে জলিলের কখনোই কোনো ভাবনা-চিন্তার দরকার পড়ে না- চইত-মাইস্যা খরায় যখন মাঠ-শুকিয়ে-মরা মরুভূমি, তখনও বাড়ির আশপাশের ডোবাগুলোর তলানিগুলো শুকায় না; আর এরকম একটি ডোবার তলানিতে যদি একটুখানি ঘোলা জলও থাকে, তবে জলিলের আর ভাবনা নেই। কেবল তাঁর জন্যই সেখানে কোনোরকমে কায়ক্লেশে জান বাঁচিয়ে বেঁচে থাকে আজব বিচিত্র রকমারি লোভনীয় মাছেরা! আলেয়ার জন্য জলিল আর কিছু না করুক, এরকম গামলা গামলা মাছ ধরে এনেছে।

প্রথম প্রথম সুন্দরী বউ, যখন তখন এরকম নানারকম মাছ দেখে মুখে মৌ ঝরিয়ে খোঁচা মেরে বলতো, ‘আপনে মানুষ না জ্বিন-পেত্নি? নাকি উদবিলাই, নাকি ভোদর?’ ‘নাগো বউ, আমি মানু, ক্ষুদ্র মানু, তয় পক্ষী কইতে পারো, তোমার মাইচ্ছারঙ্গি, তোমার কানি-বগা! তোমার জইন্য উইড়া যাই, আর ধুপুস কইরা ধইরা আনি! আল্লায় দেয়, এর বেশি কিছু কী আমি জানি! আল্লায় যদি না দেয়, আমার সাইধ্য কী যে একটা গাইচ্ছামাছও ধরি, আল্লায় যদি না দিতো আমার সাইধ্য কী তোমার লাহান রাইজকইন্যা আমার ঘরে আনি!’ আদর করতে করতে বলতো জলিল। জলিলের কথা বলার গুণে মুগ্ধ আলেয়া। চমৎকার চমৎকার সব গল্প ছিল জলিলের ভাণ্ডারে। অফুরন্ত। বউয়ের আগে তাঁর সেসব রসময় গল্পের রসভোগী ছিল পাড়া-প্রতিবেশী ছেলে-বুড়ো বউ-ঝিরা।

গল্পের জাদুতে ইচ্ছে করলেই সে হাসাতে পারতো, কাঁদাতে পারতো। গল্প শুনে পাড়া-প্রতিবেশীরা এটাকে একটি বিশেষ গুণ হিসেবে ভাবলেও কেউ কোনোদিন ব্যাপারটিকে তাঁর বউয়ের মতো করে দেখেনি। বউ-ই তাঁকে ‘কথার কারিগর’ উপাধিতে ভূষিত করেছিল। বউয়ের এ উপাধি শিল্পীর পাওয়া সোনার মেডেলের মতো আনন্দ-পুলকে পুলকিত করেছে জলিলকে অনেক অনেক বার। তবে একপর্যায়ে তা বউয়ের মুখেই খোঁচা, খোটা, তিরস্কার এবং দুর্বিসহ গালি হয়ে দাঁড়ায়।

সেই পর্যায়ে পৌঁছার আগেই একদিন আলেয়ার দুয়ারে এসে পৌঁছে যান আরেক ভূঁইয়া, নাম হায়দর আলী ভূঁইয়া। জলিল ভূঁইয়াও ভূঁইয়া, হায়দর ভূঁইয়াও ভূঁইয়া, কিন্তু এক বংশপদবি ছাড়া কারো সঙ্গেই কারো মিল নেই। হায়দর ভূঁইয়ার বাড়ি জলিল ভূঁইয়ার বাড়ি থেকে রাস্তা ধরে গেলে প্রায় মাইলখানেক, আর খাল-বিল ঝোপ-জঙ্গলের কোনাইচ্চাপথে আধামাইলেরও কম। হায়দর ভূঁইয়া সত্যিকারের জমিদারের পোলা। প্রথম প্রথম রাস্তা ধরেই আসতেন।

