এই ব্লগের কোন লেখা আমার অনুমতি ব্যতীত কোথাও ব্যবহার না করার অনুরোধ করছি
দোলন, আমার পাঁচ বছরের বড় বোন, ২০০৬ এর এই দিনে ওর বিয়ে হয়। ধীরে ধীরে ওর সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা কমে যায় এরপর থেকে, এক বছর আগে অস্ট্রেলিয়াতে চলে যাওয়ার পর তো একদমই যোগাযোগ নেই। অথচ ও আমার সবচেয়ে বড় বন্ধু ছিল, একদম সত্যিকারের বন্ধু। একসময় সচ্ছলতা ছিল না আমাদের সংসারে, কিন্তু বন্ধন ছিল। এখন সচ্ছলতা আছে, হারিয়ে গেছে সেই বন্ধন।
আমার অনেক কাছের মানুষ ছিল ও, মনে পড়ে ছোট বেলায় আমাকে গল্প শুনিয়ে ও ঘুম পাড়িয়ে দিত...একই গল্প, সিনড্রেলা, আলাদিন, আলীবাবা...অথচ পুরোনো হয়নি কখনোই। খুব বিরক্ত করতাম ওকে, সবসময়ই, আমাদের বাসার একটামাত্র পুরোনো রেডিওতে ও গান শুনতে গেলেই নব ঘুরিয়ে দিতাম, ও বিরক্ত হলে বিজয়ীর হাসি হাসতাম। মনে আছে, ওর যখন মেট্রিক পরীক্ষা চলে, বাসায় কেউই থাকতো না, আম্মা চলে যেতেন স্কুলে, আব্বা চলে যেতেন টাকার খোঁজে, শুধু আমি কাঁদব বলে ও আমাকে ভাত খাইয়ে পরে যেত পরীক্ষার হলে....ওর হাতে না হলে ভাত খেতাম না আমি।
আরও আগে, যখন ও ক্লাস এইটের বৃত্তি পরীক্ষা দেয়, আজিমপুরের অগ্রণী স্কুলে সিট পড়েছিল, আমার তখনকার দরিদ্র বাবা-মা এক প্যাকেট ফুজি নুডুলস রান্না করে দিয়েছিলেন ওর জন্য। পরীক্ষার মধ্য বিরতিতে যখন ও সেটা খাচ্ছিল, আমি ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকায় বলেছিল- আব্বা আমার আর খেতে ভাল লাগছে না, এটা মাহমুদকে দিয়ে দেন।
বুঝিনি সেদিন, দোলন, কী ভালোবাসা থেকে বলেছিলে সেই কথা, কতটা মমতায় জড়িয়ে ছিলে আমাকে। আজ প্রাচুর্য আমার হাতে, যা ইচ্ছে হয় খেতে পারি, অথচ, অথচ, সেই দিনের মতো আর স্বাদ থাকে না এইসব খাবারে।
অনেক বেশি মমতা নিয়ে জন্মেছিলে তুমি দোলন, এতটা মমতা বিধাতার কেউকে দেয়া উচিৎ নয়, তার প্রিয়জনদের এতে কষ্ট হয়। অসহ্য লাগে এখন সবকিছু আমার, বাসায় যাই না আর নিতান্ত বাধ্য না হলে, যেখানে একদিন তোমার স্পর্শ ছিল, সেখানে গিয়ে নিঃসঙ্গতায় ডুবতে ভালো লাগে না আর।
তুমি যখন চট্টগ্রাম চলে যাও প্রথমবার বাসা ছেড়ে, শূণ্য হয়ে গিয়েছিল আমার পৃথিবীটা, পুরোটা বাসা ফাঁকা ফাঁকা লাগত, সারাদিন একা একা ঘুরে বেড়াতাম, তোমার স্পর্শ মাখা আমাদের সংসারে তোমার ছায়া খুঁজে ফিরতাম।
অনেক গর্ব ছিল- আমার বোন ডাক্তারী পড়ে! মাঝে মাঝে যখন আসতে বাসায়, আমার পৃথিবীটা আবারও রঙিন হয়ে উঠত; আবার বিষাদে ছেয়ে যেত তোমার ছুটি শেষ হয়ে এলে।
অনেক বেশি মনে পড়ছে আজ তোমাকে, হৃদয়ের কতটা গভীরেই না প্রোথিত থাকে মানুষের ভালোবাসার শেকড়। পরিবার বলতে আমি আমাদের বিশাল সংসারে কেউকে বুঝতাম না, বুঝতাম তোমাকে। পৃথিবী এখন অনেক উন্নত, ১৯৯৯ এর মতো আর কার্ড ফোন ব্যবহার করতে হয় না আমাদের....চাইলেই যোগাযোগ করতে পারি, অথচ করা হয় না। ব্যস্ততা কেড়ে নিয়েছে আমাদের ভালোবাসার মূহুর্তগুলো।
