আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সম্রাট আকবর ও তার দ্বীন-ই-ইলাহির পতন কাহিনিঃ -



সম্রাট আকবর ও তার দিন-ই-ইলাহির পতন কাহিনি - ইমামে রাব্বানী হযরত মোজাদ্দেদ আলফেছানি শায়েখ আহমদ ফারুক সেরহিন্দ (রাঃ) ছিলেন দ্বিতীয় সহস্রাব্দের মোজাদ্দেদ বা সংস্কারক। তিনি ১৪ই শাওয়াল ৯৭১ হিজরিতে ভারতের সেরহিন্দ শহরে জন্ম গ্রহন করেন। তিনি আকবর ও জাহাঙ্গীর দুই অত্যাচারী ইসলাম বিরোধী সম্রাটের মধ্যবর্তী সময়ে মোজাদ্দেদ হিসাবে আত্নপ্রকাশ করেন। সম্রাট আকবর ছিলেন ইসলাম ধর্মের ঘোড় বিরোধী। তার শাসনামলে মোসলমানদের দুরবস্হার কোন সীমা ছিল না।

সম্রাট আকবর ইসলাম ধর্মের পরিবর্তে নতুন এক ধর্মের প্রবর্তন করেন। ইহা ছিল স্পষ্টতই এক কুফরী ধর্ম অথচ এই নতুন ধর্মের নাম দেওয়া হলো ”দ্বীন-ই-ইলাহী”। এই নতুন ধর্মের প্রধান উপাদান ছিল সূর্যের উপাসনা করা। বাদশাহ প্রভাতে,দ্বিপ্রহরে,সন্ধায় ও অর্ধরাত্রে বাধ্যতামূলকভাবে সূর্য পূজা করিতেন। তিনি তিলক লাগাতেন ও পৈতা পরতেন।

সূর্যদয়ের সময় ও মধ্যরাত্রিতে নহবত ও নাকাড়া বাজান হতো। এই নতুন ধর্মে সূর্যের নাম উচ্চারনকালে ‘জাল্লাত কুদরাতুহু’ বলা হতো। বাদশাহ বিশ্বাস করতেন যে ,সূর্য বাদশাহ গনের অভিবাবক ও হিতাকাঙ্খী। তিনি তাই হিন্দুদের কাছ থেকে সূর্যকে বশীভূত করার মন্ত্র শিখেছিলেন। মাঝরাত্রে ও ভোরে তিনি এই মন্ত্র পাঠ করতেন।

শিবরাতে তিনি যোগীদের আসরে সমস্ত রাত্রি বসে থাকতেন এবং বিশ্বাস করতেন যে ,ইহাতে আয়ু বৃদ্ধী পায়। ‘ব্রাক্ষ্মদান’ নামক জনৈক ব্রাক্ষ্মনকে বাদশাহ রাজকবি নিযুক্ত করেন। ইতিহাসে তিনিই ”বিরবল” নামে পরিচিত । তারই পরামর্শে ‘দেবী’ নামক জনৈক হিন্দু দর্শনিক বাদশাহর সহিত মেলামেশা করার সুযোগ পায়। রাত্রিকালে বাদশাহর অন্দরমহলেও এই দার্শনিকের অবাধ যাতায়াত ছিল।

বাদশাহ তাহার সহিত সাক্ষাৎ করার জন্য সর্বদা উদগ্রীব থাকতেন। এই দেবী ও গৌতম নামের জনৈক ব্রাক্ষ্মনের কাছ থেকে বাদশাহ মূর্তি,সূর্য,আগুন,ব্রক্ষ্মা,মহামায়া,বিষ্ঞু, কৃষ্ঞ ও মহাদেব পূজার কায়দা কানন শুনে বড়ই উৎফুল্ল হতেন এবং এইসব গ্রহনও করতেন। ইহা ছারা এই ধর্মে আগুন,পানি,গাছ,গাভী পূজা করা হত। নক্ষত্র পূজার ব্যাপারেও বাদশাহ অত্যধিক বাড়াবাড়ি করতেন। হিন্দুদের পুনর্জন্মবাদে বিশ্বাস করাও ছিল এই ধর্মের কর্তব্য।

হির বিজয় সূরী নামক জনৈক সাধুকে বাদশাহ ‘জগৎগুরু’ উপাধি দেন। সম্রাট আকবর হিন্দুদের পূনর্জন্মবাদে বিশ্বাস করতেন। মৃত্যুর পর তিনিও পুনরায় অন্য কোন সিংহাসনে আরোহন করবেন বলে বাদশাহ বিশ্বাস করতেন। ব্রাক্ষ্মনগন তাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল যে ,শক্তিশালী বাদশাহর শরীরে আত্নার জন্ম হয় এবং কামেল মণীষীগনের আত্না মৃত্যুর সময় মস্তকের তালু দিয়া বাহির হয়ে যায়। এই ধারনার বশবর্তী হয়ে তিনি মাথার তালুর চুল কামাইয়া ফেলিতেন এবং মস্তকের চারিদিকে চুল রেখে দিতেন।

বাদশাহ জৈন সাধুদের যথেষ্ট প্রভাবিত হয়েছিলেন। সাধু সঙ্গ লাভের পর হতে তাহার নিকট সব সময় এমনকি ভ্রমনের সময়েও একজন জৈন সাধু থাকত। ”হির বিজয়সুরী” নামক এক সাধুকে তিনি ‘জগৎগুরু’ উপাধী দিয়েসিলেন। নন্দা বিজয়সূরী নামক এক সাধুকে তিনি ‘খশফহম’ উপাধী দিয়েছিলেন। হির বিজয় সূরীকে খুশী করবার জন্য তিনি ধর্মপর্ব ‘পর্যুষনে’ বার দিন জীব হত্যা নিষিদ্ধ করবার ফরমান জারী করেছিলেন।

জৈন ধর্ম অনুযায়ী বাদশাহ নিজেও মাংশ ভক্ষন ত্যাগ করেছিলেন। এ বিষয়ে বাদশাহ স্বয়ং সূরীজিকে এক পত্র প্রেরন করেন। উহাতে তিনি সূরীজি কতৃক কিরূপ প্রভাবিত হন তাহার পরিচয় পাওয়া যায়। পত্রটি নিম্নরূপঃ ”আমি আপনার উপদেশ অনুযায়ী সম্পূর্নরূপে জীবহিংসা পরিত্যাগ করতে পারি নি। তবে আমি আগের চেয়ে এখন অনেক কম মাংশ আহার করি।