তাঁর বাবা ছিলেন খায়বর আলী ভূঁইয়া, প্রতাপশালী জমিদার। জমিদারি চলে যাওয়ার পর জমিদারদের যা যা থাকে সবই আছে তাঁদের। উঠানের মতো ছাদ-সমেত পাকা দেড়তলা বাড়ি; শান-শওকতের বাহার লাগানো শান-বাঁধানো পুকুর; বাঘ-সিংহের মাথা লাগানো কাছারি- ফাঁকা ভাঙ্গা ঘোড়াহীন ঘোড়াশাল- এরকম আরও অনেক কিছুর সঙ্গে নারী-লোলুপতা। বাঘ যেমন করে শিকারের সন্ধানে মাঝে মাঝে মানুষের আবাসে চলে আসে, তেমনি হয়তো হায়দর ভূঁইয়াও তাঁর বাবার সাবেক প্রজাপল্লীতে প্রজাপতির মতো ডানা মেলে মাঝে মাঝেই রঙ-চঙ-ঢং দেখাতে চলে আসতেন। কখনো সঙ্গে একপাল সঙ্গী-সাথী নিয়ে, কখনো একা একা।

জলিল ভূঁইয়ার বাড়ি ঘেঁষা উত্তরের বিশাল তেপান্তরের প্রান্তরে নেমে অন্তহীন হেঁটে হেঁটে ঘেমে ঘেমে বাড়ি ফিরতেন। এরকমভাবেই একদিন একা একা কর্দমাক্ত পা, ঘর্মাক্ত শরীর আর তৃষ্ণার্ত বুক নিয়ে পানি পানের জন্য পা বাড়িয়েছিলেন পথের পাশের জলিল ভূঁইয়ার কুঁড়েঘরটিতে- কুঁড়েঘরে ঢোকার মুখেই লাল হয়ে উঠলো হায়দর ভূঁইয়ার মুখ। সেখানে আরও লাল হয়ে উঠেছে আরও একটি সোনামুখ। ঘোমটা ছিল কি ছিল না কেউ জানে না। কোনো কথা হয়েছিল কি হয়নি কেউ জানে না।

হায়দর ভূঁইয়া পানি চেয়েছিল কি চায়নি, পেয়েছিল কি পায়নি, বসেছিল কি বসে নি, দাঁড়িয়ে খেয়েছিল না বসে- বা কেমন করে ঘটনা শুরু হয়েছিল তা বিস্তারিত কেউ কখনোই জানতে পারেনি, জানার কথাও নয়। তবে পাড়া-প্রতিবেশী জানতে এবং দেখতে লাগলো, দুই অসম ভূঁইয়ার মধ্যে বিষম বন্ধুত্ব জমে উঠেছে। খুবই দ্রুত একজন আরেকজনের জানের জান প্রাণের প্রাণ হয়ে উঠছেন। প্রায় প্রতিদিনই দু’জনের দীর্ঘ দীর্ঘ আড্ডা চলে। প্রথম দিকে দীর্ঘ দিবস, শেষের দিকে তা দীর্ঘ রজনী।

হায়দরের মতো এত বড় ভূঁইয়ার অযাচিত বন্ধুত্বকে জলিলের মতো এত ছোট ভূঁইয়া কেমন করে অস্বীকার করে? আর জলিল অস্বীকার বা এড়াতে না পারলে কেমন করে পারবে আলেয়া? আলেয়া তাই প্রতিদিনই জিবে জল আসা চমৎকার স্বাদের হালুয়া রেঁধে খাওয়ায় দুই ভূঁইয়াকে। রাঁধে টাকির-পোনা-ভুনা, শোল মাছের চচ্চড়ি; চিংড়ি-ভর্তা বানায় লাল মরিচ বেটে। চাল কুমড়ার মোরব্বা বানায় এক সপ্তাহ শ্রম দিয়ে। আমের দিনে কাঁচা আমের ভর্তা বানায় গরুর দুধ মিশিয়ে। আর সব ভালো খাবারের অটো-দাওয়াত পেয়ে যায় হায়দর ভূঁইয়া।

