আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রধানমন্ত্রী ৫১ দিন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ১৪৬ দিন



২০১০ সাল ছিল ভারতকে সবকিছু উজাড় করে দেয়ার বছর। ট্রানজিট, করিডোর, বিদ্রোহ দমনে বাংলাদেশকে সঙ্গী করা, বন্দর ব্যবহারসহ দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে ভারত যা চেয়ে আসছিল তার সবকিছুই পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বয়ং দিল্লি গিয়ে ভারতের এসব প্রত্যাশা পূরণ করে এসেছেন। গত এক বছরে প্রধানমন্ত্রী ভারতসহ ৯টি দেশ সফর করেন। বিদেশের মাটিতে তিনি কাটিয়েছেন ৫১ দিন।

অন্যদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি রেকর্ডসংখ্যক ৩৪ বার বিদেশ সফর করেন। আর এসব সফরে বিভিন্ন দেশে তিনি কাটিয়েছেন ১৪৬ দিন। গত এক বছরে পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে দৃশ্যত বাংলাদেশের কোনো প্রাপ্তি নেই। সরকারের নানা অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ড এবং বিদেশের মাটিতে বিভিন্ন কেলেঙ্কারির কারণে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি কলুষিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের মাধ্যমেই শুরু করেন তার ২০১০ সালের বিদেশ সফর।

১০ থেকে ১৩ জানুয়ারি ১১৯ সদস্যের বিশাল এক বহর নিয়ে তিনি দিল্লি সফর করেন। বছরজুড়েই আলোচনার মূল বিষয় ছিল প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফর। ভারতের প্রত্যাশা পূরণে আর কিছু কি বাকি আছে? কী পেল বাংলাদেশ? আলোচনায় এসব প্রশ্ন এসেছে ঘুরেফিরে। অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে দিল্লি গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। প্রচার করা হচ্ছিল দিল্লি আস্থা ফিরে পেয়েছে ঢাকার ওপর।

তাই ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অমীমাংসিত বিষয়গুলোর সমাধান হবে। কিন্তু বাস্তবে ঘটল তার উল্টোটা। হাসিনা-মনমোহন বৈঠকে একতরফাভাবে দিল্লিকে সব উজাড় করে দিল ঢাকা। দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে ভারত বাংলাদেশের কাছে যা যা চেয়ে আসছিল তার সবকিছুই দিয়ে এলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভারতের প্রস্তাব অনুযায়ী সন্ত্রাস দমন চুক্তি সই হয়েছে।

এই চুক্তি সইয়ের মাধ্যমে সেভেন সিস্টারের বিদ্রোহ দমনে বাংলাদেশকে সহযোগী শক্তি হিসেবে পেয়েছে ভারত। দু’দেশের গোয়েন্দাদের সমন্বয়ে গঠিত বিশেষ কমিটি এক্ষেত্রে কাজ করছে এখন। গত এক বছরে প্রায় অর্ধশত উলফা নেতাকে ভারতের হাতে তুলে দিয়েছে বাংলাদেশ। স্বাধীনতার পর থেকে ট্রানজিটের জন্য মরিয়া ছিল ভারত। ভারতের সেই দাবিটিও পূরণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী।

চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার, আশুগঞ্জ বন্দরকে পোর্ট অব কল হিসেবে ব্যবহারসহ যা যা চেয়েছিল ভারত তার সবকিছুই দিয়ে এসেছেন প্রধানমন্ত্রী। ট্রানজিট কার্যকর এবং বন্দরের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি করতে যাতে কোনো সমস্যা না হয় সেজন্য এক বিলিয়ন ডলারের ঋণও ধরিয়ে দেয়া হয়েছে বাংলাদেশের হাতে। অন্যদিকে সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যা বন্ধ, তিস্তাসহ অভিন্ন নদীর পানি সমস্যার সমাধান, সীমান্ত চিহ্নিতকরণ, ছিটমহল হস্তান্তর, সমুদ্রসীমা নির্ধারণসহ বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর ব্যাপারে ভারতের কাছ থেকে মৌখিক আশ্বাস ছাড়া আর কিছুই পায়নি বাংলাদেশ। ভারতের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো পদক্ষেপই নেয়া হয়নি। অতীতে প্রতিযোগিতামূলক টেন্ডারের মাধ্যমে বিদ্যুত্ খাতের কোনো কাজ পায়নি ভারত।