আপনি হয়ত জানেন যে , আমি ফতেহপুর হতে আজমীর পর্যন্ত রাজপথের পার্শ্বে প্রতি একশ ক্রোশ পর পর একশত চৌদ্দটি স্তম্ভ নির্মান করেছি। ঐগুলি প্রায় ছত্রিশ হাজার হরিনের শিং দিয়ে সজ্জিত করেছি। ঐগুলি আমি নিজ হাতে শিকার করেছিলাম। আমি এত জীবের প্রান সংহার করেছি। আমার মতো পাপী কেহ নেই।

ইহা ছাড়া আমি প্রতিদিন নানা প্রকার জীবের মাংশ সহ পাচশত চড়াই পাখীর জিহ্বা দ্বারা উদর পূর্তি করতাম। ঐ কথা ভাবিতে গেলেও এখন আমি আতংকিত হয়ে উঠি। আপনার শ্রীমুখের অমিয়বানী আমাকে মাংসাহারে অরুচি এনে দিয়েছে। এখন বৎসরে ছয়মাস বা ততোধিক সময় আমি মাংস আহার করি না। -” অগ্নিপূজকদের দারাও বাদশাহ যথেষ্ট প্রভাবিত হয়েছিলেন।

তাহার আদেশে দরবারের সন্মুখে সর্বক্ষন অগ্নি প্রজ্জলন করবার ব্যাবস্হা করা হয়। ঘন্টাধ্বনি প্রভৃতি গ্রহন করা হয় খৃষ্টানদের নিকট থেকে। মোটকথা ইসলাম ছাড়া অন্য সব ধর্মই বাদশাহর চোখে সুন্দর মনে হত। তার চোখে সবচেয়ে সুন্দর মনে হতো হিন্দুধর্ম। তাই তার নতুন ধর্ম ‘দ্বীন-ই-ইলাহির’ বেশীর ভাগ উপাদানই গৃহীত হয়েছিল হিন্দুধর্ম হতে।

তাই সঙ্গত কারনেই হিন্দু এবং রাজপুতদের নিকটই এই অদ্ভুত ধর্ম সমাদর লাভ করেছিল সবচাইতে বেশী। সম্ভবত বাদশাহ আকবেরর কাম্যও ছিল তাই। দীন-ই-ইলাহির মূলমন্ত্র ছিল ”লা ইলাহা ইল্লালাহু আকবারু খলিলুল্লাহì”যাহারা নুতন ধর্মে দাখিল হত তাদেরকে এরূপ শপথ বাক্য উচ্চারন করতে হতো- ”আমি অমুকের পুত্র অমুক এতদিন বাপ দাদাদের অনুকরনে ইসলাম ধর্মের উপর প্রতিষ্ঠত ছিলাম, এখন স্বেছ্ছায় ও সগ্গানে পূর্ব ধর্ম পরিত্যাগ করে ‘দীন-ই-ইলাহি’ গ্রহন করিতেছি এবং এই ধর্মের জন্য জীবন,সম্পদ ও সম্মান বিসর্জন দিতে প্রস্তুত আছি। ” দীন-ই-ইলাহির লোকেরা চিঠিপত্রের শিরোনামে ‘আল্লাহ আকবর’ লিখিত এবং পরস্পরের সাক্ষাতের সময় সালামের পরিবর্তে একজন বলত ‘আল্লাহ আকবর” এবং অপরজন এর জবাবে বলত ‘জাল্লাজালালুহু’। বাদশাহ তাহাদিগকে শিজরা স্বরূপ তাহার একখানি প্রতিকৃতি প্রদান করতেন।

তারা বাদশাহর এই প্রতিকৃতি পরম শ্রদ্ধাভরে নিজ নিজ পাগড়ীতে বসিয়ে রাখত। বাদশাহ যে সব পুজাপাবন করতেন অনুসারীগনকেও সেই সব করতে হত। উপরন্তু তাদেরকে বাদশাহকেও সেজদা করতে হত। ভন্ড সূফীদের সর্দার ‘তাজুল আরেফিন’ বাদশাহকে সেজদা করা ওয়াজেব বলে ফতোয়া দান করেন। এই সেজদার নাম করন করা হয় ‘জমিন বোছ’।

তিনি বলেন বাদশাহর প্রতি সন্মান প্রদর্শন করা ফরজে আইন এবং চেহারা কেবলায়ে হাজত ও কাবায়ে মুরাদ। হিন্দুস্হানের ভ্রষ্ট সূফীদের কার্যপ্রনালী দলীলরূপে খাড়া করে তিনি এর ব্যাখ্যা প্রদান করেন। সাধারন ব্যক্তিছাড়াও বিশিষ্ট আলেমগনও এই শেরেকি কার্যে অভ্যস্হ ছিলেন। এই নুতন ধর্মে সূদ ও জুয়া ছিল হালাল। খাছ দরবারে জুয়া খেলার জন্য একটি ঘর নির্মান করা হয় এবং জুয়াড়ীদেরকে রাজকোষ থেকে সুদি কর্জ দেয়া হত।

মদ্যপান করাও হালাল সাব্যস্হ করা হয়। বাদশাহ স্বয়ং দরবারের নিকট একটি শরাবখানা খুলে দেন। নওরোজ অনুষ্ঠানে অধিকাংশ আলেম,কাজী ও মুফতিগনকে শরাব পান করতে বাধ্য করা হত। এই সব অনুষ্ঠানে বিভিন্ন লোকের নামে পেয়ালা নির্বাচিত হত। ফৈজি বলতেন , ”আমি এই পেয়ালাটি পান করছি ফকিহদএর অন্ধ বিশ্বাসের নামে।

-” এই ধর্মে দাড়ি মুন্ডনের ব্যাপারে অত্যধিক গুরুত্ব দেয়া হত। বাদশাহ এই ব্যাপারে রাজপুত পত্নীদের দ্বারা প্রভাবান্বিত হন। নাপাকির জন্য গোসল করা ইসলামে ফরজ। কিন্তু বাদশাহ আকবরের ধর্মে এর বিপরিত মত প্রকাশ করা হয়। বলা হয় যে ‘মনী’ উৎকৃষ্ট মানুষ সৃষ্টির বীজ।