মাছির মতো এসে হাজির হয়। পাড়ায় কানাঘুঁষো শুরু হয় হয়তো শুরুর দিন থেকেই। কিন্তু কে কাকে কী বলবে? ভূঁইয়ার সঙ্গে ভূঁইয়ার সম্পর্ক হতেই পারে, থাকতেই পারে। জলিল ভূঁইয়ার সুন্দরী বউ আছে বলেই হায়দর ভূঁইয়া এরকম বন্ধুত্ব পাতিয়েছে- এরকম ভাবলেও কতদূরই আর ভাবা যায়! তবে সবইকে, পাড়া-প্রতিবেশী তো বটেই, পুরো কিংকর্তব্যবিমুঢ়পুর থানাকে হতচকিত করে আলেয়া একদিন হায়দর ভূঁইয়ার বাড়ি বেড়াতে চলে যায়। কেউ বলে, জলিল ভূঁইয়াকে বলে গিয়েছে; কেউ বলে, না বলে।

বউ বেড়াতে যায়, যেতেই পারে, আবার ফিরে আসে। কিন্তু জলিল ভূঁইয়ার বউ বেড়াতে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। দুই· তারপর হায়দর ভূঁইয়া আর আলেয়া সাত ছেলে ও দুই মেয়ের গর্বিত জনক-জননী হলেন। তাদের প্রথম সন্তান অবধি জলিল ভূঁইয়া অপেক্ষা করেছিলেন কিনা ঠিক ঠিক কেউ জানে না। কিন্তু প্রায় সবাই জানে, জলিল ভূঁইয়াও খুব বেশি দিন বসে ছিলেন না।

তবে খুব হিসেবি হয়েছিলেন- দেখে-শুনেই একজন প্রায় বামনাকার কদাকার রমণীকে বেছে নিয়েছিলেন সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র হিসেবে। আর নিজে বাকি জীবন ‘মরা মানুষকে গোসল-দাফন-কাফন করানোর’ কাজে মনোনিবেশ করেছিলেন। ঘৃণা ছিল কিনা জানি না, সুন্দরী আলেয়া আর অপরাপর সুন্দরীদের প্রতি আক্ষেপ ছিল আমৃত্যু; আর হায়দর ভূঁইয়া যখন মারা যায়, তখন পাড়ার একমাত্র লোক হিসেবে গোসল করাতে যাওয়ার আগে, পথে ঠাট্টার সম্পর্কে সম্পর্কিত এমন এক পাড়াতো গৃহবধূর সঙ্গে তাঁর দেখা হয় এবং কথাও হয়। তাদের কথোপকথন-এর চুম্বকাংশঃ ঃ ভাই, কই যাও? ঃ যাই, বিদাই দিয়াই (বিদায় দিয়ে আসি), হারামজাদা শত্রু অইলেও তো আমার বউয়ের জামাই! ঃ আহারে ভাই, তুমি যা কও না! ঃ কি কই, আমার বউ নিছে তো কী অইছে, আমি তো আর বউয়ের দাবি ছাড়ি নাই। ঃ অখন কি করবা? ঃ কিয়ারুম, তারে ধুইয়া-ধাইয়া দিয়ামু কবরে, আর বউ যদি লগে আইতো চায়- তাইরে ধুইয়া-ধাইয়া লইয়ামু লগে!’ (কি আর করবো, তাকে ধুয়ে-টুয়ে কবরে দিয়ে আসব, আর বউ যদি সঙ্গে আসতে চায় তাকেও ধুয়ে-টুয়ে সঙ্গে নিয়ে আসবো!) এর বছরখানেক পরে পটল তুলেছিলেন জলিল ভূঁইয়া।

আর আলেয়া তার নয় সন্তান নিয়ে, বলা চলে, আরো অনেক অনেক যুগ দিব্যি বেঁচেছিলেন কিংকর্তব্যবিমূঢ়পুরের সকলের চোখের সামনে!

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।