আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সম্রাট আকবর ও তার দ্বীন-ই-ইলাহির পতন কাহিনিঃ - শেষ পর্ব ।



”যে ব্যক্ত জাহেরী জ্ঞান কে ছেড়ে শুধু বাতেনকে দুরস্ত করিবার ইচ্ছা পোষন করে সে নিশ্চিৎ জিন্দক (ইসলাম থেকে দুরে বা কাফের)। তাহার কোন বাতেনী হাল হলে তা ভেলকিবাজী ছাড়া আর কিছুই না। জাহেরীভাবে শরীয়তের বিধানগুলি দ্বারা সুসজ্জিত হবার মধ্যেই নির্ভর করে বাতেনী হালের বিশুদ্ধতা ও কবুলিয়ত। ” গান বাজনা নৃত্য ছিল গোমরাহ সূফিগনের প্রতিটি উপদলেরই সাধারন ব্যধি। গান বাজনার সাহায্যে যে গুমরাহী ছাড়া অন্য কিছু পাওয়া যায় না হজরত মোজাদ্দেদ আলফেছানি (রঃ) তাও জানিয়ে দিলেন।

তিনি লিখলেনঃ”নামাজের হকিকত সম্পর্কে অজ্ঞতার কারনেই ইহাদের এক বৃহৎ শ্রেনী অন্তরের ব্যাকুলতা গান-বাজনা,লম্ফঝম্ফ ইত্যাদি দ্বারা নিবারনের প্রয়াস পেয়েছে। অথচ ইহারা ইহাও জানে যে ‘আল্লাহ পাক হারাম বস্তুর মধ্যে শেফা রাখেন নি’-হাদিস। নামাজের কামালত সমুহের বিন্দু পরিমানও যদি তাহারা অবগত হতে পারত তইলে বাদ্য,,গানবাজনা ইত্যাদির প্রতি তারা কোন প্রকার আগ্রহ প্রকাশ করত না। ” দার্শনিকদের ভ্রান্ত মতবাদ জনিত ফেতনা, জাহেলশ্রেনীর মুসলমানদের মধ্যে বিভ্রান্ত ছড়াছিছল। হজরত মোজাদ্দেদ আলফেছানি (রঃ) এইসব ভিত্তিহীন দর্শনের বিরুদ্ধে লিখলেনঃ ” আসমান ও জমিন বিনাশপ্রাপ্ত হবে না বলে দার্শনিকগন যে মত পোষন করেন,অজ্ঞতার জন্য কিছুসংখ্যক মোসলমান দার্শনিকও তাহাদের অনুকুল মত প্রকাশ করে ও কিছু মোসলমান ইহা সমর্থনও করে।

তারা কোরআন মজিদের অখন্ডনীয় দলিলে অবিশ্বাসী এবনহ নবী(আঃ) গনের এজমাকেও তারা স্বীকার করেন না। কোরআন শরীফের বহু আয়াত এই মতবাদের বিরুদ্ধে। তারা জানেন না যে ,কেবল কলেমা শাহাদাত শুধু মুখে উচ্চারন করলেই চলবে না । এইসব বিষয়ের উপর বিশ্বাসো রাখতে হবে। নটুবা ইমান থাকবে না।

” শিয়া মতবাদের বিরুদ্ধেও একইভাবে তিনি বিভিন্ন কোরআন হাদিসের প্রমানাদি জনসমক্ষে পেশ করতে লাগলেন। ইতমধ্যে শাহজাদা শাহজাহান এসে হজরত মোজাদ্দেদ আলফেছানি (রঃ) এর আনুগত্য প্রকাশ করলেন ও হযরতের খাস ভক্তদের মধ্যে সামিল হলেন। শাহজাদা সুন্নি ছিলেন। সম্রাজ্ঞী নুরজাহান রোষানলে জ্বলিতে লাগলেন। সেরহিন্দের এক ফকির তার শিয়া রাজ্য গড়ার সপ্ন সহ সব পরিকল্পনা লন্ডভন্ড করে দিতেছে।