তাই গোসল করিয়া সহবাস করাই উত্তম। তাহা ছারা বিবাহ সম্পর্কে আইন করা হয় কেহ তাহার চাচাত,মামাত,ফুফাত ইত্যাদি সম্পর্কের বোনকে বিবাহ করতে পারবে না। ষোল বৎসর পুর্বে বালক এবং চৌদ্দ বৎসরের পুর্বে বালিকাদের বিবাহ দেওয়া চলিবে না এবং কেহ একাধিক বিবাহ করিতে পারিবে না। যুবতী নারীদের বাধ্যতামুলকভাবে চেহারা খুলিয়া পথ চলা ছিল এই ধর্মের আইন। শহরের বাহিরে বিভিন্ন যায়গায় পতিতাদের বসতি স্হাপন করিয়া ব্যাভিচারকে আইন সঙ্গত করা হয়।

পতিতালয় গুলির নাম দেয়া হয় ‘শয়তানপুর’। এই সব স্হানে পুলিশ প্রহরার ব্যবস্হা করা হয়। খৎনারূপ সুন্নতকে মিটাইয়া দেবার জন্য বার বৎসরের পূর্বে বালকদের খৎনা করা নিষিদ্ধ করা হয়। মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে এই বিধান জারি করা হয় যে -এই ধর্মাবলম্বী কোন লোকের মৃত্যু হলে তাহার গলায় কাচা গম ও পাকা ইট বাধিয়া তাহাকে পানিতে নিক্ষেপ করতে হবে এবং যেখানে পানি পাওয়া যাইবে না সেখানে মৃতদেহ জ্বালাইয়া দিতে হবে অথবা পূর্ব দিকে মাথা ও পশ্চিম দিকে পা করিয়া দাফন করতে হবে। একদিন আবুল ফজল বাদশাহকে একখানি কেতাব দেখাইয়া বলিলেন,”আপনার জন্য ফেরেশতা ইহা আসমান হতে এনেছেন।

সেই কেতাবের একস্হানে একটি আরবি বাক্য লিখিত ছিল,যাহার অর্থ এইরূপঃ ”হে মানুষ তুমি গাভী হত্যা করিও না । যদি কর তবে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। ”নিরক্ষর বাদশাহ ইহা বিশ্বাস করিলেন এবং গরু জবেহ করা নিষিদ্ধ ঘোষনা করে দিলেন। কানুন জারী করলেন,কসাই এর সাথে কেউ আহার করলে তার হাত কেটে দেয়া হবে এমনকি তাহার স্ত্রীও যদি তাহার সাথে আহার করে তবে তার আঙ্গুল কাটা হবে। এই নুতন ধর্মে গরু,উট,ভেড়া প্রভৃতি জন্তুর গোশত হারাম বলিয়া ঘোষিত হল।

পক্ষান্তরে বাঘ ভাল্লুকের গোশত হালালের মর্যাদা লাভ করে। মোট কথা সর্বক্ষেত্রে ইসলামের বিরোধিতা করাই ছিল দিন-ই-ইলাহির মূল উদ্দেশ্য। একদিন সভাসদগনকে বাদশাহ ডাকিয়া বলিলেন ,”হিন্দুস্হানের জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান যোগী ৃষীদের লিখিত হিন্দি ভাষার পুস্তক গুলি নির্ভুল জ্ঞানের উৎস। আমরা জদি এইগুলি ফার্সী ভাসায় অনুবাদ করে নেই তা হলে আমাদের ইহকাল ও পরকালে শান্তি লাভ হবে। তৎক্ষনাৎ বাদশাহর বাসনা পুরন করবার ব্যবস্হা করা হল।

অনুবাদ করার জন্য অনেক আলেম নিয়োগ করা হল এবং এর জন্য পৃথক দফতর কায়েম করা হলো। সঙ্গে সঙ্গে আরবী ভাষা পড়া ও জানা অপরাধ বলে সাব্যস্হ হলো। ইহার বদলে জ্যোতিষ শাস্ত্র,অংক,চিকিৎসা,ইতিহাস,ও কথা কাহিনী প্রভৃতি পুস্তকের প্রচলন করা হল। ইহার পর বাদশাহ আকবর হিন্দুদের উপর হতে কয়েক কোটি টাকার জিজিয়া কর উঠিয়ে নিলেন। পূর্বে যারা ‘এলমে ফেকাহ ‘ শিক্ষা দান করতেন তাদেরকে একশত বিঘা জমি জায়গীরসরূপ দেয়া হত।

বাদশাহ আকবর এই জায়গীর ছিনিয়ে লইলেন। ইসলামী আইন অনুযায়ী বিচার করার জন্য নিযুক্ত করা হত। জায়গীর প্রথা বন্দ্ধ করার ফলে ইসলামী বিচার ব্যবস্হার মূলে কুঠারাঘাত করা হল। এমনি করে ইসলামী হুকুমতের শেষ চিহ্ন টুকুও বিলুপ্ত করার জন্য বাদশাহ আকবর সর্বশক্তি নিয়োগ করলেন। ফলে কয়েক বৎসরের মধ্যে হুকুমতের কোন ক্ষেত্রেই আর ইসলামের চিহ্ন অবশিষ্ট রইল না।

মসজিদ বিরান হল। মাদ্রাসা ধ্বংস হল। অধিকাংশ আলেম দেশ ত্যাগে বাধ্য হল। শেষ পর্যন্ত বাদশাহ আকবরের রাজত্বে এমন এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্হিতির সৃষ্টি হল যাতে সুন্নি মুসলমানগন অতিষ্ট হয়ে উঠলেন। কারন একমাত্র সুন্নী মুসলমানগন ব্যতিত অন্য সব সম্প্রদায়ের লোকেরা ছিল বাদশাহর প্রিয়।

কাফেররা সন্মানিত হল,মোসলমানগন হলেন অপদস্হ। ইসলামী আহকাম পালন করতে গিয়ে তারা প্রতিটি ক্ষেত্রে কাফেরদের বিদ্রুপবানে জর্জরিত হতে লাগলেন। হিন্দুরা একাদশীর দিন উপবাস থাকেন। তাই সেই দিন মোসলমানদেরকেও উপবাস করতে বাধ্য করা হত। অথচ রমজান মাসে কাফেররা অবাধে খদ্যদ্রব্য বেচাকেনা করত ও প্রকাশ্যে আহার করত।

স্বয়ং বাদশাহ যাদের শায় তাদের বিরুদ্ধে শাহী অনুকম্পা পৃষ্ঠপোষকতা হতে সম্পুর্নরুপে বন্চিত মুসলমান কি-ইবা করতে পারবেন। তাহারা অন্তরে অন্তরে দগ্ধীভুত হতে লাগলেন। আল্লাহপাকের তরফ থেকে সাহায্য আসবার প্রতীক্ষায় থাকা ছারা তারা আর করনীয় কিছুই খুজে পেলেন না। একজন মোজাদ্দেদের প্রতীক্ষা করতে করতে তাহারা ধৈর্যের শেষ সীমানায় এসে পৌছলেন। ”কতদিন পর আসিবে সেই সত্য নূর- ইয়া এলাহী রহমত তোমার আর কতদুর ?” হযরত সেলিম চিশতি(রঃ) এর পুত্র মাওলানা বদরুদ্দীন ছিলেন উচ্চপদস্হ রাজকর্মচারী।

