আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমাদের ভাষার সীমাবদ্ধতা



বিয়ের বাজারে যাদের আনাগোনা হয়েছে, নিজের জন্য হোক বা অন্য কারো জন্য হোক, তারা ‘ছেলে কেমন’ বা ‘মেয়ে কেমন’ এই জাতীয় প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন অথবা এই প্রশ্নগুলি করেছেন কোন না কোন এক পরযায়ে বলেই ধরে নিচ্ছি। ছেলে ভাল বলতে আমরা আসলে কি বুঝাই বলুন তো? কিছু একটা যে বুঝাই তা তো মানলাম, কিন্তু আমরাই কি তার পুরোটা বুঝি? ভাল? লাজুক? সংসারী? বাউন্ডুলে ধরনের? ঘাবড়াবেন না, আমার এই লেখা বিয়ে প্রসঙ্গে নয়, বরঞ্চ আমাদের ‘এক কথায় প্রকাশের’ এই চিরন্তন অভ্যাস যে ঐ বর্ণিতব্য ব্যাক্তির উপর অবিচার করে তাই নিয়ে আমার ভাবনা। পন্ডিতেরা বলেন, দোষ আমাদের নয়, আমাদের ভাষাই আসলে অপারগ কোন মানুষকে অল্প কথায় বর্ণনা করতে। অল্প কথা বাদ দিন, অধিক কথাতেই একবার চেস্টা করে দেখতে পারেনঃ জনাব ক (অথবা জনাবা খ) কেমন? পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখে যান; তারপর নিজেই একবার পরখ করে দেখুন তো, সবটা কি বলা হয়েছে? মানুষ বড় জটিল প্রাণী, আর ঠিক সেই জন্যই তাকে ভাষায় পুরোপুরি বর্ণনা করা প্রায় অসম্ভব। এই ফর্মুলা শুধু আইনস্টাইন, রবিন্দ্রনাথ বা ওবামা জাতীয় বড় মানুষদের বেলাতেই প্রযোজ্য নয়, আপনার আমার অথবা যেকোন রহিম/করিমের জন্যও তা খাটে।

তবে চিন্তার কথা এই যে, মানুষই একমাত্র জটিল চিজ নয় এই ধরাধামে (চিজ শব্দটা আজকাল কথ্য ভাষায় খুব ব্যাবহার হয়, তাই ভাবলাম, এতদিনে এটা আমাদের ভাষার নিজস্ব সম্পদে পরিণত হওয়ার কথা)। মধুর স্বাদ কেমন? মিষ্টি? চিনির স্বাদ-সেটিও মিষ্টি? অন্যভাবে বলিঃ আপনি মধুর স্বাদ কেমন তা কাগজে লিখে এমন একজনকে দিন যে কখনো মধু চেখে দেখেনি। ওই লোকটি লিখিত আকারে মধুর স্বাদের যে বর্ণনা পাবে তা কি মধুর স্বাদকে সত্যিকারভাবে বর্ণনা করে? সম্ভবতঃ না। আবার, ভাষা অনেকসময় এত বেশি সাধারনীকরন করে যে, ‘চিনি’, ‘মধু’, ‘শিশুর হাসি’ অথবা ‘মোনালিসার রূপ’-এই সবকেই আমরা ‘মিষ্টি’ বলে চালিয়ে দেই, যদিও বাস্তবে এগুলো ভিন্ন ভিন্ন বিষয়, এবং একটা আরেকটার থেকে আলাদা। মোনালিসার রূপ কি ভাষায় বলে শেষ করা যাবে? এর উত্তর হচ্ছেঃ ‘না’ – শুধু আলংকারিক অর্থে নয়, আক্ষরিক অর্থেও।

মোদ্দাকথা এই যে, ভাষা যদিও ভাব প্রকাশের খুবই শক্তিশালী একটা মাধ্যম, তবে জগতের অনেক বস্তু, অনেক ঘটনা, মনের অনেক অনুভুতি বা অনেক অবস্থাকে বর্ননা করতে গেলে ভাষা অক্ষম হয়ে পড়ে। মানুষের ভাষাকে তাই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন জীর্ণ বাক্য, যা সংগীতের মতন স্বাধীন নয়। ভাষা ও ছন্দ কবিতায় কবি বলছেনঃ মানুষের ভাষাটুকু অর্থ দিয়ে বদ্ধ চারি ধারে , ঘুরে মানুষের চতুর্দিকে । অবিরত রাত্রিদিন মানবের প্রয়োজনে প্রাণ তার হয়ে আসে ক্ষীণ । পরিস্ফুট তত্ত্ব তার সীমা দেয় ভাবের চরণে ; ধূলি ছাড়ি একেবারে ঊর্ধ্বমুখে অনন্ত গগনে উড়িতে সে নাহি পারে সংগীতের মতন স্বাধীন মেলি দিয়া সপ্তসুর সপ্তপক্ষ অর্থভারহীন ।