হুকুমতের অধিকাংশ আমির ওমরাহগনকে কব্জাকরে ফেলছে। শাহজাহানও হয়েছে তার ভক্ত। আর ফকিরকে বাড়িতে দেয়া যায় না। যে করেই হোক তার সমস্ত উদ্দেশ্যকে ব্যর্থ করতে হবে। তার পৃষ্ঠপোষকতায় লালিত শিয়াদের নেতৃস্হানীয় ব্যক্তিবর্গও মহা দুশ্চিন্তায় পড়লেন।

সবাই হজরত মোজাদ্দেদ আলফেছানি (রঃ) এর বিরুদ্ধে ষঢ়যন্ত্রে লিপ্ত হলেন। সবাই মিলে ঠিক করলেন নুরজাহানের ভ্রাতা আসফ খানের দ্বারা বাদশাহ জাহাঙ্গীরকে বুঝাতে হবে যে সেরহিন্দের ফকির মোঘল হুকুমতের জন্য এক হুমকিস্বরূপ। সে বড়ই অহংকারী। শাহী আদবের সে বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা করে না। বাদশাহর মেজাজ বুঝে আসফ খান একদিন তাকে বললেন , শায়েখ আহমেদের উদ্দেশ্য ও প্রভাব সম্পর্কে সতর্ক থাকা প্রয়োজন।

শাহী দরবার হতে শুরু করে হুকুমতের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাহার লক্ষ লক্ষ মুড়িদান। তারা সকলেই তাহাদের পীরেরে জন্য জান কোরবান করতে প্রস্তুত। আপনার সেনাবাহিনিরও এক বিড়াট অংশকে তিনি করায়ত্ব করে ফেলেছেন। সেনাবাহিনীকে সম্পুর্নরূপে তার দলভুক্ত করার জন্য তিনি শায়েখ বদিউদ্দিন নামে একজন খলিফাকে স্হায়ীভাবে নিযুক্ত করেছেন। তিনি সৈন্যদের সহিত নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করেন এবং সকলকে শায়েখ আহমদের দলে ভিড়াইবার জন্য উৎসাহিত করেন।

বাদশাহ মনোযোগ দিয়ে সব শুনলেন। তার মনে সন্দেহ সৃষ্টি হল। এমতাবস্হায় কি করা যায় তিনি তাহাই চিন্তা করতে লাগলেন। আসফ খানের পরামর্শে বাদশাহ শায়েখ বদিউদ্দিনের নিকট সৈন্যদের গমনাগমন বন্দ্ধ করার নিষেধাজ্ঞা জারী করলেন এবং তার শায়েখ আহমদে সেরহিন্দ এর নিকট থেকে যদি কোন বাধা আসে তবে তাকে বন্দী করার নির্দেশ দিলেন। শায়েখ বদিউদ্দিন মহা অসুবিধায় পড়িলেন।

হজরত মোজাদ্দেদ আলফেছানি (রঃ) এর নির্দেশ মত তিনি সেনাবাহিনীর লোকদেরকে ইসলামের প্রকৃত উদ্ধারপ্রাপ্ত দল সুন্নত ওয়াল জামাতের আকিদা বিশ্বাস ও নকশবন্দিয়া তরিকার শ্রেষ্ঠত্বের ছায়াতলে একত্রিত করার দায়িত্বকে সমস্ত জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহন করেছিলেন। কিন্তু শাহী নিষেধাজ্ঞা সৈন্যদের সঙ্গে তার যোগাযোগ বন্দ্ধ করে দিল। তিনি মোর্শেদ হজরত মোজাদ্দেদ আলফেছানি (রঃ) এর নিকট পরিস্হিতির জটিলতা সম্পর্কে জানিয়ে এই স্হান পরিত্যাগের অনুমতি চাইলেন। কিন্তু মোর্শেদ উনাকে অনুমতি দিলেন না। বরং পুর্ন উদ্যমে সৈন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সত্যের প্রচার কার্জ চালিয়ে যাওয়ার নির্দশ দিলেন।