বিশিষ্ট দরবারীদের মধ্যে একমাত্র তিনিই বাদশাহর এইসব কুফরি আকিদার বিরোধিতা করলেন। প্রতিবাদ স্বরূপ তিনি সরকারী চাকুরী হতে ইস্তফা দিলেন। বাদশাহ তাহাকে দেওয়ানে খাছে ডেকে নিয়ে অনেক বুঝালেন। কিন্তু তিনি নিজ সিদ্ধান্তে রইলেন। হুকুমতের তরফ থেকে তার প্রটি কঠোরতা আরোপিত হল।

কঠোরতা চরমে উঠলে তিনি নীরবে হজ্ব করতে চলে গেলেন। বঙ্গদেশ ও বিহারের মুসলমাননের নিকট যখন বাদশাহ আকবরের এই পথভ্রষ্টতার সংবাদ পৌছল তখন তারা অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পরলেন। তারা এই বিরাট ফেতনায় শংকিত হয়ে হক্কানী আলেমগনের স্বরনাপন্ন হলেন। কাজী মোহাম্মদ ইয়াজদি ছিলেন জৌনপুরের অধিবাসী। তিনি ফতোয়া জারী করলেন, ”বাদশাহ আকবরের কার্যকলাপ হিন্দুস্হানে ইসলাম বিপন্ন করতেছে।

সুতরাং তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা ন্যায়সঙ্গত। ” কিন্তু প্রবল প্রতাপান্বিতমোঘল সাম্রাজ্যে এইসব কর্মসূচী কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারল না। শতকরা পচানব্বই ভাগ দেশবাসী হিন্দু। তারা সবাই বাদশাহর পক্ষে। তাছারা দুনিয়াদার আলেম ভন্ড সূফীকূল,শিয়া প্রভৃতি গোষ্টিও বাদশাহর হস্তকে শক্তিশালী করেছে।

জৈন,পারসী ও অন্নান্য সম্প্রদায়ের লোকদেরও রয়েছে বাদশাহর প্রতি অকুন্ঠ সরর্থন। সুতরাং বাদশাহ নির্বিঘ্নে ইসলাম বিরোধী শক্তির পৃষ্ঠপোষকতা করে যেতে লাগলেন। সমগ্র হিন্দুস্হানে ইসলামের এই ঘোর দুর্দিনে হজরত মোজাদ্দেদ আলফেছানি শায়েখ আহমদ ফারুকী সেরহিন্দি(রঃ) তাহার মোজাদ্দেদ সুলভ প্রজ্ঞা ও দৃঢ়সংকল্প নিয়ে সংস্কারের কর্যে ঝাপিয়ে পড়লেন। বেদাত ও কুফরীর যাতাকলে পিষ্ঠ ইসলামের ভয়াবহ দূরবস্হা দেখে তাহার ফারুকী রক্ত টগবগ করে ফুটে উঠল। গভীরভাবে পরিস্হতি বিশ্লেষন করে মোজাদ্দেদে আলফেছানি (রঃ) সিদ্ধান্তে আসলেন যে,সর্বপ্রথম বাদশাহর এছলাহ হওয়া প্রয়োজন।

কারন বাদশাহ রূহ এবং জনগন শরীর তুল্য। রূহের ব্যাধী দুরিভূত হলে শরীরও ব্যাধিমুক্ত হবে। কিন্তু বাদশাহর এছলাহ হওয়ার পুর্বে আমিরওমরাহ গনের এছলাহ হওয়া প্রয়োজন। হজরত মোজাদ্দেদ (রঃ) সেই দিকেই মনোনিবেশ করলেন। খান খানান, খানে আজম,সৈয়দ ছদরে জাহান,মোর্তজা খান,মহব্বত খান প্রমুখ ওমরাহ গন পুর্ব হতেই মোজাদ্দেদ(রঃ) এর মুরিদ ছিলেন।

তিনি তাহাদের দ্বারা বাদশাহ আকবরকে এইসব কুফরি কর্যকলাপ হতে তওবা করার জন্য আহ্বান জানালেন। তিনি ওমরাহগনকে নির্দেশ দিলেন -”তোমরা বাদশাহকে আমার পক্ষ থেকে বলে দাও যে,বাদশাহী ক্ষনস্হায়ী। এইসব আড়ম্বর চিরদিন থাকবে না। দুই দিনের চাকচিক্যের মোহে সত্যকে অস্বীকার করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। সুতরাং অবিলম্বে এইসব কুফরী কাজ হতে তওবা করে চিরনিরাপত্তার ধর্ম ইসলামের সুশীতল পুষ্পশোভিত বাগিচায় আগমন করা উচিৎ।

নতুবা গজব আসবে। আল্লাহ পাকের গজব হতে বাচবার সাধ্য কেউর নেই। আল্লাহ পাক সর্বশক্তিমান। বাদশাহীর পরোয়া তিনি করেন না। ফেরাউন,নমরুদ প্রমুখ প্রবল পরাক্রমশালী বাদশাহগনও আল্লাহর গজবে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে।

সেই গজব থেকে কেউই তাদেরকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়নি। ” মোর্শেদের কথামত ওমরাহগনও বাদশাহ আকবরকে নানাভাবে বুঝাতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। শেরেক,কুফরীর প্রভাবে তাহার মন পাষান হয়ে গিয়েছে। হেদায়েতের নূর সেখানে প্রবেশ করতে পারল না।

বাদশাহ নিজ সিদ্ধান্তে অটল রইলেন। একদিন বাদশাহ একটি অশুভ স্বপ্ন দেখলেন। স্বপ্ন তাকে অস্হির করে তুললো। রাজ্যের সমস্ত স্বপ্ন ব্যাখ্যাবিদ ও জ্যোতিষগনকে তিনি স্বপ্নের বিষয়বস্তু জানালেন এবং উহার অর্থ জানতে চাইলেন। তারা বাদশাহকে জানালেন,”এই স্বপ্নের অর্থ হছ্ছে এই যে বাদশাহর পতন অতি সন্নিকটে।