এ বছর বিনা টেন্ডারে ২৬শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদনের কাজ ভারতের হাতে তুলে দিয়েছে সরকার। এর মাধ্যমে আমাদের বিদ্যুত্ খাতের ওপর ভারতের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে। আশুগঞ্জ নৌবন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে ত্রিপুরায় ভারতের ওডিসি পরিবহনের জন্য আন্তঃমন্ত্রণালয়ের কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই ভারতের সঙ্গে ট্রানজিট চুক্তি সই হয়েছে। ভারতের তৈরি করা খসড়াটিই সই করেছে বাংলাদেশ। নৌ-ট্রানজিট ফি আদায়ের জন্য বিধিমালা তৈরি করে সার্কুলার জারি করে সরকার।

ফিও আদায় শুরু হয়। হঠাত্ ভারত নৌ-ট্রানজিট ফি দিতে অস্বীকার করে। নৌ-ট্রানজিট ফি না দেয়ার ভারতের দাবিটি অপূর্ণ রাখেনি বাংলাদেশ। ওই সার্কুলার স্থগিত করেছে সরকার। নিয়ম অনুযায়ী সীমান্তের ১৫০ গজের মধ্যে কোনো ধরনের স্থাপনা নির্মাণ করা যায় না।

ভারত সীমান্তের ১৫০ গজের মধ্যে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের জন্য অনুমতি চায় বাংলাদেশের কাছে। সেই অনুমতিও দিয়েছে বাংলাদেশ। সবকিছু মিলিয়ে ভারতকে সবকিছু উজাড় করে দিয়েছে বাংলাদেশ। ভারতীয়রাও ভাবতে পারেনি তারা এতকিছু পেয়ে যাবে। প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফরের সময়ে যৌথ ইশতেহার ঘোষণার পর ভারতের বিখ্যাত দৈনিক ‘দ্য হিন্দু’র সম্পাদকীতে বলা হয়, সুযোগ পেয়ে ঢাকার কাছ থেকে সবকিছু দু’হাতে লুফে নিয়েছে দিল্লি।

অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আমি আনন্দিত যে দেশের স্বার্থ রক্ষা করতে পেরছি। যা কিছু হয়েছে তাতে বাংলাদেশের বেশি লাভ হবে। কীভাবে দেশের স্বার্থরক্ষা হয়েছে বা কীভাবে বাংলাদেশের বেশি লাভ হবে, তার কোনো ব্যাখ্যা মেলেনি আজও। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯ জানুয়ারি আবার ভারত যান বর্ষীয়ান রাজনীতিক জ্যোতি বসুর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিতে। এরপর প্রধানমন্ত্রী একে একে আরও ৮ দেশ সফর করেন।

এসব সফরে বাংলাদেশের প্রাপ্তি খুব একটা না থাকলেও দেশের স্বার্থ বিকিয়ে কোনোকিছু অন্তত দিয়ে আসতে হয়নি। ৭ থেকে ৯ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী দ্বিপক্ষীয় সফরে যান কুয়েত। এই সফরের মূল উদ্দেশ্য ছিল পদ্মা সেতুর জন্য অর্থায়ন এবং কুয়েতে বাংলদেশের জনশক্তি রফতানির নতুন সুযোগ সৃষ্টি। পদ্মা সেতুর ব্যাপারে কোনো আশ্বাস মেলেনি কুয়েতের আমিরের সঙ্গে বৈঠকে। অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে দক্ষ জনশক্তি নেয়ার আগ্রহ দেখালেও এখন পর্যন্ত এক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতি নেই।