অনেক সময় ইচ্ছে করেই কথা বলি না, আমি জানি, কিন্তু তুমি জানো না, তোমার সাথে কথা বলার সময় আমার কন্ঠ ভারী হয়ে আসে, ঝাপসা হয়ে আসে চোখ।
মনে পড়ে, বই পড়তে অনেক ভালবাসতাম দেখে মাঝে মাঝে তুমি আমাকে টিফিনের পয়সা জমানো টাকায় বই কিনে দিতে, অদ্ভূত আনন্দের এক ভুবনে যাত্রা শিখিয়েছিলে আমাকে, দোলন, দারিদ্র্য ছিল তোমারও, যা স্পর্শ করতে পারেনি তোমার বিশাল মহীরুহের মতো মনটাকে। তুমি আমাকে ইঞ্জিনিয়ার হতে বলেছিলে- অন্তত একটা কথা তোমার আমি রেখেছি।
মিসিং ইউ দোলন, মিসিং ইউ সো মাচ.....প্রতিরাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে মনে পড়ে ঐ সব দিনরাত্রি, আমাদের সেই একচালা বাসার চালে নারকেল গাছের পাতার শনশন শব্দ, আর পেছনের বাসার থেকে ঝড়ের দিনে চালের উপর টুপটুপ করে ঝরে পড়া কাঁচা আমের ঢল। মনে পড়ে তোমার চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে পড়ার দিনগুলো, মাঝে মাঝে যখন আমরা আসতাম...ঐ বিশাল মাঠে, পাহাড়ের কোলে বসে সন্ধ্যায় স্মৃতি রোমন্থন।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কতই দূরে সে জায়গা, আজও চট্টগ্রাম শহরে গেলে একবার ঘুরে আসি মেডিকেল কলেজ থেকে, সবকিছু একইরকম আছে, শুধু সময়টা অনেক বদলে গেছে।
জানি না কেমন আছ তুমি, কেমন আছে পৃথিবীর আলোর মুখ দেখার অপেক্ষায় তোমার শরীরে ঘুমিয়ে থাকা ছোট্ট শিশুটি, সম্ভব নয় এখন তোমাকে এক নজর দেখতে অস্ট্রেলিয়া চলে যাওয়া। চেষ্টা করছি অস্ট্রেলিয়াতেই এডমিশন নিতে, সিডনির কাছাকাছি কোথাও, অন্তত যেন তোমার কাছে থাকতে পারি। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা হয়তো বা করা হবে না, একটা স্বপ্নকে বিসর্জন তো আমি তোমার জন্য দিতেই পারি- সারা জীবনে তুমি আমার জন্য অসংখ্য স্বপ্নই তো বিসর্জন দিয়েছ, আবার তোমার সেই মমতার স্পর্শ পেতে এইটুকু আমি করব।
আমাকে আর বলো না স্কাইপিতে বসতে, আমি আমার চোখের জলটুকু তোমাকে দেখতে দিতে চাই না....তোমার বিবাহ বার্ষিকী আনন্দময় হোক, পৃথিবীর সবটুকু সুখ অন্তত একবার তোমাকে ছুঁয়ে যাক-এটা তোমার প্রাপ্য।
খুব ভালো থেক দোলন, অনেক অনেক ভালো থেক। আমি তোমাকে জীবনে আর কখনও বিরক্ত করব না রেডিওর নব ঘুরিয়ে দিয়ে, তোমার রচনার নোট খাতা বালতিতে ভিজিয়ে দিয়ে, তোমার ফিজিক্স বইয়ে তেলের বোতল উল্টে ফেলে....আর যে বিরক্ত করার মতো উপায় নেই তোমাকে। আর আমাকে তুমি নিজের নুডুলস খেতে দিও না, সারাটা জীবন আমি আর এমন কোন ভয়াবহ আবেগে কাঁদতে চাই না। শুধু এইটুকু চাই- তুমি আমাকে চিরদিন আগের মতোই ভালবাস, আমাদের সেই পুরোনো দিনগুলোর মত; তোমার সহস্র অনুভূতির সামান্যটুকুও আমার নেই, এতে দুঃখ করি না একটুও, তোমার মতো আমার একটা বোন আছে-এটাই এই তুচ্ছ জীবনে আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।