” বাদশাহ তা শুনে ভীত ও চিন্তিত হয়ে পরলেন। তিনি অনেকটা দমে গেলেন। নতুন করে ফরমান জারী করা হলো যে- পুর্বে দীন-ই-ইলাহী পালনের ব্যাপারে যে সব বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হত,এখন হতে তা থাকবে না। যারা সেজদা করতে ইছ্ছুক না -তাদেরকে আর সেজদা করতে বাধ্য করা হবে না। এদিকে হযরত মোজাদ্দেদ আল ফেছানি (রঃ) এর সারগর্ভ বাণী ও তার উজ্জল ব্যাক্তিত্যের আলোকে আলোকিত হয়ে লোকজন দীন-ই-ইলাহীর অসত্যতা ও অসারতা বোঝতে পেরে দলেদলে তার প্রতি আকৃষ্ট হতে লাগলো এবং ইসলামের সুশীতল ছায়ায় এসে আশ্রয় নিতে লাগল।

বিষয়টা বাদশাহ আকবরের আর অজানা রইল না। বাদশাহ তাই জনসমক্ষে দীন-ই-ইলাহীর শান-শওকত ও জাকজমকতা প্রদর্শন করার জন্য কিছুদিন পর এক উৎসবের আয়োজন করলেন। উৎসবে দুটি পৃথক দরবার নির্মান করা হল। একটির নাম করা হল ‘আকবরী দরবার’ যা নির্মান করা হল বহু অর্থ ব্যয় করে। চোখ ঝলসানো আলোক সজ্জার ব্যবস্হা করা হল।

ব্যবস্হা করা হল মনোরম মন্চ্ ও বিছান হল জৌলুসপূর্ন গালিচা। পুষ্পের সৌরভ,আতরের সুঘ্রানে আকবরী দরবার পরিনত হল ছোটছোট শাদ্দাদের বেহেশতে। ব্যবস্হা করা হল শাহী খাবারের ও সুমিষ্ট ফল-মুল ইত্যাদির। অপর দিকে মুহাম্মদী দরবারের অবস্হা ছিল খুবই করুন। ছিন্নভিন্ন ও জরাজীর্ন কাপড় দ্বারা তৈরী করা হলো মুহাম্মদী দরবার।

খাবারের ব্যবস্হা করা হলো নিম্নমানের। আলোক সজ্জার কোনো ব্যবস্হা নেই। নিতান্ত সাধারনভাবে তৈরী এই দরবারটিকে আকবরী দরবারের তুলনায় জীর্নশীর্ন কুড়েঘর মনে হতে লাগল। ইসলাম জড়াজীর্ন ও বর্তমানযুগের অনুপযযোগী বা অচল এবং দীন-ই-ইলাহী জাকজমকপূর্ন ও আধুনিক এটা জনসাধারনকে বুঝানোর জন্যই এ দুটি দরবার করা হল। কিন্তু সম্রাট এটা বোঝলেন না যে ,সত্য চিরদিনই সত্য।

সত্য কোনদিনই সময়ের অধীন নয়। অবশেষে সেই উৎসবের দিন আসল। সম্রাট আকবর তাহার সভাসদ ,আমির-ওমরাহ ও বিশিষ্ট অতিথিগনকে সঙ্গে নিয়ে মহাসমারোহে আকবরী দরবারে প্রবেশ করলেন। লোভী দুনিয়াদার লোকরাও তার অনুসরন করল। আনন্দ উল্লাসে মুখরিত হয়ে উঠলো ‘আকবরী দরবার’।

এমন সময় হজরত মোজাজ্জেদ আলফেসানী শয়েখ আহমদ ফারুকি সেরহিন্দ(রঃ) তার কিছু মুরিদান সহ আগমন করিলেন। তাহার বুঝিতে বাকি রইল না কোন উদ্দেশ্যে এই উৎসবের আয়োজন এবং কেনই বা দুই দরবারের মধ্যে আকাশ পাতাল ব্যবধান। মোসলমানদের হেয় ও অপদস্ত করাই যে বাদশাহর উদ্দেশ্য এটা বুঝতে আর বাকি রইল না। কিন্তু মান,সম্মান, ইজ্জত কাউর নিজের অর্জিত সম্পদ নয়। ইহা আল্লাহ প্রদত্ত এক নেয়ামত।

তিনি যাকে ইছ্ছা ইহা দান করেন। হজরত মোজাজ্জেদ(রঃ) তার মুরিদান সহ মোহাম্মদী দরবারে প্রবেশ করলেন। আহারের সময় হল। এমন সময় হজরত মোজাজ্জেদ(রঃ) এক মুরিদকে বলিলেন,”যাও মোহাম্মদী দরবারের চতুর্দিকে লাঠি দ্বারা দাগ দিয়ে আস এবং এক মুষ্ঠি ধুলি তার হাতে দিয়ে বলিলেন সম্রাটের দরবারের দিকে তা নিক্ষেপ কর। ”উক্ত মুরিদ তাই করল।

মূহুর্তের মধ্যে একটি ঘুর্নিঝর উঠিয়া আকবরী দরবারকে ঘিরে ফেলল। দরবারে মহা ধুমধাম চলছিল। হটাৎ তুফান দেখে সবাই ভয় পেয়ে গেল। কি করিবে বুঝিয়া উঠার আগেই তাবু উড়ে গেল। আসবাবপত্র , সাজসজ্জা, খদ্যসাগ্রী সমস্তই তছনছ হয়ে গেল।

নিমন্ত্রিত অতিথিগন একে অন্যের উপর পরে ধস্তাধস্তি করতে লাগল। তাবুর খুটি গুলো উপড়ে উঠে তাহাদের মস্তকে আঘাত করতে শুরু করল। একটি খুটি গিয়ে সম্রাটের মস্তকে পর পর সাতটি আঘাত করল। আঘাত পেয়ে সম্রাট মারাত্নক আহত হয়ে শয্যাশায়ী হলেন এবং কিছুদিন পরেই মৃত্যুবরন করলেন। সুদীর্ঘ পণ্চাশ বৎসরের কালিমা যুক্ত শাসনের অবসান হল।

ক্ষমতায় আসলেন তার পূত্র জাহাঙ্গীর। জাহাঙ্গীরের যৌবনকাল এই বাতিল ধর্মের উপরেই অতিবাহিত হয়েছিল। হিন্দু ব্রাম্মন ও যোগীদের সাহচর্য পিতার ধর্মমতের প্রভাব তাকেও ইসলাম ধর্ম হতে উদাসীন করে রেখেছিল। ফলে আকবরের মৃত্যু হল ঠিকই কিন্তু রয়ে গেল তার দীন-ই-ইলাহীর সমস্ত বাতিল মতবাদ ও হুকুমত। সম্রাট জাহাঙ্গীর ছিলেন পিতা আকবরের প্রতিষ্ঠিত দীন-ই-ইলাহীর একনিষ্ঠ মুরিদ।