শায়েখ বদিউদ্দিন কাজ করতে আরাম্ভ করলেন। কিন্তু বিপত্তি দেখা দিল কিছুদিন পর। । বাদশাহ গুপ্তচর নিয়োগ করলেন। গুপ্তচরগন হজরত মোজাদ্দেদ আলফেছানি (রঃ) ও শায়েখ বদিউদ্দিনের মধ্যে পত্র যোগাযোগ বন্দ্ধ করে দিল।

শায়েখ বদিউদ্দিন অত্যন্ত পেরেশান হয়ে পরলেন। মোর্শেদের সঙ্গে যোগাযোগ নেই। কোন প্রকার সংবাদ আদান প্রদান করার উপায়ও নেই। কিভাবে কি করবেন ভেবে উঠতে পারলেন না। অনেক চিন্তা করে তিনি সেরহিন্দ শরীফ গিয়ে নিজ মোর্শেদ হজরত মোজাদ্দেদ আল ফেসানি(রঃ) এর খেদমতে হাজির হলেন।

তাকে দেখে হজরত মোজাদ্দেদ আল ফেসানি(রঃ) অসন্তুষ্ট হলেন এবং তাকে ভৎসর্না করলেন। তাই তিনি পুনরায় পুর্বস্হানে গিয়ে তার প্রতি অর্পিত দায়িত্ব সম্পাদনে মনোনিবেশ করলেন। কুচক্রী মহল আর একটি মোক্ষম সুযোগ পেল। এই ঘটনা তারা বাদশাহর নিকট বর্ননা করার পর বলিলেন,” নিশ্চয়ই গোপনে গোপনে আপনার হুকুমতে ইনকেলাব ঘতাতে এক বিড়াট ষঢ়যন্ত্র হছ্ছে। অবিলম্বে এই ষঢ়যন্ত্রের মুলোৎপাটন না করলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।

” বাদশাহ এই সব কথা শুনে ভীত হয়ে পরলেন এবং তার মধ্যে রাজ্য হারাবার ভয় দেখা দিল। তাই চক্রান্তকারীদের পরামর্শে রাজধানীর আমির ওমরাগনের মধ্যে যারা হজরত মোজাদ্দেদ আল ফেসানি(রঃ) এর ভক্ত তাদেরকে রাজ্যের বিভিন্ন স্হানে বদলি করে দেয়া হল এবং হজরত মোজাদ্দেদ আল ফেসানি (রঃ) বাদশাহ কে সম্মানী সেজদা করে কিনা তা যাচাই করার জন্য রাজ দরবারে আমন্ত্রন জানান হলো। হজরত মোজাদ্দেদ আল ফেসানি আহমদ ফারুকি সেরহিন্দ (রঃ) তার বাতেনী কাশফের মাধ্যমে আগেই জানতে পেরেছিলেন যে বাদশাহ ও তার দরবারীদের একাংশ তার বিরুদ্ধে ষঢ়যন্ত্রে লিপ্ত। হজরত মোজাদ্দেদ আল ফেসানি (রঃ) তার পাচজন বিশিষ্ট খলিফা সহ শাহী দরবারে প্রবেশ করে বাদশাহকে সেজদা করাতো দুরের কথা তাকে সালামও জানালেন না। বাদশাহ ক্ষিপ্ত হয়ে সেজদা ও সালাম না করার কারন জানতে চাইলেন।

হজরত মোজাদ্দেদ আল ফেসানি(রঃ) বললেন, আপনার দরবারেতো সালাম দেবার প্রথা নেই, আর সেজদা তো একমাত্র আল্লাহর জন্য এবং আমার মাথা মানুষের সামনে নত হয় না। বাদশাহ ক্ষিপ্ততা পরিহার করে সাধারন ভাবে বললেন,বেশ। আপনার জন্য পুর্নাঙ্গ সেজদার হুকুম উঠিয়ে নেয়া হল । আপনি শির সামান্য নত করলেই আমি সন্তুষ্ট হব। হজরত মোজাদ্দেদ আল ফেসানি(রঃ) পুর্বের ন্যায় এবারও দৃঢ়তার সঙ্গে জবাব দিলেন ,’অসম্ভব’।

