এডিট করুন
আমরা যারা সাধারণ স্কুল কলেজে পড়েছি তারা অবশ্যই বাংলা পড়েছি, বাংলা কবিতা পড়েছি। আচ্ছা আমরা যা পড়েছিলাম তা কি আমাদের মনে আছে?? আমরা অনেকেই কেবলমাত্র পরীক্ষায় পাশ করার জন্য কবিতা মুখস্ত করেছি, কবিতার দুই লাইনের ব্যাখ্যা মুখস্ত করেছি। আমাদের মাথায় ছিল পরীক্ষা পাশের চিন্তা, ভাল ফলাফল করার চিন্তা। কিন্তু শিক্ষা সে তো কেবল পরীক্ষা পাশের জন্য নয়, সে তো চেতনা তৈরীরও এক মহা উপাখ্যান। আসুন আমরা আজ আবার সেই কবিতাগুলো পড়ি।
এখনতো আর আমাদের চিন্তা করতে হয় না পরীক্ষার জন্য। আমরা এখন নির্দ্বিধায় চেতনার মূর্তরুপ সেই কবিতাগুল হৃদয়াঙ্গম করতে পারি নিশ্চিন্তে। আসুন ভুলে যাওয়া সেই কবিতাগুলোকে আজ নতুনভাবে জাগ্রত করি।
প্রথমেই আমরা স্মরণ করব "আবদুল হাকিম"-কে। "বঙ্গবাণী"-র মত মোক্ষম কবিতাটি আমাদের চিত্তপরিষ্কারক হিসেবে কাজ করবে।
পরিষ্কার মনে আমরা পরবর্তীতে ধাবিত হব অন্যান্য কবিতায়।
কিতাব পড়িতে যার নাহিক অভ্যাস।
সে সবে কহিল মোতে মনে হাবিলাষ। ।
তে কাজে নিবেদি বাংলা করিয়া রচন।
নিজ পরিশ্রম তোষি আমি সর্বজন। ।
আরবি ফারসি শাস্ত্রে নাই কোন রাগ।
দেশী ভাষে বুঝিতে ললাটে পুরে ভাগ। ।
আরবি ফারসি হিন্দে নাই দুই মত।
যদি বা লিখয়ে আল্লা নবীর ছিফত। ।
যেই দেশে যেই বাক্যে কহে নরগণ।
সেই বাক্যে বুঝে প্রভু আপে নিরঞ্জন।
।
সর্ববাক্য বুঝে প্রভু কিবা হিন্দুয়ানী।
বঙ্গদেশী বাক্য কিবা যত ইতি বাণী। ।
মারফত ভেদে যার নাহিক গমন।
হিন্দুর অক্ষর হিংসে সে সবের গণ। ।
যে সব বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি। ।
দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়।
নিজ দেশ তেয়াগী কেন বিদেশ ন যায়। ।
মাতা পিতামহ ক্রমে বঙ্গেত বসতি।
দেশী ভাষা উপদেশ মনে হিত অতি।
।
আমাদের মনে আর কোন সন্দেহ নাই নিজ ভাষা সম্পর্কে। আমরা এখন শুদ্ধচিত্তে নিজ ভাষার প্রতি মমতা প্রকাশ করব। না এ প্রকাশ আজকের দিনের জন্য নয় শুধু। এ প্রকাশ শুরু হয়েছিল ১৬২০ খৃষ্টাব্দে "আবদুল হাকিম"-এর মাধ্যমে।
তিনি রুখে দাঁড়িয়ে দুর করে দিয়েছিলেন আমাদের ভাষার প্রতি অবজ্ঞাকারীদের। এরপর অনেক জল গড়িয়ে গেছে। অনেক রক্ত ঝরেছে। বাহান্নর বুকে রক্ত দিয়ে সীলমোহর দাগিয়ে আমরা নিজের আত্মার সাথে চুক্তি করেছি বাংলা আমার মায়ের ভাষা, বাংলা আমার আত্মার ভাষা, বাংলা আমাদের ভাষা। আমরা মহাকালের বুকে আজও দাঁড়িয়ে আছি আমাদের ভাষা নিয়ে।
জীবনের শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত আমরা দাঁড়িয়ে থাকব। "অ আ ক খ" এ কোন সাধারণ অক্ষর নয়। এ এক রক্তমাখা ইতিহাস, রক্তে ভেজা ইতিহাস। এ আমার জাতিসত্তার, আমার অন্তরাত্মার অভ্যন্তরীণ সপ্তবীণায় তোলা সুরের ঝংকার। এ কোন হেলাফেলার দান নয়।
এ প্রাণের বিনিময়ে, তাজা রক্তের বিনিময়ে, মায়ের বুক খালি করার বিনিময়ে, বোনের পথ দীর্ঘ পথ চেয়ে থাকার বিনিময়ে কিনে নেওয়া ভুখন্ডের মত চিরস্থায়ী এক সম্পদ। আসুন আমরা এবার সেই সম্পদ ক্রয়কালীন মূল্য পরিশোধের এক চিত্র দেখি । এবারের কবিতাটি "আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ"-এর সেই অগণিত বার আবৃত্তি করা "মাগো ওরা বলে"। ১৯৫৩ সালে কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়।
"কুমড়ো ফুলে-ফুলে
নুয়ে পড়েছে লতাটা,
সজনে ডাঁটায়
ভরে গেছে গাছটা
আর আমি
ডালের বড়ি শুকিয়ে রেখেছি।
খোকা তুই কবে আসবি?