…………………………….. …………………………..... …………………………..... দক্ষিণের সমীরের ভাষা কেবল নিশ্বাসমাত্রে নিকুঞ্জে জাগায় নব আশা , দুর্গম পল্লবদুর্গে অরণ্যের ঘন অন্তঃপুরে নিমেষে প্রবেশ করে , নিয়ে যায় দূর হতে দূরে যৌবনের জয়গান — সেইমত প্রত্যক্ষ প্রকাশ কোথা মানবের বাক্যে , কোথা সেই অনন্ত আভাস , কোথা সেই অর্থভেদী অভ্রভেদী সংগীত-উচ্ছ্বাস , আত্মবিদারণকারী মর্মান্তিক মহান নিশ্বাস ? ফেসবুকে আমরা স্ট্যাটাস দিইঃ আজ আমার মন ভাল নেই। মন ভাল না থাকা তো হাজারো রকমের হতে পারে; এই স্ট্যাটাস থেকে আমাদের ফেসবুকের বন্ধুরা কে কি বুঝবে তা নির্ভর করছে তাদের মনের উপরে, আমার মন খারাপের ধরনের উপর নয়। গনিতের জগতে ‘২’ এর যে একটা সার্বজনীন অর্থ আছে, ভাষার ক্ষেত্রে কোন বাক্য কি ততটা নিশ্চিত অর্থ প্রকাশ করতে পারে? ২ এর সঙ্গে ২ যোগ করলে ৪ হয় সবসময়ই, কিন্তু ‘আজ আমার মন ভাল নেই’ এর অর্থ হতে পারে হাজারটা। এবং তা অনর্থ সৃস্টি করতে পারে খুব সহজেই। উদাহরন দেওয়াটা বাহুল্য মনে করছি, কারন ভাষা দিয়ে আমরা যা প্রকাশ করতে চাই অন্যরা তা না বুঝার কারনে সমস্যা তৈরী হওয়াটা খুব একটা বিরল নয় আমাদের কারোরই কাছে।

আগে ঢাকা থেকে গ্রামে চিঠি লিখতাম, চিঠি পেতামও নিয়মিত। তখনও মুঠোফোন চালু হয়নি কি-না! চিঠির অক্ষরগুলি যে বাস্তবতাকে চিত্রিত করত, অথবা যে অনুভুতিগুলো বহন করে আনত, তা অনেকটা ঐ মধু’র কাগুজে বর্ননার মতই, কারন পত্র লেখকের মনের যত ভাবনা, তার থেকে বেছে বেছে, সেন্সর করে, যেটুকু আমাকে লেখা যায়, শুধু সেটুকুই লিখা হয়েছে, আর লেখকের ভাবনা-সাগরের বাকি ঢেউগুলো আমার আড়ালেই থেকে গেছে। কাজেই কি আর করা, ‘রিডীং বিটুইন দি লাইনস’ এর আশ্রয় নিতে হয় প্রাপ্রককে। সামনাসামনিও যখন কথা বলি, কারো মুখ দিয়ে যা উচ্চারিত হয়, মনের কথা কি সেটাই নাকি অন্য কিছু, তার খবর কে রাখে? এই যে এত চ্যাট, এত ফোনকল, এত ই-মেইল ও চিঠি (যদি এখনও কেউ লেখেন), তার সবকিছুতেই এই সন্দেহতত্ত্ব প্রয়োগ করুন, দেখবেন, ভাষা আসলে যোগাযোগের ক্ষেত্রে একটা ভাসাভাসা ভুমিকা পালন করছে মাত্র, আপনার মোবাইল ফোনের সঙ্গে ইউ-এস-বি কেবল দিয়ে আপনার কম্পিউটারের যে নিখুঁত যোগাযোগ হয় (যেখানে কিনা একটা ‘বাইট’ তথ্যও এদিক-ওদিক হয় না), সে রকমটা মানুষে মানুষে যোগাযোগের বেলায় কখনো হয় বলে মনে হয় না। আপনার একান্ত আন্তরিকতা থাকা সত্ত্বেও এটা ঘটবে, কারন যে ভাষা দিয়ে আপনি যোগাযোগ করছেন, সেখানেই তো রয়েছে গলদ।

ভাষাকে আমরা যতটা শক্তিশালী ভাবি, আসলে ভাষার শক্তি তার চেয়ে অনেক কম। সেক্ষেত্রে আপনি ভাষা বাদ দিয়ে ‘নীরবতা’ অথবা ‘চোখের চাহনি’ দিয়ে চেষ্টা করুন, অনেক বেশি প্রকাশ করতে পারবেন। মানুষে মানুষে যোগাযোগের জন্য ইউ-এস-বি কেবল বা এর কোন উন্নততর বিকল্প যেহেতু আবিস্কৃত হয়নি আজও, তাই ভাষার অর্থ নিয়ে অনর্থ যেন না ঘটে সে দিকটা খেয়াল রাখা আমাদের অবশ্য কর্তব্য।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.