বাদশাহর শাহী মর্যাদায় প্রচন্ড আঘাত লাগল। বাদশাহ প্রবল রোষভরে নির্দেশ দিলেন ,”ইহার মস্তক জোর করে নত করে দাও”। অনেক লোক বাদশাহর হুকুমে এগিয়ে আসল। তাহারা অনেক চেষ্টা করল,কিন্তু কিছুতেই হজরত মোজাদ্দেদ আল ফেসানি(রঃ) এর মস্তক এতটুকুনও অবনত করতে পারল না। এই দৃশ্য দেখে বাদশাহর ক্রোধ আরো বেড়ে গেল।

বাদশাহ হজরত মোজাদ্দেদ আল ফেসানি(রঃ) কে কয়েদ করে গোয়ালিয়র কেল্লায় প্রেরন করার নির্দেশ দিলেন। আল্লাহর ওলীগন নবী রাসুলগনের প্রকৃত প্রতিনিধি। তাই হজরত মোজাদ্দেদ আল ফেসানি(রঃ) গোয়ালিয়র দুর্গে বন্দী হয়েও কোন বদ্‌দোয়া করলেন না। বরং আল্লাহপাকের ইছ্ছার প্রতি পরিপুর্ন সন্তুষ্ট রইলেন। হজরত ইউসুফ (আঃ)ও কারাবরন করেছিলেন।

তাই সুন্নত প্রতিপালনের তৌফিক পেয়ে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করলেন। বন্দীশালা পরিনত হল ইসলাম প্রচারের কেন্দ্রে। শত শত চোর,ডাকাত ও দুষ্ক্রৃতিকারীরা ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় নিতে লাগল। হজরত মোজাদ্দেদ আল ফেসানি(রঃ) এর কারাবরনের সংবাদ ধিরে ধিরে সমস্ত খলিফা ও ভক্তগনের নিকট পৌছতে লাগল। প্রিয় মোর্শেদের এই কষ্ট দেখিয়া সবার অন্তরে ক্ষোভের আগুন জলে উঠল।

বিভিন্ন জন বিভিন্নভাবে বাদশাহর সহিত যোগাযোগ করলেন। খলিফাদের মধ্যে কেহ কেহ বদ্‌দোয়া করার অনুমতি চেয়ে পত্র লিখলেন। হজরত মোজাদ্দেদ আল ফেসানি(রঃ) কিছুতেই তার অনুমতি দিলেন না। তিনি আপন পুত্র খাজা মোহাম্মদ মাসুম (রঃ) কে লিখলেন, ‘হে প্রিয় বৎস ! পরীক্ষার সময়টুকু কষ্টকর ও অসহনীয় হলেও মুল্যবান, যদি ইহা সুষ্ঠভাবে সম্পাদন করার ক্ষমতা পাওয়া যায়। ” আরেক ভক্তের কাছে লিখলেন, ‘প্রকৃত গজব আল্লাহপাকের দুশমনদের জন্য নির্ধারিত।

আল্লাহপাকের আশেকদের জন্য উহা অবিকল রহমত- যদিও তাহা বাহ্যিকভাবে গজব বলে অনুভুত হয়। ইহার দ্বারা এত কল্যান সাধিত হয় যার প্রকৃত বর্ননা সম্ভব নয়। ’ এদিকে হঠাৎ হজরত মোজাদ্দেদ আল ফেসানি(রঃ) এর ভক্ত আমিরগন মহব্বত খানের নেতৃত্বে বাদশাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা করল। এক বিরাট সৈন্যবাহিনী বিদ্রোহের পতাকাতলে সম্মিলিত হয়ে রাজধানি অভিমুখে রওয়ানা হল। বিদ্রোহিদের চরম শিক্ষা দেয়ার জন্য বাদশাহ যুদ্ধের আদেশ দিলেন।

বিপুলসংখ্যক সৈন্য বিদ্রোহিদের শায়েস্তা করার জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে চলল। বাদশাহ নিজে সেনাপতি হলেন। বিশাল মোজাহিদ বাহিনিও এগিয়ে চলেছে। সবারই মুখে সত্যের দীপ্তি জ্বল জ্বল করছে। অসত্যের বিরুদ্ধে সত্যের সংগ্রাম ।