পিতার নাম উচ্চারনের পুর্বে তিনি ”আমার মোর্শেদ” শব্দ উচ্চারন করতেন। তিনি বলতেন,”আমার মোর্শেদ বুজর্গ ছিলেন বগুবিধ প্রশংসনীয় গুনের অধিকারী। তাহার গুনাবলীর সামান্যতম অংশও যদি কোনবিরাটকায় পুস্তক রচনা করা যায় তবুও তাহার গুনাবলীর সামান্যতম অংশও বর্ননা করা সম্ভব হবে না। অজস্র ধন সম্পদ,হস্তী-অশ্ব,সৈন্যসামন্ত ও বিশাল পরাক্রমের অধিকারী হওয়া সত্তেও তিনি আল্লাহর দরবারে বড়ই দীনতা ও হীনতা প্রকাশ কর‌তেন। আমার ওয়ালেদ ধর্মে জ্ঞানী ও পন্ডিতগনের সাহচর্য বড়ই পছন্দ করতেন।

বিশেষ করে হিন্দু ধর্মের পন্ডিতগনের সাহচর্য ছিল তাহার অত্যধিক পছ্ন্দনীয়। তিনি সূর্য ও বিভিন্ন দেবতার পূজা করতেন। এইসব করায় কি দীনে মোহাম্মদীর সহিত সত্রুতা ছিল বলে প্রমানিত হয় ?” জাহাঙ্গীরের আকিদা বিশ্বাস ছিল এইরূপ। তিনিও তাহার পিতা আকবরের মত মনে করতেন যে, বিবেক যাহা ভাল বলে গ্রহন করবে সেই অনুযায়ী আল্লাহপাকের ইবাদত বন্দেগী করলেই চলবে। তাই ইসলামী শরীয়ত পালনের ব্যাপারে কোন গুরুত্বই তিনি দিলেন না।

কবির ভাষায় ”যে পথিক চলে না পথ নবীদের পথে, পড়ে রয় সে বহুদুর মনজিল হতে। ” মানুষ বদল হল কিন্তু আদর্শ বদল হলনা। জাহাঙ্গীর তাহার পিতার মত মুরিদ করতে লাগলেন। তিনি সূর্যকে বড়ই সম্মান করতেন এবং পরম শ্রদ্ধাভরে সশব্দে সুর্যের নাম উচ্চারন করতেন। সমস্ত কার্যের উপর নক্ষত্রের প্রভাব আছে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন এবং মনে করতেন নক্ষত্রসমুহ নুরে এলাহীর বিকাশস্হল।

জ্যোতিস শাস্ত্রে তার অগাধ বিশ্বাস ছিল। তার সভার প্রধান জ্যোতিষ ছিল কৃষ্ঞদৈবজ্ঞ । বিশেষ বিশেষ কাজ করবার পুর্বে তিনি জ্যোতিষদের পরামর্শ অনুযায়ী শুভক্ষন ও শুভলক্ষন এর প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখতেন। তিনি তাহার মুরিদগনকে উপদেশ দিতেন , ”কোন ধর্মের প্রতি শত্রুতা করিয়া নিজের মুল্যবান সময় নষ্ট করিও না । যুদ্ধের সময় এবং শিকারের সময় ব্যতীত কোন জীবকে হত্যা করিও না।

নক্ষত্রসমুহকে সম্মান করিও। কেননা ঐসব আল্লাহর নূরের বিকাশস্হল এবং ঘটনা ও অবস্হার উপর একমাত্র আল্লাহর প্রভাব আছে বলিয়া মনে করিও। ” বাদশাহ মনে করতেন, যেহেতু তিনি হিন্দু মোসলমান সকল জাতির বাদশাহ সুতরাং সব ধর্মের প্রতিই তার সমান পৃষ্টপোষকতা থাকা উচিৎ। এই ধারনার বশবর্তী হয়ে তিনি যেরূপ হিন্দু সাধুদের সম্মান করতেন তেমনি মোসলমান পীর ফকিরদের প্রতিও ভক্তি রাকতেন। তার এই আপোষমূলক নীতির ফলে কাফেরদের প্রভাবতো বিন্দুমাত্র কমলো না বরং আরও বেড়ে গেল।

সম্রাট জাহাঙ্গীর সিংহাসনে উপবেশন করে পিতার আমলের আমির ওমরাহগনকে তাদের স্ব স্ব পদে বহাল রাখলেন। ফলে শাহী দরবারে হিন্দুদের প্রভাব বিন্দুমাত্রও কমলনা। কারন দরবারের বড় বড় পদগুলো সব হিন্দুদের দখলেই ছিল। ফলে জিজিয়া কর পুনঃপ্রবর্তিত হলো না,গরু জবেহ বন্ধের হুকুম রহিত হল না । বাদশাহ দুনিয়াদার আলেম ও ভন্ড সুফীদের কার্যকলাপের প্রতি উদাসীন রইলেন।

ফলে পরিস্হিতি এমন আকার ধারন করল যে ,প্রকৃত ইসলামের নিশানা সমগ্র দেশ থেকে মুছে যাবার উপক্রম হল। ইহার উপর যোগ হল নুতন আর এক ফেতনা। এই ফেতনার মুল নায়িকা হলেন সম্রাট জাহাঙ্গীরের বেগম নুরজাহান। নুরজাহান ছিলেন শিয়া। শিয়া মতাবলম্বীদের কেন্দ্র হল ইরান।

বাদশাহ হুমায়ুন ইরানের সুলতানের সহায়তায় শের শাহের হাত থেকে দিল্লীর মসনদ পুনরুদ্ধার করেছিলেন। তখন থেকে শিয়াদের এক বিড়াট দল হিন্দুস্হান এসে বসবাস করতে থাকে এবং শাহী অনুকম্পায় রাষ্ট্রের বহু বিশিষ্ট পদ দখল করতে থাকে। সম্রাট জাহাঙ্গীর ছিলেন আশেক মেজাজের মানুষ। তিনি নুরজাহানকে অত্যধিক ভালবাসতেন। নুরজাহান ছিলেন অত্যধিক বুদ্ধিমতি।

