বৃথা হয়রানি
আমাদের তখন পড়ো পড়ো দশা। সবকিছুতেই ডাব্বা মারছি। এসএসসি’র রেজাল্ট ভালো হচ্ছে না, কালচারাল কম্পিটিশনে আর থানা লেবেলে আধিপত্য নেই, শেষ ভরসা খেলাখুলাÑ কিন্তু পরপর দুবার ইন্টার স্কুল ফুটবলে আমাদের টিমলিডার ল্যাং খেয়ে ব্যাঙ হয়ে ফেরার পর থেকে সে আশায়ও গুড়ে বালি। অথচ থানার একমাত্র গভর্নমেন্ট স্কুল, একসময় অন্যরা তো আমাদের কাছে ঘেঁষা দূরে থাকেÑ স্কুলের নাম শুনলে ইজ্জত দিয়ে কথা বলত, আর আজ স্কুলের নাম শুনলে সবাই দাঁত কেলিয়ে হাসে। ‘ওহ, ওমুক স্কুল,’ মুখের ওপর তাচ্ছিল্য দেখিয়ে চলে যায়।
আমরা একেকজন পলাশীর আম্রকাননে পরাজিত নবাব সেজে বিষণœ মুখে হাঁটি। যে করেই হোক স্কুলের মানÑইজ্জত ফিরিয়ে আনতে হবে। একদিন এ্যাসেম্বলিতে সেই কথাই ঘোষণা করলেন আমাদের হেডস্যার কুদরুতুন নূর সাহেব। তার পর স্যারদের মিটিং বসল। মিটিঙে সিদ্ধান্ত হলো: এই মাথামোটা ছেলেগুলোকে দিয়ে আর যাই হোক লেখাপড়ায় ভালো করানো যাবে না।
তার চেয়ে বরং এক্সট্রা ক্যারিকুলামস-এ জোর দেয়া হোক, তাতে যদি ভালো কিছু আসে। যেমতে সিদ্ধান্ত সেমতেই বাস্তবায়ন। কালচারাল সাইডের দায়িত্ব দেয়া হলো বায়োলজি’র ললিত স্যার, আর স্পোর্টসের দায়িত্ব যথারীতি স্পোর্টস টিচার হাই স্যারকে।
চিনতে পেরেছেন আমাদের হাই স্যারকে। না চেনার কিছু নেই।
বাংলাদেশের সবাই তাকে চেনে। চিনতে বাধ্য। কথায় কথায় তিনি এমনই দাবি করেন। করাই স্বাভাবিক, তাঁর মতো বিশাল শরীরের মানুষ গোটা দেশে জনাদশেক আছে কিনা সন্দেহ। দূর থেকে দেখলে মাঝে মাঝে ভ্রম হয়, মানুষ নাকি ছোটখাটো কোন হাতির বাচ্চা-টাচ্চা।
এই বিপুল দেহ আর খ্যাতি নিয়ে তাঁর আত্মপ্রসাদের অন্ত নেই। একমাত্র উপরঅলা ছাড়া দুনিয়ার কাউকে তিনি কেয়ার করেন না। ক্লাস থ্রির বাচ্চাগুলো বেশি ক্যাচর-ম্যাচর করলে একেবারে ৩ নম্বর ডিয়ার বলের মতো কিক ছুঁড়ে মারেন। তাঁর ভয়ে দশ পাড়ার বানর এক ঘাটে এসে কফি খায়। তাঁর শরীর দেখে নাকি অন্য দলের গোল কিপাররা কাপড় নষ্ট করে ফেলে।
আমরা মনে মনে ভাবি, স্যার যদি একবার আমাদের হয়ে মাঠে নামতেন, তো ওদের জালে কেয়ামত হয়ে যেত। আর কিছু না থাকুক আমাদের স্পোর্টস দল এই বিশাল শরীরের মানুষটিকে নিয়ে সবসময় একটা গর্বের মধ্যে থাকে। দেখো, আমাদের স্যারের শরীরটা, তোমরা চ্যাম্পিয়ান হতে পারোÑ ট্রফি নিতে পারো, কিন্তু এরকম একটা জীবন্ত কিংবদন্তি পাবে না।
শরীরটা বিশাল হলেও স্যার মানুষ হিসেবে খুব হালকা মেজাজের। সারাক্ষণ একটা চাবির রিং আঙুল নিয়ে ঘুরে বেড়ান।