মোঘল বাদশাহর অহংকার ধুলায় মিশিয়ে দিতে হবে। প্রিয় মোর্শেদের প্রতি অত্যাচারের সমুচিত শিক্ষা দিতে হবে। ঝীলাম নদীর তীর । যুদ্ধ শুরু হল। শাহী বাহিনী বিদ্রোহী বাহিনীকে আক্রমন করল।

বীরবিক্রমে ঝাপিয়ে পড়ল বিদ্রহী বাহিনীর উপর। মহব্বত খান প্রতি আক্রমন না করে কৌশলমুলক পলায়ন করলেন। বাদশাহ তাহার পশ্চাতে ধাবিত হলেন। শাহী বাহিনির ভিতর হজরত মোজাদ্দেদ আল ফেসানি(রঃ) এর অনেক ভক্ত ছিলেন। বাদশাহর তা জানা ছিল না।

বাদশাহ যখন মহব্বত খান কে ধাওয়া করার জন্য নিজ বাহিনী থেকে থেকে দুরে চলে গেলেন তখন মহব্বদত খান শাহী বাহিনতে থাকা হজরত মোজাদ্দেদ আল ফেসানি(রঃ) এর ভক্ত সৈন্যদের সহায়তায় সহজেই বাদশাহকে ঘিরে ফেলে বন্দী করলেন। শাহী বাহিনী পরাজিত হল। বাদশাহ বন্দী হলেন। মহব্বত খানের সমস্ত সৈন্যদের মনে বিজয়ের আনন্দ। সবারই মনে আশা ,এইবার দিল্লীর মসনদে তাহারা হজরত মোজাদ্দেদ আল ফেসানি(রঃ) কে উপবেশন করাবেন।

মহব্বত খানের মনেও সেই আশা। তিনি হজরত মোজাদ্দেদ আল ফেসানি(রঃ) এর নির্দেশের জন্য প্রতিক্ষা করতে লাগলেন। তিন দিন কেটে গেল। অবশেষে হজরত মোজাদ্দেদ আল ফেসানি(রঃ) নির্দেশ আসল, ” ফেতনা ফাসাদ বন্দ্ধ করুন। বিশৃংখলা আমার কাম্য নয়।

পুর্বের মত বাদশাহর অনুগত হয়ে চলুন। ” মহব্বত খানের বিস্ময়ের অবধি রইল না। কোন বাধা নেই বিপত্তি নেই । দিল্লীর মসণদ শুন্য। ইছছা করলেই তাতে আরোহন করা যায়।

কিন্তু কি করা। প্রিয় মোর্শেদের আদেশ। মহব্বত খান বাদশাহকে মুক্ত করে দিলেন এবং প্রিয় মোর্শেদের নির্দেশ তাকে জানিয়ে দিয়ে পুর্বের মত শাহী আনুগত্যের সহিত কর্তব্য সম্পাদন করে যাওয়ার ইছছা প্রকাশ করলেন। শুধু তাজিমি সেজদা করলেন না। নুতন বিচিত্র অভিজ্ঞতা নিয়ে বাদশাহ জাহাঙ্গীর রাজধানীতে ফিরে আসলেন।

পরাজিত হয়েও তিনি জয়লাভ করলেন। বন্দী হয়েও তিনি স্বসম্মানে মুক্তি পেলেন। এ কেমন বিস্ময় ! সম্প্রতি বাদশাহ কেমন যেন হয়ে গেছেন। যুদ্ধে তিনি সত্যিই কি জয় লাভ করেছেন। ইহা কি জয় না পরাজয়? প্রায় দুই বৎসর ধরিয়া তিনি তিনি যাকে বন্দী করে রেখেছেন ,তিনি তাকে তিন দিনও বন্দী থাকতে দিলেন না।