কবে ছুটি?"
চিঠিটা তার পকেটে ছিল
ছেঁড়া আর রক্তে ভেজা।
"মাগো, ওরা বলে
সবার কথা কেড়ে নেবে।
তোমার কোলে শুয়ে
গল্প শুনতে দেবে না।
বলো, মা,
তাই কি হয়?
তাই তো আমার দেরি হচ্ছে।
তোমার জন্য
কথার ঝুরি নিয়ে
তবেই না বাড়ি ফিরব।
লক্ষী মা,
রাগ কোরো না
মাত্র আর কটা দিন। "
"পাগল ছেলে!"
মা পড়ে আর হাসে,
"তোর ওপরে রাগ করতে পারি!"
নারকেলের চিড়ে কোটে
উড়কি ধানের মুড়কি ভাজে,
এটা-সেটা
আরও কত কী!
তার খোকা যে বাড়ি ফিরবে
ক্লান্ত খোকা।
কুমড়ো ফুল
শুকিয়ে গেছে,
ঝরে পড়েছে ডাঁটা।
পুঁই লতাটা নেতানো।
"খোকা এলি?"
ঝাপসা চোখে মা তাকায়
উঠানে-উঠানে
যেখানে খোকার শব
শকুনিরা ব্যবচ্ছেদ করে।
এখন
মার চোখে চৈত্রের রোদ
পুড়িয়ে দেয় শকুনীদের।
তারপর
দাওয়ায় বসে
মা আবার ধান ভানে,
বিন্নি ধানের খই ভাজে,
খোকা তার
কখন আসে কখন আসে।
এখন
মার চোখে শিশির-ভোর
স্নেহের রোদে ভিটে ভরেছে।
ভাই আমি কাইন্দা দিছি এই কবিটা টাইপ করতে গিয়া। আমি আর নিজেরে ধইরা রাখতে পারি নাই।
মনিটর ঝাপসা হইয়া গেছে। আমার গলা ব্যাথা করতাছে কান্না আটকাইয়া রাখতে গিয়া। আমি আমার ভাষা ভালবাসি, আমার কোন সন্দেহ নাই এই নিয়া।
এক একটা প্রাণ, এক একটা জীবনের স্পন্দন, মূর্ছনা থেমে গিয়েছিল সেই দিন। অর্থ নয় বিত্ত নয় স্বচ্ছলতা নয় আরো এক বিপন্ন বিস্ময়! কোন উচ্চাশা নয়, কোন মতবাদ নয়, কোন আদর্শ নয়, কোন ধর্ম নয়, কোন অতিরিক্ত সুবিধা প্রাপ্তি নয়, ভাষা, মায়ের ভাষা, জন্মগত ভাষা, নিজের ভাষা, নিজের কন্ঠের জন্য সকল জাগতিক ভয়, ভীতি, রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে জীবন হাতে করে ওরা পথে নেমেছিল।
মানুষ তার জীবন বাচানোর জন্য কি না করে!!! ওরা অকাতরে তুচ্ছের মত জীবনকে সেইদিন অবহেলা দেখিয়েছিল। ওরা সেইদিন জীবনের মূল্য আকাশ থেকে নামিয়ে মাটির পৃথিবীতে আছড়ে ফেলেছিল। ওরা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বীর। অবহেলায় ছুড়ে ফেলেছিল প্রাণের মায়া। তুচ্ছ করে ভাসিয়ে দিয়েছিল নিজের হৃদপিন্ডের রক্তচলাচল।
ওরা অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে আমার ভাষা। ওরা আমাকে এমন এক ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর সদস্য করেছে যেই জনগোষ্ঠী ভাষার মূল্যের কাছে জগতের তথাকথিত সর্বোচ্চ মূল্যের জীবন পর্যন্ত হাটু গেড়ে মাথা নত করে।
এবার আমরা যে কবিতাটি পড়ব তার কবি সম্পর্কে আমরা মোটেও মাথা ঘামাবো না। আমার আগের এক পোষ্ট থেকে আমি কিছু অংশ উদ্ধৃত করছি।
কবি আমি তোমাকে ভুলে যাব।
আমি আর মনে রাখব না তুমি কে। আমি বেলালুম ভুলে যাব তুমি কি ছিলে। তোমার অস্তিত্বকে আমি এখন থেকে অস্বীকার করব। আমি শুধু কবিতাটুকু মনে রাখব। কবি তুমি কি খুবই অর্থকষ্টে ছিলে? তোমার কি ক্ষমতার খুবই কমতি পড়ে গিয়েছিল? জানিনা।
আমি যখন ছোট ভাই বোনদের, অনাগত প্রজন্মকে কবিতাটা পড়াব তখন তোমাকে মনে করলেই আমার আর কবিতাটা পড়তে ইচ্ছে করবে না। তুমি এখন মৃত। তোমার মৃত্যু হয়ে গেছে। তুমি আর এই কবিতার কবি না। এটা অন্য একজনের কবিতা।
আমি শুধু কবিতাটাই পড়ব। এর কবিকে নিয়ে আর ভাবব না। কবি তো মারা গেছেন।
কবির নাম "আল মাহমুদ"। কবিতার নাম "একুশের কবিতা"।
আমি একবার স্কুলের প্রভাত ফেরী শেষে এই কবিতাটা আবৃত্তি করেছিলাম। আমার খুব প্রিয় কবিতা।
ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ
দুপুর বেলার অক্ত
বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায়
বরকতেরই রক্ত!
