উদাসিন
কয়েক দিন ধরে কৌশিক সাহেবের হালকা জ্বর-জ্বর লাগছে। নাক দিয়ে পাতলা পানি ঝরছে, হাঁচি আসছে। অস্বস্তি লাগছে, তাই তিনি গেলেন পাড়ার মোড়ে ওষুধের দোকানে। দোকানি সব শুনে বললেন, ইনফ্লুয়েঞ্জা হয়েছে। দোকানি তাঁকে কিছু জ্বরের বড়ি এবং প্রতিটি ৩০ টাকা দামের কতগুলো অ্যান্টিবায়োটিক বড়ি দিলেন।
ওষুধ খেয়ে সাত-আট দিন পর কৌশিক সাহেব সুস্থ হলেন।
ওপরের গল্পটা কাল্পনিক হলেও আমাদের দেশে ওষুধের দোকানিদের ওষুধের ব্যবস্থাপত্র দেওয়ার ঘটনা কিন্তু কাল্পনিক নয়। ছোটখাটো রোগবালাইয়ের এখন তাঁরাই চিকিৎসা করেন। তাঁদের অনেকেরই চিকিৎসার দক্ষতাও অনেক ভালো। কিন্তু তা সত্ত্বেও সামান্য অসুখেই তাঁরা উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করে থাকেন।
তাঁরা যেসব রোগে এমনভাবে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করেন, তার বেশির ভাগ রোগ সারাতে কোনো অ্যান্টিবায়োটিকের দরকার নেই। আর কিছু রোগ খুবই সস্তা এবং নিরাপদ অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে সারানো সম্ভব। এর পরও তাঁরা সামান্য ভাইরাস জ্বরে এজিথ্রোমাইসিনের মতো অত্যন্ত উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে থাকেন। কিন্তু ভাইরাল জ্বর যেমন—ইনফ্লুয়েঞ্জায় অ্যান্টিবায়োটিকের কোনো কার্যকারিতা নেই। কারণ অ্যান্টিবায়োটিক শুধু ব্যাকটেরিয়াকে মারতে পারে, ভাইরাসকে নয়।
যেখানে ইনফ্লুয়েঞ্জা জ্বর ভালো করতে কোনো ওষুধেরই প্রয়োজন নেই, সেখানে অ্যান্টিবায়োটিকের মতো একটা বিপজ্জনক ওষুধ ব্যবহার করা কতটা ভয়ংকর ব্যাপার হতে পারে, তা সহজে অনুমান করা যায় না।
হয়তো প্রশ্ন মনে হতে পারে, যে ওষুধ রোগ সারিয়ে মানুষকে সুস্থ করে তোলে, তা কেন বিপজ্জনক হবে? কারণ, সব ওষুধেরই একটা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে। কারও কম, আবার কারও বেশি। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনেক সময় রোগীর মৃত্যুর কারণও হতে পারে। ওষুধের দোকানিরা এসব ওষুধ হরহামেশাই ব্যবহার করেন।
প্রথমত, তাঁরা ব্যবসায়িক দিকটা বিবেচনা করেন, আর বাকিটা তাঁরা জ্ঞানস্বল্পতার কারণে করে থাকেন।
আর অ্যান্টিবায়োটিক এমনই একটা ওষুধ, যার বিরুদ্ধে ব্যাকটেরিয়া খুব সহজেই প্রতিরোধ সৃষ্টি করতে পারে। তাই এর ব্যবহার খুবই সতর্কতার সঙ্গে করতে হয়। কিন্তু ওষুধের দোকানিরা এখন ওই সব ওষুধ মানুষকে মুড়ির মতো খাওয়াচ্ছেন। তাতে সতর্কতার কোনো বালাই নেই।
এই প্রতিরোধ হয় অ্যান্টিবায়োটিকের ভুল প্রয়োগের কারণে। সঠিকভাবে ব্যবহার করলে ব্যাকটেরিয়াগুলো মারা যায়, কিন্তু যখন বেঠিকভাবে ব্যবহার করা হয়, তখন ব্যাকটেরিয়া না মরে বেঁচে থাকে। তখন তারা ওই অ্যান্টিবায়োটিককে চিনে ফেলে এবং তার বিরুদ্ধে নিজের চারপাশে বাঁচার জন্য বর্ম তৈরি করে, তখন সেই ব্যাকটেরিয়াকে ওই অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে মারা যায় না। ওই ব্যাকটেরিয়াকে মারতে আরও অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োজন হয়।
মেডিকেল কলেজের ফার্মাকোলজি বিভাগের আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ক্লাসে একদিন বলেছিলেন, ‘আমাদের পূর্বপুরুষেরা সংক্রামক রোগে মারা গেছেন আর আমাদের উত্তরপুরুষেরাও ওই একই অসুখে মারা যাবে।
পার্থক্য শুধু একটাই: পূর্বদের বেলায় অ্যান্টিবায়োটিক ছিল না বলে চিকিৎসার অভাবে মারা গেছেন, আর উত্তরেরা মারা যাবে তখন অ্যান্টিবায়োটিক থাকবে, কিন্তু কাজ করবে না। কারণ ব্যাকটেরিয়া ওই সব অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তৈরি করে ফেলবে। ’ সত্যিই যদি এমন হয়, তবে সামান্য ব্যাকটেরিয়ার কাছে সৃষ্টিকুলের সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি মানুষ অসহায় হয়ে পড়বে। তাহলে এই মহাসংকট থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার কোনো উপায় আছে কি? হ্যাঁ, অবশ্যই আছে। আমাদের অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে সতর্ক থাকতে হবে।
এর অবাধ, যত্রতত্র ও অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। শুধু যেখানে অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োজন, সেখানে ব্যবহার করতে হবে। শুধু তা-ই নয়, সঠিক নিয়মে এবং সঠিক ডোজে ব্যবহার করতে হবে। চিকিৎসক ব্যতীত কেউ যেন অ্যান্টিবায়োটিক প্রেসক্রাইব না করেন, সে জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। যে রোগীকে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হবে, তাকে স্পষ্টভাবে বলে দিতে হবে, কখন কীভাবে খেতে হবে, কয়টা খেতে হবে এবং কত দিন খেতে হবে।
আর ওষুধের দোকানিদের উদ্দেশে বলছি, আপনারা না জেনে শুধু ব্যবসায়িক দিক চিন্তা করে কাউকে অ্যান্টিবায়োটিকের মতো বিপজ্জনক ওষুধ দেবেন না। কারণ, অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে পুরো মানবজাতি হয়তো একদিন ধ্বংসের মুখে পড়বে। তখন রোগ থেকে উদ্ধারকারী ত্রাণকর্তা অ্যান্টিবায়োটিক আমাদের সাহায্য করতে পারবে না।
মুহাম্মদ মোস্তফা হুসাইন
মির্জানগর, সাভার, ঢাকা।
copy & paste from: Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।