কিইবা তার অপরাধ। শাহী আদব কি মানবতা থেকেও বড় ?দুনিয়ার কোনপ্রকার শান শওকতের বিন্দু পরিমান মোহও তার নেই। সেই নির্লোভ নির্মোহ আল্লাহর ফকিরকে বন্দী করার কি অধিকার তার আছে ?তিনি যাকে কষ্ট দিতে চেয়েছেন সেই আল্লাহর ফকির বরাবরই তার কল্যান কামনা করেছেন। পরাজয়- তার শোচনীয় পরাজয় হয়েছে। মোঘল বাদশাহর দাম্ভিকতা চুর্ন-বিচুর্ন হয়ে গেল।

বিশাল হিন্দুস্হানের বাদশাহ হয়েও তার অন্তর কত সংকীর্ন! প্রকৃতপক্ষে ফকিরই মহা-বাদশাহ!! বাদশাহর অন্তরে অনুতাপের অনল দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো। শাহজাদা শাহজাহান বহুদিন হতে হজরত মোজাদ্দেদ আল ফেসানি(রঃ) এর মুক্তির জন্য সুপারিশ করছিলেন। বাদশাহও এবার ভাবলেন হজরত মোজাদ্দেদ আল ফেসানি(রঃ) কে এবার মুক্তি দিতে হবে। সত্য বুঝতে অনেক বিলম্ব হয়েছে । আর নয়।

বাদশাহ হজরত মোজাদ্দেদ আল ফেসানি(রঃ) কে মুক্তির আদেশ প্রদান করলেন এবং তাকে শাহী দরবারে তশরীফ আনার জন্য আমন্ত্রন জানালেন। হজরত মোজাদ্দেদ আল ফেসানি(রঃ) মুক্ত হলেন। কিন্তু বাদশাহের শিত সাক্ষাতের পুর্বে সাতটি শর্ত প্রদান করলেন। তিনি জানালেন ,শর্তগুলি মেনে নিলে তিনি বাদশাহর সহিত সাক্ষাৎ করতে প্রস্তুত আছেন। শর্ত সমুহঃ ১।

দরবার হতে তামিজি সেজদার প্রচলন উঠিয়ে দিতে হবে। ২। ভগ্ন ও বিরান মসজিদ সমুহ আবাদ করতে হবে। ৩। গরু জবেহ করিবার উপর নিষেধাজ্ঞা রহিত করতে হবে।

৪। ইসলামী শাসন ব্যবস্হা কায়েমের জন্য বিভিন্ন স্হানে কাজী,মুফতি নিয়োগ করতে হবে। ৫। জিজিয়া কর পুনরায় প্রবর্তন করতে হবে। ৬।

সকল প্রকার বেদাত কার্যকলাপ বন্দ্ধ করে দিতে হবে। ৭। রাজবন্দীদের মুক্তি দিতে হবে। বাদশাহ সমস্ত শর্ত সমুহ নির্দিধায় মেনে নিলেন। শর্ত সমুহ বাস্তবায়িত করার জন্য শাহী ফরমান জারী করা হল।

রাজ্য হতে তামিজি সেজদা উঠে গেল। গরু জবেহ এর উপর নিষেধাজ্ঞা রহিত হল। জিজিয়া কর পুনঃপ্রবর্তিত হল। সকল প্রকার বেদাত কার্জকলাপ কঠোর হস্তে দমন করার ব্যবস্হা করা হল। বাদশাহ নিজেও আম দরবারের সম্মুখে একটি মসজিদ নির্মান করালেন।

হজরত মোজাদ্দেদ আল ফেসানি(রঃ) বাদশাহর সহিত সাক্ষাৎ করার জন্য রাজধানী আসলেন। বাদশাহ মহাসমাদরে ও স্বসম্মানে তাহাকে দরবারে নিয়ে আসলেন। বাদশাহ তাহার নিকট নিজের অপরাধ স্বীকার করে মাফ চাইলেন। অতপর হজরত এর পবিত্র হস্তে বায়াত গ্রহন করলেন। শাহজাদা শাহজাহানকেও তাহার পবিত্র খানকায় ভর্তি করার ইছছা ব্যক্ত করলেন।