সম্রাট জাহাঙ্গীরের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ক্রমে ক্রমে বাদশাহ ও বাদশাহীর উপর একছ্ছত্র প্রভাব করে ফেললেন। পরিস্হিতি এমন পর্যায়ে পৌছল যে ,সম্রাট জাহাঙ্গীর কেবল নামমাত্র বাদশাহ রইলেন। প্রকৃত ক্ষমতা চলে গেল নুরজাহানের হাতে। বাদশাহ স্বয়ং বলতেন ,”আমার বাদশাহী এখন নুরজাহানের ও তার দলের হাতে। আর আমি এক সের শরাব আর আধাসের গোশ্‌ত পাইলেই খুশী।

” নুরজাহানের নানা ছিলেন ইরানের উজির। নুরজাহানের এইরুপ প্রভাব প্রতিপত্তির কথা তার নিকট পৌছল। উজির সাব ছিলেন বিখ্যাত শিয়া নেতা। শিয়াগন সুন্নি মোসলমানদের প্রতি চরম শত্রুতা ভাব পোষন করত। নুরজাহানের সাহায্যে তারা সুন্নি মোসলমানদের কোনঠাসা করবার পরিকল্পনা করলো এবং সফলও হল।

নুরজাহানের ভ্রাতা আসফ খান হলেন সম্রাট জাহাঙ্গীরের উজির। শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত নুরুল্লা শুছতরীকে প্রধান কাজী নিযুক্ত করা হল। এই কাজী সাহেব সুন্নি মোসলমানদের প্রতি অত্যধিক বিদ্বেষভাব পোষন করতেন। হজরত মোজাদ্দেদ আলফেসানি (রঃ) পরিবর্তিত পরিস্হিতি বিশ্লেষন করে সংস্কারের নুতন পরিকল্পনা প্রনয়ন করবার বিষয়ে চিন্তা শুরু করলেন। পরিস্হিতি ভয়াবহ।

আল্লাহর সন্তুষ্টির প্রতি কাহারও লক্ষ্য নেই। রসুল পাক (সাঃ) এর প্রদর্শিত ছিরাতাল মুস্তাকিমের উপর চলবার কাহারো আগ্রহ নেই। গতানুগতিক নফসপরস্হ আর শয়তানী স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়ে সবাই অমুল্য সময় বৃথা অতিবাহিত করতেছে। মোঘল হুকুমত এই শয়তানী ধ্যান ধারনার পৃষ্ঠপোষক। মোজাদ্দেদ আলফেছানি(রঃ) হুকুমত হতে এই শয়তানী শক্তি নির্মুল করার জন্য দন্ডায়মান হলেন।

বাদশাহ বদল করলে কাজ হবে না । বাদশাহর এছলাহ(সংশোধন) করতে হবে। তার জন্য সর্বপ্রথমে এছলাহ করতে হবে হুকুমতের আমিরওমরাহগনের। কারন তাদের এছলাহ ব্যতিরেকে বাদশাহর এছলাহ স্হায়ী হবে না। হজরত মোজাদ্দেদ (রঃ) তাই ইসলামী আইন-কানুন আকিদা-বিশ্বাসের প্রতি উৎসাহিত করার জন্য খানে আজম, লালাবেগ,খান জাহান,কলীজ খান, শায়েখ ফরিদ প্রমুখ দরবারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন।

তিনি শায়েখ ফরিদের নিকট লিখলেন,”দেহের মধ্যে আত্না যেরূপ, বাদশাহ জনসাধারনের মধ্যে সেইরূপ। অন্তর পবিত্র থাকলে দেহও যেমন পবিত্র থাকে। তদ্রুপ বাদশাহ আদর্শবান হলে দেশবাশীও আদর্শবান হয়। আপনি জানেন,পুর্ববর্তী জামানার মুসলমানরা কতই না দুরবস্হার মধ্যে দিনাতিপাত করেছে। ইসলামের প্রথমাবস্হায় মোসলমানগন নগন্য সংখ্যক থাকা সত্বেও এইরূপ দুরবস্হার সম্মুখীন হননি।

মুসলমান নিজ ধর্ম পালন করত। আল্লাহ পাক ফরমাইয়াছেন, ”লাকুম দিনুকুম ওয়ালিয়াদিন”। অর্থাৎ ” তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্ম, আর আমাদের জন্য আমাদের ধর্ম। ”কিন্তু কিছুকাল পুর্বে বেদীংন প্রকাশ্যে দৃঢ়তার সাথে তাদের ইসলামী রাষ্ট্রে তাদের ধর্মের প্রচারনা চালাত,কিন্তু মোসলমান গন তদের ধর্ম প্রচার করার ক্ষমতা রাখতেন না। এমাকি এরকম করলে তাদের হত্যা করা হত।

আহা কি আফছোস! কি সর্বনাশ! কি বিপদ! কি কষ্ট!” হজরত মোজাদ্দেদ আলফেছানি (রঃ) আমির লালাবেগের নিকট লিখলেন,”প্রায় এক শতাব্দী অতীত হল,ইসলাম পথিকের ন্যায় দিন গুজরান করতেছে। কাফেরগন দারূল ইসলামে প্রকাশ্যভাবে কুফরী আহকাম জারী করেও তৃপ্ত হছ্ছে না । তাদের বাসনা ইসলামী আহকাম নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক। মোসলমান ও মোসলমানীর নাম নিশানা যেন বাকী না থাকে। তারা এত বেড়ে গিয়েছে যে ,মোসলমান গন ইসলামের কোন শেয়ার প্রচার করতে গেলে তাদেরকে হত্যা করা হয়।

গরু কোরবানী করা ইসলামের একটি বিশেষ কাজ। কাফেররা জিজিয়া কর দিতে রাজী হলেও গো হত্যা করতে দিতে রাজী হবেনা বলে মনে হয়। বর্তমানে বাদশাহর রাজত্বের শুরুতেই যদি ইসলামী হুকুমগুলি জারী করা হয় এবং মোসলমাংনকে সম্মানিত করা হয় তবেই কার্য সিদ্ধি হবে,নতুবা মোসলমানগন সংকটজনক অবস্হায় পতিত হবে। ইয়া আল্লাহ রক্ষা কর! রক্ষা কর ! আল্লাহপাকই জানেন কোন সৌভাগ্যবান ব্যক্তি এই সৌভাগ্যের আকাংখা করে এবং কোন বীরপুরুষ উক্ত দৌলত হাসিল করতে সক্ষম হয়। ” কলিজ খানের নিকট লিখিলেন,”আপনার মাধ্যমে এই দুঃসময়েও শ্রেষ্টনগরী লাহোরে যে শরীয়তের অনেক হুকুম প্রচারিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ,তাহার জন্য আপনার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছ.—-হজরত রসুলে পাক (সঃ)বলেছেন,’আমার উম্মতগনের মধ্যে সর্বদাই সত্য পথে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত থেকে জয়ী হবে।