প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৭ থেকে ২০ মার্চ তিনি চীন সফর করেন। এই সফরে ভারত কিছুটা নাখোশ হলেও কূটনৈতিক দিক থেকে সফরটি ছিল বিশেষ তাত্পর্যপূর্ণ। ওই সফরে বাংলাদেশের কিছু প্রাপ্তিও হয়েছে। মঞ্জুরিসহ অর্থনৈতিক ও কারিগরি ক্ষেত্রে সহায়তা, সপ্তম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু নির্মাণ এবং শাহজালাল সার কারখানা স্থাপন ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তি সই হয় ওই সফরে।

২৭ থেকে ৩০ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী ভুটান সফর করেন ১৬তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিতে। ডি-৮ সম্মেলনে অংশ নিতে প্রধানমন্ত্রী ৪ থেকে ১০ জুলাই নাইজেরিয়া সফর করেন। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে ১৮ থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন। তার এই সফর ছিল বিশেষভাবে আলোচিত। প্রধানমন্ত্রী নিউইয়র্কে পৌঁছার পর বিমানবন্দরে প্রবাসীদের দুই গ্রুপের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়।

এই সফরেই প্রধানমন্ত্রীর ডিপিএস মাহবুবুল হক শাকিল এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দফতরের পরিচালক শাহনাজ গাজীর কেলেঙ্কারির ঘটনা বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে রীতিমত কলুষিত করেছে। পরে এই ঘটনার জন্য শাকিলকে চাকরি হারাতে হয়েছে। জাতিসংঘ সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে সাফল্যের জন্য বাংলাদেশকে এমডিজি পুরস্কার দেয়া হয়। এই পুরস্কারকে জাতিসংঘের পুরস্কার বলে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয় সরকারের পক্ষ থেকে। পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এটা জাতিসংঘের কোনো পুরস্কার নয়।

২১ নভেম্বর থেকে ২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী রাশিয়া, বেলজিয়াম এবং জাপান সফর করেন। বিশ্ব বাঘ সম্মেলনে যোগ দিতে তিনি রাশিয়া যান। তবে দ্বিপক্ষীয় বিষয় নিয়ে তিনি রুশ প্রধানমন্ত্রী ভদ্মাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করেন। বেলজিয়াম সফরে তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরটিও ছিল বাংলাদেশের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

জাপানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতুর জন্য অতিরিক্ত অর্থ সহায়তা চান। এই অনুরোধের প্রেক্ষিতে জাপান পদ্মা সেতুর জন্য অতিরিক্ত একশ’ মিলিয়ন ডলার দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এছাড়া অর্থনৈতিক সহযোগিতা বিষয়ে একাধিক চুক্তিও সই হয়েছে ওই সফরে। প্রধানমন্ত্রীর এসব সফরে সফরসঙ্গীদের মধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি সবসময়ই ছিলেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী অনেকটা কাকতালীয়ভাবে ২০০৯ সালের মতো ২০১০ সালেও ৩৪ বার বিদেশ সফর করেন।

এই ৩৪ বার সফরের মধ্যে রাশিয়া, ফ্রান্স, স্পেন এবং কম্বোডিয়া সফর ছিল দ্বিপক্ষীয়। বাকি সফর তিনি করেছেন বিভিন্ন সম্মেলন, সেমিনার, সিম্পোজিয়ামে অংশ নেয়ার জন্য। বিরামহীন নিষম্ফল সফরে তিনি ব্যস্ত ছিলেন সারা বছর। তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর রাশিয়া সফর ছিল মোটামুটি ফলপ্রসূ। এই সফরে পরমাণু বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনে প্রাথমিক চুক্তি সই হয়।

এটা বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক খবর। ২০১০ সালে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিশ্বজুড়ে ঘুরে বেড়ালেও অন্যান্য দেশের সরকারপ্রধানরা বাংলাদেশে আসেননি বললেই চলে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রী ছাড়া ২০১০ সালে আর কোনো ভিভিআইপির ভিজিট হয়নি বাংলাদেশে। -(বশীর আহমেদ)আমার দেশ


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.