ভাবখানা বাকের ভাই বাকের ভাই। আর মাঝে মাঝে এটা ওটার ক্লাস নিতে গেলো বই গুটিয়ে রেখে রাজ্যের যত মজার মজার গল্প করেন। এর মধ্যে কেউ যদি অন্যের পেন্সিল নিয়ে টান মারে, হাফপ্যান্টের তলায় একটা চিমটি কাটে, কৌটোয় ‘বান্দরের লোলা’ নিয়ে এসে লাগিয়ে দেয় গায় কিংবা কানে কানে বলে ‘যাবি নাকি আজ..’Ñ তাহলে রক্ষা নেই। হেসেই হেসেই বাদী-বিবাদী দুজনকে ডাকবেন। দু’হাতের তলায় দুটো শালিক ছানাকে নিয়ে আস্তে করে ছেড়ে দেবেন ব্রজমুষ্ঠিখানি।
তারপর একটা বিস্ফোরণের আওয়াজ। মিনিট পাঁচেক কোন সাড়া শব্দ নেই। একটা প্রশ্নই শুধু মাথার ভেতরে ঘুরপাক খাবে, বেঁচে আছি নাকি মরে গেলাম। ৫ মিনিট পর নিশ্বাস ফিরে এলে মনে হবে হাড়ের জয়েন্টগুলো সব খুলে খুলে যাচ্ছে। স্যারের হাতে যারা এই বোমবাস্টিক থাবাটি খায়নি, তারা বুঝবে না স্যারের হাত দুটোতে কী পরিমাণ শক্তি! শক্তি হবেই না বা কেন।
একদিন ভূগোলের ক্লাস নিতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন তাঁর প্রতিদিনকার খাওয়ার রুটিন। তিনি সকালে ওঠেই জগে করে ঠিক সোয়া এক কেজি দুধ নিয়ে ঢকঢকিয়ে খেয়ে ফেলেন। তারপর একটু হেঁটে এসে ৪টা ডিমকে একসঙ্গে ওমলেট করে ১৮টা রুটি খান এক নিঃশ্বাসে। দুপুরে একটা খাসি কিংবা গরুর রান খেয়ে আধা সের চিনাবাদম চিবুতে চিবুতে স্কুলে আসেন। রাতে একটু কম খানÑ দুই কেজি চালের ভাত খান ছ’টা গলদা চিংড়ির দোপের্ঁয়াজু দিয়ে।
এসব খেয়েই না তাঁর এই শরীর। তিনি সবসময় আমাদের খাওয়া-দাওয়ার প্রতি যতœ নিতে বলেন। বিশেষ করে আমার প্লাস্টিক বডি দেখিয়ে প্রায় বলেন,‘একসময় আমি তোর লাহন আছিলাম, খাইয় দাইয়া না এই শরীর বানাইছিÑ’
এতো কিছুর মধ্যেও স্যারের একটা খুব খারাপ স্বভাব আছে। তিনি সারাদিন ঘুষ খুঁজেন এবং খান। আমাদের ধারণা ঘুষ খেয়ে খেয়ে যেমন তাঁর ভুঁড়িটা ফুলছে তেমনি ব্যাংকের এ্যাকাউন্টও।
তার মতো ধনী লোক বুঝি দেশে আর দু'টো নেই। অবশ্য তাঁর ঘুষগুলো খুব সামান্য। শরীর চর্চায় ২৫-এ ২৫ পেতে চাও, তাহলে সামনের বার্মাইয়্যার হোটেল থেকে এক কাপ চা আর দুটো জিলেপী নিয়ে এসো, স্যার তরতরিয়ে খাবেন আর নম্বর বসাবেন। ফুটবল টিমে নাম লেখাতে চাও, কিন্তু মাঠে নামলে বল পায়েই আসে না, অসুবিধে নেই স্যারের জন্য এক প্যাকেট স্টার ফিল্টার নিয়ে আসোÑ মেজাজ ভালো থাকলে ক্যাপ্টেনও বানিয়ে দিতে পারেন। মাঝে মাঝে একে ওকে তিনি হুংকার ছেড়ে বলেন, ‘এই তুই আমারে খাওয়াস না ক্যান, দেখি শরীরচর্চায় কেমনে পাস করস !’ ফেল করানোর কোন ইচ্ছে যে তার নেই সবাই তা জানে, এটা স্রেফ ভয় দেখানো।
এতোবড়ো একজন দুর্নীতিবাজ হওয়ার সত্ত্বেও মনে মনে আমরা তাকে পছন্দই করি। আমাদের ধারণাটা এরকম, তিনি ঘুষ না খেলে কে খাবেন, ঘুষ খাওয়ার মতো এতো বড়ো শরীর কার বা আছে।