বিপক্ষ দল তদের ক্ষতির চেষ্টা করেও সফলকাম হবে না। এইভাবে কিয়ামত পর্যন্ত তাদের অস্তিত্ব বজায় থাকবে। ’ ” এইভাবে হজরত মোজাদ্দেদ আলফেছানি (রঃ) হুকুমতের বিভিন্ন গুরুত্বপুর্ন ব্যক্তিবর্গের সহিত যোগাযোগ করে তাদেরকে ইসলাম প্রচারে উদ্বুদ্ধ করেন। সুন্নত ওয়ালজামাতই একমাত্র উদ্ধারপ্রাপ্ত দল এবং তাদের অনুসরনের জন্য দেশের বাদশাহ ও জনসাধারনকে উৎসাহিত করা এবং সমাজের সর্বক্ষেত্রে এই আকিদা প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যমেই যে প্রকৃত ইসলামের খেদমত করা হয়, বিভিন্ন মকতুবের মাধ্যমে তিনি সবাইকে উত্তম রূপে বিশ্লেষন করে দেখালেন। ক্রমে ক্রমে আব্দুর রহিম খানখান জাহান,ছদরে জাহান,খান জাহান, মীর্জা দারাব,কলিজ খান,নবাব শায়েখফরিদ,হাকিম ফাতহুল্লাহ ,শায়েখ আব্দুল ওয়াহাব,সেকান্দার খান লোদী,খেজের খান লোদী,জব্বারী খান,মীর্জা বদিউজ্জামান,সৈয়দ মাহমুদ,সৈয়দ আহমদ প্রভৃতি ব্যক্তি গন হজরত মোজাদ্দেদ আলফেছানি (রঃ) এর দলভুক্ত হলেন।

তিনি তাদেরকে নকশবন্দিয়া তরিকার শ্রেষঠত্ব,বেলায়েত,নবুয়ত,সুন্নতের অনুসরন,ক্বলবের সুস্হতা,নফসে আম্বারার স্বভাব ও তার অনিষ্ট থেকে মুক্ত হবার উপায় ইত্যকার বিভিন্ন বিষয়ে অবগত করিয়ে তাহাদিগকে এছলাহ করলেন। ফলে হুকুমতের এক বিড়াট অংশ হতে বেদাত ও বেদাত সুলভ মনোভাব দুরীভুত হল। মনে প্রানে এই দল হজরত মোজাদ্দেদ আলফেছানি (রঃ) এর নির্দেশে বাদশাহ জাহাঙ্গীরকে ইসলামের প্রতি উৎসাহিত করতে লাগলেন। বাদশাহ জাহাঙ্গীর আমির ওমরাহগনের মুখে সত্য পথের সন্ধান পেয়ে শরীয়ত প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আগ্রহান্বিত হয়ে উঠলেন। হজরত মোজাদ্দেদ আলফেছানি (রঃ) সেনাবাহিনির মধ্যেও ইসলাম প্রচারের ব্যবস্হা করলেন।

সেনাবাহানী হুকুমতের আর একটি গুরুত্বপুর্ন অংশ। এই অংশের এছলাহ হওয়াও জরুরী। হজরত মোজাদ্দেদ আলফেছানি (রঃ) শায়েখ বদিউদ্দীন (রঃ) কে সেনাবাহিনীর মধ্যে সুন্নত ওয়াল জামাতের আকিদা বিশ্বাস,ক্বলব পরিশুদ্ধ করা ও ক্বলবি জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্যে নকশবন্দিয়া তরিকার শ্রেষ্ঠত্ব , প্রভৃতি বিষয় প্রচার করার জন্য নিযুক্ত করলেন। আস্তে আস্তে সেনাবাহিনির এক বিড়াট অংশ হজরত মোজাদ্দেদ আলফেছানি (রঃ) এর ভক্ত হয়ে উঠল এবং অনেকেই তার মুরিদ হলেন। মোজাদ্দেদিয়া কাফেলা দিন দিন বেড়ে চলল।

হজরত মোজাদ্দেদ আলফেছানি (রঃ) বিভিন্ন শহর ও গুরুত্বপুর্ন পল্লীঅন্চলে খলিফা নিযুক্ত করলেন। তিনি তাহাদের প্রতি নিয়মিত সারগর্ভ নসিহত ও জেহাদের কর্মসুচী পেশ কর‌্তে লাগলেন। তার মকতুবাদের অনুলিপি প্রায় একই সঙ্গে বিভিন্ন খলিফার নিকটে প্রেরিত হতে থাকল। এইসব মকতুব ছিল এক একটি সংগ্রামেী ইশতেহার। জেহাদ দ্বিমুখী।

প্রথমত নিজের নফসের ও মনের এছলাহ ও অপরটি হছ্ছে হুকুমতের বিভিন্ন ক্ষেত্রে,সমাজের বিভিন্ন জায়গায় দীর্ঘ্যকাল ধরে পুন্জিভুত বেদাত ও কুসংস্কারের বিলুপ্তিসাধন। সমাজ জীবনে এই ফেতনার মুল উৎস হছ্ছে দুনিয়াদার আলেম ও ভন্ড সূফিগনের মংড়া বাক্যসমুহ। হজরত মোজাদ্দেদ আলফেছানি (রঃ) দুনিয়াদার আলেমদের স্বরূপ উন্মোচন করে দিলেন এবং তাদের ফেতনা থেকে মোসলমানদের মুক্ত করার জন্য চেষ্টা করে যেতে লাগলেন। তিনি লিখলেনঃ ”হাদিস শরীফে উল্লেখ আছে,নিশ্চয় ঐ ব্যক্তিই কিয়ামতের দিন সর্বাপেক্ষা কঠিন শাস্তি ভোগ করবে,যে আলেম নিজের এলেম দ্বারা উপকৃত হয়নি। ” ভন্ড সূফীকুলও দীনের মধ্যে ফেতনা সৃষ্টির এক অন্যতম হাতিয়ার।

তাদের বাতিল চিন্তাধারা সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রবেশ করে মোসলমানদের আকিদা বিপর্যস্ত করে দিয়েছিল। তাদের অসৎ কার্যকলাপের প্রাবল্য শরীয়তের সৌন্দর্যকে বিকৃত ও বিবর্ন করে দিয়ে মোসলমানদের পদস্খলন ঘ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।