নামাজের ওয়াক্ত হল। হজরত মোজাদ্দেদ আল ফেসানি(রঃ) এবং বাদশাহ নবনির্মিত মসজিদে নামাজ আদায় করলেন। কইয়ুমে জামান ইমামে রাব্বানী হজরত মোজাদ্দেদ আল ফেসানি শায়েখ আহমদ ফারুকি সেরহিন্দ (রঃ) হলেন নামাজের ইমাম – আর বিশাল হিন্দুস্হানের বাদশাহ জাহাঙ্গীর হলেন তার মোক্তাদি। সম্রাজ্ঞী নুরজাহানের বিষদাত ভেঙ্গে গেল। তার সমস্ত পরিকল্পনাই যে ব্যর্থ হয়ে গেল।

যে নক্‌সবন্দিয়া তরিকা ও তার প্রচার চিরতরে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিবার পরিকল্পনা তিনি করেছিলেন ,শাহী দরবারেও সেই তরিকা বিজয় গৌরবে প্রবেশ করল। বাদশাহ নিজেও আত্নসমর্পন করলেন সেরহিন্দের সেই ফকিরের কাছে। কিন্তু নুরজাহান তবুও হার ছারলেন না। যতকিছুই হউক শাহজাহানকে মসনদে কিছুতেই বসতে দেয়া যাবে না। নুরজাহান শাহজাদা সম্পর্কে ক্রমাগত বাদশাহর অন্তরে বিষ ঢালতে লাগলেন।

বাদশাহ শাহজাদার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠলেন। দিল্লীর মসনদে বসার বসার ক্ষমতা যে শাহজাহানের নেই ,স্ত্রীর কথায় এই ধারনাও তাহার অন্তরে বদ্ধমুল হয়ে গেল। শাহজাহান বাদশাহর ভুল ভাঙ্গাবার জন্য অনেক চেষ্টা করলেন। কিন্তু কিছুতেই পিতার মন গলাতে পারলেন না। পরিস্হিতি এমন আকার ধারন করলো যে পিতার নিকট তার কোনই স্হান রইল না।

শেষ পর্যন্ত শাহজাহান পিতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করলেন। পিতা পুত্র যুদ্ধ শুরু হল। নওজোয়ান শাহজাদার বাহিনী অনেক শক্তিশালী। বাদশাহর পরাজয় হয় হয়। বাদশাহ হজরত মোজাদ্দেদ আল ফেসানি(রঃ) এর নিকট দোয়া চাইলেন।

তিনি দোয়া করলেন। সহসা যুদ্ধ পরিস্হিতির বিপরীত মোর নিল। শাহজাদার শক্তিশালী বাহিনী পরাজিত হল। শাহজাদা হজরত মোজাদ্দেদ আল ফেসানি(রঃ) এর দোয়ার সংবাদ জানতে পেরে সাথে সাথেই মোর্শেদের নিকট গিয়ে আরজ করলেন, ”হজরত আমিতো আমার পিতার পুর্ব থেকেই আপনার খাদেম। কি কারনে আপনি আমার প্রতি বিরূপ হয়ে আমার বিরুদ্ধে দোয়া করলেন।

আপনার কারামুক্তির জন্য আমি পিতার নিকট কতভাবে চেষ্টা তদবির করেছি। ” হজরত মোজাদ্দেদ আল ফেসানি(রঃ) তাকে শান্ত হবার উপদেশ দিয়ে বললেন,”আর বিলম্ব নেই কোনপ্রকার চিন্তা করো না । অল্পকাল পরেই তোমার পিতার জাহেরী মসনদ তোমার করতলগত হবে । আর আমার বাতেনী মসনদে অধিষ্ঠিত হবে আমার পুত্র মোহাম্মদ মাসুম। ” গ্রন্হ সহায়তা- হযরত মোজাদ্দেদ আলফেছানী(রঃ) এর চিঠি পত্রের সংকলন গ্রন্হ মকতুবাদ শরীফ (১ম খন্ড)।

এবং মোঃ মামুনুর রশীদ রচিত -নূরে সেরহিন্দ- গ্রন্হ থেকে নেয়া। প্রকাশক-সেরহিন্দ প্রকাশনী, উয়ারি ,ঢাকা, -ধন্যবাদ

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।