হেডস্যারের জেহাদি ডাকের পর হাই স্যার তার ফুটবল টিম নিয়ে খুব সিরিয়াস হয়ে উঠলেন। টিফিন ব্রেকে সবাইকে একদিন ডেকে পাঠালেন মাঠে। আমরা সৈন্যসামন্তের মতো লাইন করে দাঁড়ালাম।
আগামী ফেব্র“য়ারিতে ইন্টার স্কুল ফুটবল, আর যা কিছু জাহান্নামে যাক, এবার থানা চ্যাম্পিয়ান হওয়া চাই আমাদের। আমরা সবাই মাথা নেড়ে তাকে সমর্থন করলাম। তাহলে আজ থেকেই শুরু হোক প্র্যাকটিস। প্রতিদিন স্কুল ছুটির পর এক ঘন্টা প্র্যাকটিস। প্রথম দিন আর বেশি কথা হলো না।
২৫ জনকে নিয়ে একটা খসড়া টিম করা হলো। আমার তালগাছের মতো হিলহিলে শরীরটাকে তিনি পোস্টিং দিলেন গোলপোস্টের সামনে। ফুটবলের ‘ফ’-ও বুঝে না, অথচ গায়ের জোরে স্কুলের সবাইকে ছাড়িয়ে, সেই ওসমানকে নিয়ে এলেন ডিফেন্সে। শুধু একটা ছোট্ট পার্সিয়ালটি করলেন, ডিসি অফিসের বড়োবাবুর ছেলেকে তার পদাধিকার (!) বলে দলে রাখলেন। অবশ্য তার থাকা না থাকা একই কথা।
কখনো তার পায়ে বল গেছে বলে মনে পড়ে না। যাই হোক, পরের দিন থেকে জোরেশোরে প্র্যাকটিস শুরু হলো। কিন্তু স্যারের আর দেখা নেই। স্কুল ছুটি হওয়ার ঘন্টাখানেক আগেই স্পোর্টস রুমের চাবিটা আমার হাতে তুলে দিয়ে গুনগুনিয়ে গান ভাজতে ভাজতে বাসায় চলে যান। তার বাসা অবশ্য বেশি দুরে নয়।
স্কুল মাঠ ঘেঁষে একটা ছিপছিপে খাল, তার ওপারে চারচালা টিনের ঘর, তিনি দুটো রুম নিয়ে ভাড়া থাকেন সেখানে ।
আমরা আর স্যারের জন্য বসে রইলাম না। নিজরাই নিজেদের পারফরমেন্স ডেভলাপ করতে লাগলাম। যে করেই হোক সার্ক থুড়ি থানা চ্যাম্পিয়ানশিপ আমাদের চাই। এর মধ্যেই চলে এলো উইন্টার ভ্যাকেশন।
পরীক্ষা শেষ, ক্লাসও নেই। আমরা আরো উঠেপড়ে লাগলাম। দুপুরে দু-গ্রাস মুখে দিয়ে চলে আসি মাঠে। পথে স্যারের বাসা থেকে স্পোর্টস রুমের চাবি নিয়ে আসি। একটানা সন্ধ্যে পর্যন্ত খেলা।
কিপিঙের পাশাপাশি এখন স্ট্রাইকিঙেরও প্র্যাকটিস করছি। একদিন এরকম, দুপুরে স্যারের বাসায় গেছি চাবি আনতে। দেখি স্যার একথাল ভাত নিয়ে বসেছেন, কোনায় একটুখানি পাটশাখের তরকারি, তিনি আপন মনে তা চটকাচ্ছেন। কই সেই রাজকীয় ভোজ, কই কচি খাসির রান! কেন জানি আমার চোখ ভিজে উঠেছিল সেদিন। সেই দৃশ্যটা এখনো আমার চোখে লেগে আছে।
পরে জেনেছি স্যার নাকি ভার্নাক্যুলার টিচার ছিলেন। অর্থাৎ অন্য টিচারদের প্রায় অর্ধেক বেতন পেতন তিনি। তাঁর স্ত্রী চিকিৎসার অভাবে মারা গিযেছিলেন। আর তাঁর শরীরে বাসা বেঁধেছিল একটা মারাত্মক রোগ, যার কারণেই তিনি এমন অস্বাভাবিকভাবে ফুলে গিয়েছিলেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।