হাজার যুগের সূর্যতাপে
জ্বলবে, এমন লাল যে,
সেই লোহিতেই লাল হয়েছে
কৃষ্ণচূড়ার ডাল যে!
প্রভাতফেরির মিছিল যাবে
ছড়াও ফুলের বন্যা,
বিষাদগীতি গাইছে পথে
তিতুমীরের কন্যা।
চিনতে নাই সোনার ছেলে
ক্ষুদিরামকে চিনতে?
রুদ্ধশ্বাসে প্রাণ দিল যে
মুক্ত বাতাস কিনতে?
পাহাড়তলির মরণ চূড়ায়
ঝাঁপ দিল যে অগ্নি
ফেব্রুয়ারির শোকের বসন
পরল তারই ভগ্নী।
প্রভাতফেরি প্রভাতফেরি
আমায় নেবে সঙ্গে,
বাংলা আমার বচন,আমি
জন্মেছি এই বঙ্গে।
আমি ক্লাস নাইনে যখন পড়ি তখন "সোজন বাদিয়ার ঘাট" বইটি প্রথম হাতে পাই। প্রথমে দেখি পুরো বইটাই একটা কবিতার বই। এত বড় একটা আস্ত বইয়ের মত লম্বা কবিতা পড়া মোটেও সম্ভব হবে না অথবা ধৈর্য্যে কুলোবে না। আমি বইটি অবহেলায় একপাশে ফেলে রাখি। কিছুদিন পর পড়ার মত হাতের কাছে কিছু না পাওয়ায় বইটি হাতে তুলে নিই।
পড়তে শুরু করি অনিচ্ছায়। কিচুক্ষণের মধ্যে আমি জীবনের সর্বপ্রথম উপভোগ্য কাব্যরস কাকে বলে, কবিতার নেশা যে কি হতে পারে তা হাড়ে হাড়ে টের পাই। কবি "জসীমউদ্দীন" প্রথম কবি যিনি আমাকে কাব্যরসের সমুদ্রে প্রথম ডুবিয়েছিলেন। এবার তার কবিতা "বাংলা ভাষা" দিয়ে এই পোষ্ট শেষ করছি।
ভাষা আন্দোলনের সকল শহীদদের প্রতি রইল অন্তর থেকে সম্মান।
আমার কোন কথাই তাদের প্রাপ্য সম্মান ও শ্রদ্ধা জানানোর উপযুক্ত নয়। কিন্তু এ যে আমার জন্মগত ঋণ, জন্মগত দায়বদ্ধতা! আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো, একুশে ফেব্রুয়ারী, আমি কি ভুলিতে পারি!
আমার এমন মধুর বাংলা ভাষা
ভায়ের বোনের আদর মাখা।
মায়ের বুকের ভালবাসা।
এই ভাষা-রামধনু চড়ে
সোনার স্বপন ছড়ায় ভবে
যুগ-যুগান্ত পথটি ভরে
নিত্য তাদের যাওয়া আসা।
পুব বাংলার নদী থেকে
এনেছি এর সুর
শস্য দোলা বাতাস দেছে
কথা সুমধুর;
বজ্র এরে দেছে আলো
ঝঞ্বা এরে দোল দোলালো
পদ্মা হল সর্বনাশা।
বসনে এর রঙ মেখেছি
তাজা বুকের খুনে
বুলেটেরি ধূম্রজালে
ওড়না বিহার বুনে।
এ ভাষার-ই মান রাখিতে
হয় যদিবা জীবন দিতে
কোটি ভাইয়ের রক্ত দিয়ে
পুরাবে এর মনের আশা।
ছবিঃ "চারুপাঠ"-এর "জসীমউদ্দীন" এর "বাংলা ভাষা" কবিতা হতে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।